সাইদা ইসলাম সেঁজুতি:বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে কৃষি। বাংলাদেশের জিডিপি আয়ের ১৪ শতাংশই আসে এই কৃষি থেকে যদিও বা চাহিদার সাথে তাল মিলাতে দিন দিন এর উৎপাদনের পরিধি বেড়ে চলেছে। সৃজনশীল পদ্ধতিতে টেকসই ও স্বনির্ভর কৃষি পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রতিবছর বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের ২ থেকে ৩ শতাংশ বরাদ্দ করা হয় কৃষির জন্য। ভবিষ্যৎ চাহিদা ও টেকসই কৃষি উন্নয়নের কথা চিন্তা করে এবছর এর শতকরা হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে মোট জাতীয় বাজেটের ৬ শতাংশ। কৃষিকাজের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেট বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ২৪ হাজার ২২০ কোটি, যা কিনা বিগত বছরে ছিল মাত্র ১৬ হাজার ১৯৭ কোটি।
এদেশের প্রেক্ষাপটে কৃষিকে বাদ দিয়ে কাঙ্খিত টেকসই উন্নয়ন অকল্পনীয়। সর্বোত্তম পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমেই কেবল কৃষিক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব। এই সর্বোত্তম পদ্ধতিটিই হতে পারে কৃষিতে জৈব সারের তুলনামূলক অধিক উপকারি ব্যবহার। মাটির উর্বরতা হ্রাস, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, পানি সল্পতা, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। ক্রমাগত মাটির উর্বরতা হ্রাস, ক্ষয়, মাটিতে জৈব পদার্থের স্বল্পতা, পানি ও মাটি দূষণ, অম্লতা বৃদ্ধির কারণে জমির গুণগতমান কমে যায়। কৃষি জমিতে অপরিকল্পিত ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগ এর প্রধান কারণ। এটি শুধুমাত্র কৃষি জমি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের জন্যই দায়ী নয় বরং মানুষের স্বাস্থ্য ও কৃষি সুলভ পরিবেশের জন্য বড় ধরনের হুমকির শামিল।
বাংলাদেশ সরকার প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের কৃষি বাজেটে জৈব সার ব্যবহারে আগ্রহী করে তোলার জন্য কৃষকদের রাসায়নিক স্যারের মতো জৈব সার ব্যবহারে ও বিশেষ ভর্তুকির ব্যবস্থা করে দিয়েছে, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। জৈব সারের অনন্য বৈশিষ্ট্য হল এটি রাসায়নিক সার অপেক্ষা অধিক সময়ের জন্য মাটিতে প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান সরবরাহের মাধ্যমে পুষ্টিগুণ বাড়ায় এবং মাটির গঠন, বুননশৈলী ও মিশ্রণকে সূক্ষ্ম ও সুচারু করে মাটিতে বায়ুপ্রবাহ ও পানি ধারণক্ষমতা বাড়ায় এবং মূলের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। পক্ষান্তরে, জৈব সারের প্রয়োগ কোন প্রকার দূষণ ছাড়াই স্বল্প ব্যয়ে আশানুরূপ ও গুণগত মান সম্পন্ন কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন ও চাহিদা মেটাতে উপযোগী।
জলবায়ু পরিবর্তনের এ যুগে যখন উন্নত দেশগুলো টেকসই উন্নয়নের দিকে ঝুকছে তখন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেরও সময়ের দাবি তার অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি কৃষির টেকসই উন্নয়নের দিকে সুপরিকল্পিত দৃষ্টিপাত করা। সহজ ভাষায় কৃষি ব্যবস্থার টেকসই উন্নতি বলতে আমরা বুঝি চারপাশের পরিবেশ, সমাজ ও নাগরিকদের সার্বিক উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খাদ্য দ্রব্যের যথাযথ সহজলভ্যতার কথা চিন্তা করে বর্তমান সময়ের খাদ্য দ্রব্যের চাহিদা মেটানো। অর্থাৎ কৃষি পণ্যের গুণগত মান বজায় রেখে বর্তমান ও ভবিষ্যতের খাদ্য দ্রব্যের যথাযথ চাহিদা পূরণ করা তথা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা। নিঃসন্দেহে ১৬০ মিলিয়ন মানুষের খাদ্যের যোগান দেয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ কারণে আধুনিক কৃষিকে জমির জীববৈচিত্র্য রক্ষার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে এবং টেকসই কৃষির দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
টেকসই কৃষি কাজের প্রযুক্তিগত পন্থাগুলো হল জৈব কৃষি, জৈব চাষ, জমিতে জৈব সার প্রয়োগ, শস্য আবর্তন, মিশ্র শস্য ফলন ইত্যাদি। টেকসই কৃষি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সকল পদ্ধতির সমন্বয় সাধন অতিব প্রয়োজন। এক্ষেত্রে মাটির জীববৈচিত্র্য ও গুনাগুন ধ্বংসকারী রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জমিতে জৈব সার ব্যবহার হতে পারে অধিক উৎপাদনশীল ও গুণগতমান সম্পন্ন জৈব কৃষি চর্চার সর্বপ্রথম ও যুগোপযোগী পদ্ধতি।
জৈব সার হল এক এক ধরনের কার্বন (C) সমৃদ্ধ সার যা প্রাকৃতিক ভাবে উৎপন্ন হয়। প্রাকৃতিক পঁচনশীল এবং জৈব উপাদান যেমন গবাদি পশুর উচ্ছিষ্ট, হাঁস মুরগির বিষ্ঠা, ঘরবাড়ির পঁচনশীল ময়লা আবর্জনা ইত্যাদি থেকে যে প্রাকৃতিক সার তৈরি হয় সেটি হল জৈব সার। মূলত যেসব সার কোন জীবের দেহ থেকে প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ উদ্ভিদ বা প্রাণীর ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া যায়। যেমনঃ গোবর সার, সবুজ সার, খৈল ইত্যাদি। গাছের প্রায় সব খাদ্য উপাদানই জৈব সারে থাকে। প্রাকৃতিক উপাদান থেকে জৈব সারের উৎপত্তি। এই প্রাকৃতিক পঁচনশীল আবর্জনাগুলো হল গাছের পাতা, ফলের খোসা, পঁচাবাসি খাবার, কাগজ, গবাদি পশুর ও হাঁস মুরগির উচ্ছিষ্ট ইত্যাদি। বিশ্লেষিত ও পঁচনকৃত আর্দ্র পদার্থে যে খনিজ পদার্থ ও পুষ্টি উপাদান অবশিষ্ট থাকে সেটিই প্রাকৃতিক ফলন বৃদ্ধি কারক পদার্থ হিসেবে জৈব সারে সংরক্ষিত থাকে।
জৈব সার তৈরি তিনটি প্রধান শর্তাবলী হল- প্রথমত পেতে কমপক্ষে ২০% জৈব পদার্থ থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত ১০ থেকে ১৫% আদ্রতা থাকতে হবে এবং তৃতীয়ত, জৈব সারে নিকেল, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক ইত্যাদি সহনশীল মাত্রার অতিরিক্ত থাকা যাবে না। বিভিন্ন ধরনের জৈব সার আছে; যেমন: *ম্যানুর (manure)-)- গবাদি পশুর গোবর ও উচ্ছিষ্ট থেকে তৈরি; অপেক্ষাকৃত অধিক পরিমাণে নাইট্রোজেন বহনকারী, *কম্পোস্ট(compost)- আবদ্ধ জায়গায় ঘরবাড়ির পঁচনশীল ময়লা আবর্জনা ও ফলমূলের খোসা ইত্যাদি পঁচানোর মাধ্যমে তৈরি, *রক ফসফেট *হাঁস মুরগির উচ্ছিষ্ট, *ভার্মি কম্পোস্ট (vermi-compost): নানাধর্মী খাদ্য আবর্জনাকে প্রাকৃতিক কেঁচো দ্বারা পঁচিয়ে তৈরীকৃত সার ও অন্যান্য। এছাড়াও প্রধান জৈবসার গুলো সার হল পীট, প্রাণিজ উৎস এবং কৃষিকার্য কাছ থেকে প্রাপ্ত উদ্ভিদ বর্জ্য এবং পরিশোধিত নর্দমার কাঁদা। এ ধরনের সারের বিশেষত্ব হলো খাদ্যশস্যের বৃৃদ্ধির ও পরিপক্কতার জন্য যে উপকারী পুষ্টি ও খনিজ উপাদান প্রয়োজন (প্রধানত এনপিকে; নাইট্রোজেন ফসফরাস ও পটাশিয়াম) তা নির্দিষ্ট পরিমাণে দীর্ঘ সময়ব্যাপী যোগান দিয়ে থাকে এবং মাটি ও পানি দূষণ রোধ করে টেকসই ভাবে যথাযথ চাহিদা পূরণের মাধ্যমে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ আশানুরূপ ফলন নিশ্চিত করে। আরো বিশদভাবে চিন্তা করতে গেলে এটি মাটি, পানি ও খাদ্যশৃঙ্খলে ক্ষতিকর ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক উপাদানের প্রবেশকে রোধ করে, মাটির গুণগত বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে, অনাকাঙ্খিত ক্ষতিকর রোগ প্রতিরোধ করে জীববৈচিত্র্য ধারাকে অব্যাহত রাখে তথাপি গ্রীন হাউস গ্যাস নিষ্কাশন তথা জলবায়ু পরিবর্তন রোধেও সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
জৈব পদার্থ হল মাটির প্রাণবন্ততা। জৈব সার ব্যবহারের ফলে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ে। এতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং অন্যান্য পুষ্টি রয়েছে যা ফসলের প্রধান খাদ্য এবং একইভাবে ক্ষুদ্রাকৃতির উপাদান গুলি ঘাটতিও পূরণ হয়। মাটির কাঠামো এবং গুণমান উন্নত করে। বালুকাময় মাটি সরস হয়ে যায়, জলের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, তাছাড়া কাদামাটি কিছুটা দোলা তৈরি করে মাটির দিকে আরো উর্বর করে। মাটিতে জৈব সার প্রয়োগ করার পরে, গাছটি ধীরে ধীরে এটির প্রয়োজনীয়তার হিসাবে অনেকদিন ধরে শুষে নিতে পারে। জমিতে দেওয়ার পরে এটি প্রায় ৬-১৮ মাসের পরে প্রভাব ফেলতে পারে। এটি পরবর্তী ফসলেও উপকারী। জৈব সার ব্যবহারের ফলে মাটিতে উপকারী জীবাণুগুলির ক্রিয়া কলা বৃদ্ধি পায় এবং তাদের প্রজননে সহায়তা করে। এই পদ্ধতিতে মাটি থেকে সহজ উপায়ে খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে গাছটি দ্রুত বাড়তে পারে। জৈব সার গাছের শিকড় এবং অঙ্গ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কেঁচো, পিঁপড়া, মাটিতে গর্ত তৈরি করে যেখানে জৈব পদার্থ প্রয়োগ করা হয়। এটি শিকড় গুলিতে কারো অক্সিজেন দেয় এবং মাটিতে বায়ু সঞ্চালনে সহায়তা করে। ফলস্বরূপ গাছটি সতেজ হয়ে ওঠে। গ্রীষ্মের মাটির তাপমাত্রা হ্রাস করে এবং শীতে উষ্ণ রাখতে সহায়তা করে। এটি সমস্ত মৌসুমে গাছের শিকড় বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে।
জৈব সার, রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং জৈব সার ব্যবহার একটি আনুপাতিক হারে রাসায়নিক সারের মাত্রা হ্রাস করতে পারে। জৈব সার মাটিতে কীটনাশক এবং রাসায়নিক সারের আধিক্য জনিত কারণে যে কোন বিষের বিষ কমাতে সহায়তা করে। এমনকি যদি আরো জৈব সার ব্যবহার করা হয় তবে মাটির কোন ক্ষতি হয় না। সর্বোপরি এটি ফসলের ফলন বৃদ্ধি করে এবং গুণগতমান বৃদ্ধি করে এবং সঞ্চিত শস্যের সঞ্চয়ের ক্ষমতা বাড়ায়।
জৈব সারের এতসব সুবিধা পাশাপাশি এর কতিপয় ক্ষতিকর বা অসন্তোষজনক বৈশিষ্ট্য হলো- সকল জৈব সারের পুষ্টিগুণ সমান হওয়া সম্ভব নয় এবং এর দ্বারা সকল প্রকার পুষ্টি উপাদান সরবরাহ সম্ভব নাও হতে পারে। প্রাকৃতিক পঁচন ক্রিয়ার মাধ্যমে এবং মাটিতে বসবাসকারী ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র জীবের উপস্থিতিতে জৈব সার অধিক পুষ্টি সম্পন্ন হলেও সকল উপাদান সীমিত পরিমানে থাকে যা একটি লম্বা সময় ধরে খাদ্যশস্যের বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। তাছাড়া বাসা বাড়িতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কম্পোস্ট বা জৈব সার প্রস্তুত প্রণালী কিছুটা অস্বাস্থ্যকর এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের উদ্ভব ঘটিয়ে থাকে এবং দুর্গন্ধের কারণে হয়ে থাকে। এর ব্যতীত জৈব সারের আরো কিছু উপকারিতা হলো এটি মাটিতে কোন শক্ত আবরণ তৈরি করে না যা মাঝে মাঝে অজৈব সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়। আর তাই এটি পানি চলাচলের পথ সুগম করে এবং মাটির কাঙ্খিত কাঠামোকে বজায় রাখে এবং মাটিতে বসবাসকারী উপকারী মাইক্রোবিয়াল জীবের শ্বসন তথা বংশ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং জমিকে চাষের জন্য অধিক উপযোগী করে তৈরি করে। আর এই সকল কারণেই জৈব সারকে অন্যান্য সকল সারের চেয়ে কৃষকদের জন্য অধিক কৃষি উপযোগী বলে বিবেচনা করা হয়।
এছাড়াও টেকসই কৃষির জন্য এটি অন্যান্য অজৈব সার অপেক্ষাকৃত বেশি টেকসই ও স্থায়ী বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা মতামত প্রকাশ করে থাকে। কেননা টেকসই কৃষির তিনটি স্তম্ভ- সৃজনশীল বিকাশ, টেকসই বৃদ্ধি ও সমন্বিত এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন সাধন প্রত্যেকটির মাঝেই আন্তঃসম্পর্ক ও ভারসাম্য রক্ষার প্রধান কারিগর হিসেবে কাজ করে প্রাকৃতিকভাবে প্রস্তুত এই জৈব সার।
রাসায়নিক সার উৎপাদিত হয় রাসায়নিক কারখানায় রাসায়নিক বিক্রিয়ার দ্বারা; যেখানে জৈব সার পস্তুত হয় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে অধিক পুষ্টি সম্পন্ন জৈব বর্জ্য পঁচনের মাধ্যমে ঘরবাড়ি কিংবা খামার বাড়িতে। বাংলাদেশের প্রতিবছর ৪ মিলিয়ন রাসায়নিক সারের প্রয়োজন পড়ে এবং কৃষিজ জমিকেও এ মাত্রাতিরিক্ত সার প্রয়োগের জন্য ক্ষতিকর মাশুল দিতে হয় এবং প্রকটভাবে বিভিন্ন এলাকার জমির প্রয়োজনীয় জৈব উপাদান হ্রাস পায় যা জমিকে অনুর্বর ও পুনরায় একই ধরনের শস্য চাষে অনুপযোগী করে তোলে তথা মাটি দূষণ ঘটায়। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, কোন এলাকার জমির স্ট্যান্ডার্ড জৈব উপাদান থাকা প্রয়োজন ৩.৪%। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে অধিক পরিমাণ রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে এর পরিমাণ বাংলাদেশে ১-১.৭% এবং কোন কোন জায়গায় ১% এর ও নিচে নেমে এসেছে। কৃষি জমির এই পরিবর্তিত দৃশ্য আবার স্বাভাবিক করতে এবং কৃষি জমির উর্বরতা ও জৈব উপাদানের ভারসাম্য ফিরিয়ে প্রাকৃতিক জৈব সার হল একমাত্র আস্থা। এটি মাটির যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভারসাম্য রক্ষা করে এবং অধিক সময়ের জন্য জমিকে উর্বর রাখে। এটি যেহেতু সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত এর দ্বারা কোন ক্ষতিকার বর্জ্য বা পদার্থ ভূগর্ভস্থ পানিস্তরে প্রবেশ করে না কিংবা নদী নালার পানিকে দূষিত ও করে না।
একজন সফল কৃষকের কাছে জৈব সারের অর্থনৈতিক মূল্য হল এটি কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন বাড়ায়, মান ধরে রাখে এবং আশানুরূপ ফলন নিশ্চিত করে। খাদ্যশস্যের অধিক ফলনের চাহিদা মিটিয়ে এটি কৃষিজ জমির সময়োপযোগী শারীরিক, রাসায়নিক ও জৈব পরিবর্তন ঘটাতেও ভূমিকা রাখে। ফলস্বরূপ মাটির দানার গঠন-কাঠামো, মিশ্রণ ঠিক থাকে, যথাযথ অক্সিজেন সরবরাহের মাধ্যমে বায়ুপ্রবাহ স্বাভাবিক হয় এবং মাটি নরম হয়ে ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। সারা বছর শস্যচক্রায়নের মাধ্যমে জমিতে শস্য বপন ও কর্তন চলতে থাকে যা মাটিকে ক্রমাগত পুষ্টি শুন্য করে এবং প্রয়োজনীয় পি এইচ কে বিঘ্নিত করে। অপরদিকে জৈব সারের কাজই হল পিএইচ-কে সাম্যাবস্থায় এনে খাদ্যশস্যের সুষম বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা। জৈব সার প্রয়োগে উৎপাদিত খাদ্য ক্ষতিকারক রাসায়নিকের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করে। এ ধরনের খাদ্য গ্রহণে ভোক্তাদের কোনোরূপ অসুখ-বিসুখ যেমন ক্যান্সার, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, ত্বক সংক্রান্ত সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না; যা খাদ্যদ্রব্যে ক্ষতিকারক খনিজের উপস্থিতির কারণে হয়ে থাকে। এ সকল অনাকাঙ্খিত খনিজ পদার্থ রাসায়নিক সার প্রয়োগে খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে থাকে।
বড় বড় রাসায়নিক কারখানায় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বছরে মিলিয়ন টন পরিমাণ রাসায়নিক সার উৎপাদিত হয়। অন্যদিকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে এলাকাভিত্তিক ভাবে জৈব সার প্রস্তুত করা হয়। টেকসই ও গুণগত কৃষিজ উৎপাদনের জন্য ব্যাপক হারে জৈব সার উৎপাদন হবে বেকারদের জন্য কাজের নতুন ক্ষেত্র। বিশেষভাবে সে সকল গ্রামীন পরিবেশে যেখানে বেকারত্ব ঘোঁচানোর মতো কাজের ক্ষেত্র এখনো তৈরি হয়ে ওঠেনি। অর্থনৈতিক লাভের কথা চিন্তা করে ব্যবসায়িক পরিসরে জৈবসার উৎপাদন করার সুযোগ বাংলাদেশের রয়েছে। কেননা শুধুমাত্র শহর অঞ্চলেই প্রতিদিন প্রায় ১৩ হাজার ৩৩২ টন পঁচনশীল আবর্জনা উৎপাদিত হয়ে থাকে এবং সরকার কর্তৃক জাতীয় ৩ আর (3R= reduce, reuse and recycle) পদ্ধতিতে ও পঁচনশীল বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার করে জৈব সার উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে। এটি কেবল দেশের টেকসই কৃষিকেই নয় বরং টেকসই উন্নয়নের দিকটিকেও নিশ্চিত করে।
সাধারণভাবে, জৈব সারের পুষ্টিগুণ বেশি মিশ্রিত থাকে। যা উদ্ভিদের জন্য খুব কম সহজলভ্য। তবে এটি অদ্রবণীয় নাইট্রোজেন ধারণকারী ধীর-নিঃসরণীয় সার হিসাবে পছন্দনী হতে পারে। জৈব সারের স্বভাব হলো, জৈব সার মাটিতে ভৌত এবং জৈবিক পুষ্টি সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়ায়, অতিরিক্ত সারপ্রয়োগের দ্বারা সংঘটিত ঝুঁকি হ্রাস করে। জৈব সারের পুষ্টি উপাদান, দ্রবণীয়তা এবং পুষ্টি উপাদান নিঃসরণের হার সাধারণত খনিজ সারের তুলনায় অনেক কম।
নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে মাটিতে সম্ভাব্য খনিজযোগ্য নাইট্রোজেন(PMN) কৃত্রিম নিয়ন্ত্রণের তুলনায় জৈব মালচড সিস্টেমে ১৮২-২৮৫% বেশি। জৈব সার জীববৈচিত্র এবং মাটির দীর্ঘমেয়াদী উৎপাদনক্ষমতা উন্নত করতে পারে এবং অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড ধারণ করতে পারে। জৈব পুষ্টি সমূহ, জৈব পদার্থ এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সরবরাহের মাধ্যমে মাটিস্থ অণুজীবগুলোর (যেমন: মাইকোরাইজা ছত্রাক) কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আর মাইকোরাইজা ছত্রাক উদ্ভিদকে পুষ্টি শোষণে সহায়তা করে। জৈব পুষ্টি কীটনাশক, শক্তি এবং সারের খরচ অতিমাত্রায় হ্রাস করতে পারে। কম্পোস্ট এবং অন্যান্য উৎস থেকে জৈব সারগুলির পুষ্টি উপাদান এক চালান থেকে অন্য চালানে বেশ পরিবর্তন হতে পারে। তাই নির্দিষ্ট চালান (ব্যাচ) পরীক্ষা ছাড়া, প্রয়োগকৃত পুষ্টির পরিমাণ সঠিকভাবে জানা যাবে না। তবুও, এক বা একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, জৈব সার দীর্ঘ সময়ব্যাপী ব্যবহার করা হলে ইহা রাসায়নিক সারের মতো কার্যকর।
টেকসই উনয়নের এই দিনে নিঃসন্দেহে ভবিষ্যৎ কৃষিতে জৈব সারের ব্যাপক উপকারী ভূমিকা থাকা অনিবার্য। গ্রামীণ থেকে অত্যাধুনিক, কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত প্রত্যেকটি সদস্যেরই জৈব সার সম্পর্কে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ জ্ঞান থাকা এখন যুগের চাহিদা। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে গাছপালার অবশিষ্টাংশ, পশু পাখির উচ্ছিষ্ট, পঁচনশীল ফলমূলের খোসা থেকে জৈব সার প্রস্তুত হওয়ায় রাসায়নিক সারের মত এর কোন ক্ষতিকারক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। জৈব সারের পর্যাপ্ত উৎপাদন ও সহজলভ্যতা আগামী দিনে সমাজ ও পরিবেশবান্ধব জৈব চাষের ধারণাটিকেও সফল করে তুলবে। অধিক ফলন ও গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে ক্ষতিকারক রাসায়নিকের উপর নির্ভর না করে জৈব সার হবে কৃষকদের ভরসার জায়গা। আর এ কারণে বলাব্হুল্য যে আগামী দিনে কৃষি জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে ও গুণগত মান বজায় রেখে টেকসই কৃষি ব্যবস্থায় কৃত্রিম সার অপেক্ষা জৈব সারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
লেখক:শিক্ষার্থী
এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
ত্রিশাল, ময়মনসিংহ