আবুল বাশার মিরাজ, বাকৃবি প্রতিনিধি: ফল দেখতে আমাদের দেশের লটকনের মতোই, কিন্তু এটি আসলে লটকন না। গাছটির ছোট-বড় ডালে, কান্ডে থোকায় থোকায় ধরে থাকে এর ফল। ফলটির নাম ল্যাংস্যাট। এর বৈজ্ঞানিক নাম Lansium parasiticum. সুগন্ধ আর সুমিষ্ট এই ফলটি খেতে খুবই সুস্বাদু। দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ আগে থাইল্যান্ড থেকে সুস্বাদু এই ফলটির চারাগাছ আনা হয়েছিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফল জাদুঘর তথা জার্মপ্লাজম সেন্টারে। জার্মপ্লাজম সেন্টারটির সাবেক প্রকল্প পরিচালক ও উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. এম এ রহিম চারাগাছটি এনেছিলেন বলে জানায় জার্মপ্লাজম কর্তৃপক্ষ।
সে সময় ১ বছর বয়সী সেই চারাগাছগুলোকে সফলভাবে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে রাখা হয় সেন্টারটিতে। বর্তমানে গাছটিতে ব্যাপক পরিমাণে ফল ধরেছে। অর্থাৎ দেশে রোপণকৃত প্রথমবারের মতো সফলভাবে ফল ধরলো এই বিদেশী ফলের গাছটিতে। সেন্টারটিতে থাকা সবগুলো গাছেই ফল ধরেছে। দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে বিদেশী এই গাছটিকে ছড়িয়ে দিতে এখনও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে সেন্টারটি। গবেষকরা বলছেন, সারা বছরব্যাপী ফল উৎপাদন ও বাহারী বাণিজ্যিক ফলের সমাহারে বাংলাদেশে নতুন একটি নাম হতে যাচ্ছে ল্যাংস্যাট। যেটি বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় ফল হিসাবে দ্রুতই জায়গা করে নিবে।
জানা গেছে, এটি মূলত থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মালাইশিয়া ব্রনাইসহ বেশ কিছু দেশে চাষাবাদ হয়ে থাকে ফলটি। প্রায় এক যুগ আগে চারাগাছ আনা হলেও, তার সফল পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পন্ন করা হয় বাকৃবির এই জার্মপ্লাজম সেন্টারটিতে। প্রতিষ্ঠানটি রোপণের পর থেকেই গাছটিকে নিয়েই গবেষণা কার্যক্রম চালিয়েছে। তারা দেখেছে ফল গাছটি বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী কিনা? ফল উৎপাদনে কোন ধরণের প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা? চারাগাছ উৎপাদন প্রক্রিয়া, রোগ-বালাই ইত্যাদি নানান বিষয়। তবে বাংলাদেশের আবহাওয়াতে সব কিছুতেই সফল ল্যাংস্যাট নামের বিদেশী এই ফল।
চমৎকার সুঘ্রাণযুক্ত ফলটি খেতে মিষ্টি। স্বাদ অনেকটা লিচু কিংবা আঙুরের মিশ্রণের মতো বলা যায়। ফলটির পাতলা খোসা/ছাল খুলে ভিতরের ভক্ষণযোগ্য অংশ বেরিয়ে আসে। ভক্ষণযোগ্য অংশটি পুরোটাই স্বচ্ছ। ফলের বীজের আকার খুবই ছোট। খাওয়ার সময় এটিও ফেলে দিতে হয়না। খোসা ছিলেই খাওয়া যায় ফলটি। খোসার ভিতরে মাংসল অংশটুকু নরম হওয়ায় খুব বেশি চিবোতেও হয়না।
ফল গাছটির ডালা, কান্ড থেকে বেড়িয়ে আসে। থোকায় থোকায় ঝোঁপা আকারে ফলটি ধরে থাকে। প্রতিটি ঝোপাঁয় ২০-১০০ টি কিংবা তারও বেশি ফল ধরে থাকে। বড় সাইজের এক একটি ফলের ওজন ২৫-৩০ গ্রাম। ৩০-৪০ টি ফল মিলিয়ে ১ কেজি হতে পারে।
বাকৃবি জার্মপ্লাজম সেন্টারটির পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. মোক্তার হোসেন বলেন, ‘ ল্যাংস্যাট ফলটি ভিটামিন ও মিনারেল যুক্ত একটি ফল। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, এন্টি-অক্সিডেন্ট, ফসফরাসসহ বিভিন্ন ভিটামিন থাকে। তবে মিষ্টি হওয়ায় এতে ভিটামিন সি এর পরিমাণ কম থাকে। ফলটির প্রায় ৮৫ ভাগই খাওয়া যায়। একদম শিশু থেকে শুরু করে সববয়সী মানুষেরা ফলটি খেতে পারেন। শরীরে বিভিন্ন ভিটামিনের ঘাটতি পূরণে ফলটি খুবই উপকারী।
ফলের গাছটির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটির আকৃতি অনেকটা লটকন/লিচু গাছের মতো কিন্তু পুরোপুরি লিচু/লটকন গাছের মতো বলা যাবে না। প্রতিটি ফল গাছেরই আলাদা বৈশিষ্ট্যের হয়ে থাকে, এটিও তাই। এপ্রিল-মে মাসের মাঝামাঝিতে ল্যাংসেট গাছটিতে ফুল আসে এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ফল পাকতে শুরু করে। একটি পরিপক্ক গাছে বছরে ৪০-৫০ কেজি কিংবা তারও বেশি ফল ধরে। আমরা প্রায় ১০ বছর বয়স থেকে গাছটিতে ফল পাওয়া শুরু করি। মাতৃ-গাছগুলো বীজের হওয়ায় ফল আসতে কিছুটা দেরী হয়েছে বলেও জানান তিনি।
কৃষকরা কিভাবে এই ফল গাছটি পেতে পারে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগামী বছর থেকেই চারাগাছ কৃষককে দিতে পারবো, সেটির জন্য আমরা কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। ফলের বীজ অনেকটা ছোট বলে বীজ থেকে চারাগাছ তৈরি করা কিছুটা সময় সাপেক্ষ। দ্রুত বিস্তারের জন্য আমরা অঙ্গজ প্রজননের মাধ্যমে চারা গাছ তৈরি করবো। এতে চারাগাছ রোপণের পরবর্তী বছর থেকেই ফল ধরবে। এমনকি ২-৩ বছরের মধ্যে গাছটিতে ব্যাপকভাবে ফল ধরবে।’
বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘জার্মপ্লাজম সেন্টারটিতে চাষাবাদ করা এই ল্যাংস্যাট ফলটি আমি খেয়েছি। আসলেই অনন্য স্বাদের ও পুষ্টিগুণে ভরপুর এই ফল। বরাবরের মতো বাকৃবি বাংলাদেশের মানুষকে নতুন আরেকটি বিদেশী আরেকটি ফল উপহার দিতে যাচ্ছে, সেটা আমাদের জন্যই একটা খুশির খবর। অতীতের মতো এটির বাণিজ্যিক চাষাবাদ ও কৃষকের কাছে ছড়িয়ে দিতে আমরা সকলের সহযোগিতা কামনা করছি।’