এগ্রিলাইফ২৪ ডটকম: ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার (ডিপিআই) এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এর সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ডিজিটাল বৈষম্যহীন বিশ্ব গড়ার প্রত্যয়ে বাংলাদেশ। এলক্ষ্যে বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ-এর সহযোগিতায় ও এসপায়ার টু ইনোভেট-এটুআই এর উদ্যোগে রাজধানীর একটি হোটেলে ‘ডিপিআই অ্যান্ড এআই ফর জিরো ডিজিটাল ডিভাইড’ শীর্ষক দুই-দিনব্যাপী (৩০-৩১ অক্টোবর) এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে।
আজ সোমবার (৩০ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক এই সম্মেলন উদ্বোধন করেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান, এমপি। সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন আইসিটি বিভাগ-এর প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক, এমপি।
পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান, এমপি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। ২০৪১ সালের মধ্যে দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ডিজিটাল বিভাজন কমিয়ে আনা প্রয়োজন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ পুরো দেশের মানুষকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণে একটি ওপেন প্ল্যাটফর্ম অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। এই অবকাঠামোর নাম ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার (ডিপিআই)। দেশের প্রেক্ষাপটে ডিপিআই কোনো স্বপ্ন নয়, বরং একে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জুডিশিয়ারিসহ সকল খাতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণে সহজ, পরিমাপযোগ্য ও টেকসই সমাধানসমূহ দুর্বল ও প্রান্তিকদের উন্নয়নের গল্পে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম করে তুলবে।
দেশের সমৃদ্ধ ও টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে ডিপিআই ও এআইয়ের সর্বোত্তম ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার বিষয় উল্লেখ করেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক, এমপি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে গত ১৫ বছরে আমরা ‘বটম আপ অ্যাপ্রোচে’ প্রান্তিক জনগণের জন্য ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দিয়েছি। প্রায় ৯ হাজার ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে নাগরিক সেবা পৌঁছে দিয়েছি। এই সেন্টারগুলোর উদ্যোক্তাদের মধ্যে বড় অংশ হচ্ছেন নারীরা। শ্রমশক্তিতে তাদের অংশগ্রহণের ব্যবধান হ্রাস করে এবং নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি বৃহত্তর ভূমিকার জন্য সক্ষম করে তোলার মাধ্যমে লিঙ্গভিত্তিক ডিজিটাল বিভাজনের ব্যাপারে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করার জন্য কাজ করছি।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ইতোমধ্যে ডিপিআইয়ের তিন স্তর নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ। এগুলো হলো- ডিজিটাল পরিচয়, ডিজিটাল পেমেন্ট ও ডাটা বিনিময়। দেশের ৯৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যাকে আওতাভুক্ত করেছে আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবস্থা। জন্মনিবন্ধন আইডির মতো ইউনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বীকৃতির পাশাপাশি যাবতীয় সেবা গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমরা এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পথে এগিয়ে চলেছি। এদিকে ডিজিটাল জিটুপি পেমেন্ট প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এক কোটির বেশি মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তার ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। অন্যদিকে সরকার ডাটা সিস্টেম উন্নয়নে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় করছে, যা সামাজিক নিরাপত্তা পেমেন্ট নিশ্চিত করছে এবং এসডিজি লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে ২০৩০ সালের মধ্যে একটি টেকসই স্যানিটেশন এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
দুই-দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ডিপিআই ও এআই নির্ভর আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সেক্টরভিত্তিক ১৪টি বিশেষ সেশনের আয়োজন করা হয়েছে। গাম্বিয়া, সাও টোমে এবং প্রিন্সিপসহ বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীসহ দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা উক্ত সেশনগুলোতে অংশগ্রহণ করেন। ডিজিটাল প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ এবং প্রযুক্তিনির্ভর সেবার চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্টাকচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। একই সাথে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী ডিপিআই ও এআই-এর সম্ভাবনা নিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা, সরকারি-বেসরকারি খাতের উচ্চ-পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করার পাশাপাশি ডিজিটাল অভিগম্যতার সাথে ডিপিআই এর রূপান্তর, দায়িত্বশীল এআই-এর জন্য টেকনোলজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক, ডাটা সিকিউরিটি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা, জিরো ডিজিটাল ডিভাইড এর জন্য বৈশ্বিক সমন্বয় এই সম্মেলনের লক্ষ্য। সম্মেলনে ডিপিআই ব্যবস্থা নির্মাণের মাধ্যমে ঝুঁকি কমিয়ে এনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বয়ে আনার বিষয়ে আলোচনা করেন বিশেষজ্ঞরা।
স্মার্ট রাষ্ট্র বিনির্মাণে ডিপিআই কীভাবে অবদান রাখতে পারে, সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয় এসব সেশনে। সেশনগুলোতে আলোচকরা ডিজিটাল ইকোনমিতে ডিপিআইয়ের গুরুত্ব বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। এছাড়া ওপেন প্লাটফর্মের মাধ্যমে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জুডিশিয়ারি, ফিনটেক প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি শেয়ার, পলিসি, সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং বহুপাক্ষিক ও বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানে প্ল্যাটফর্ম তৈরির বিষয়ে আলোচনা হয়।
সম্মেলনের প্রথম দিনে ডিপিআই ও এআই-ভিত্তিক আন্তঃদেশীয় ই-কমার্স খাত সম্প্রসারণ, অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও সাম্যতা বজায় রাখা, প্রান্তিক পর্যায়ে নাগরিকদের কাছে সরকারি সেবা পৌঁছে দেয়া, সমৃদ্ধ আগামীর শিক্ষা নিশ্চিত করা, ডিজিটাল স্বাস্থ্য বাস্তবায়ন, সবুজায়ন ও টেকসই বিশ্ব তৈরিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন, বণ্টন এবং ভোগের নকশা উন্নয়ন, নারীর নেতৃত্ব দক্ষতা বাড়িয়ে ডিজিটাল বৈষম্য কমিয়ে আনা, প্রতিবন্ধী নাগরিকদের ডিজিটাল প্রবেশগম্যতা নিশ্চিতের বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইসিটি বিভাগের সচিব মো: সামসুল আরেফিন। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-এর সিনিয়র সহ-সভাপতি সামিরা জুবেরী হিমিকার সঞ্চালনায় জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের প্রযুক্তি বিষয়ক দূত আমানদীপ সিং গিল বিশ্বে জিরো ডিজিটাল ডিভাইড কাজ করার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেন।
এসময় ‘প্রযুক্তি কেন মানুষের জন্য’ এবিষয়ে আলোচনা করেন গুগল-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. ভিন্ট সার্ফ এবং পিপল-সেন্টার্ড ইন্টারনেট-এর চেয়ারম্যান মেই লিন ফাং এবং ইন্টারনেটে ইন্টারওপারেবল সফটওয়্যার লেয়ার গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা করেন ইনফোসিস লিমিটেডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান নন্দন নিলেকানি। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ডিপিআই এর অবদান নিয়ে আলোচনা করেন হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড এভস এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডিপিআই এর সম্ভাবনার চিত্র তুলে ধরেন এটুআই এর পলিসি অ্যাডভাইজর আনীর চৌধুরী। ডিপিআই এর দক্ষতা এবং ইন্টারঅপারেবিলিটি নিয়ে আলোচনা করেন এস্তোনিয়া সরকারের সাবেক সরকারি সিআইও সিম সিকুট।
সম্মেলন উদ্বোধনের পরে ডিজিটাল বৈষম্য কমিয়ে এনে টেকসই বিশ্ব গড়তে এআই এর অবদান নিয়ে মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এসময় স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইসিটি বিভাগ এর অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নাভিদ শফিউল্লাহ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা নিয়ে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক, এমপি এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন-এর অধ্যাপক এবং যুক্তরাজ্যের নেস্তা’র সাবেক প্রধান নির্বাহী স্যার জিওফ মুলগান। এটুআই এর পলিসি অ্যাডভাইজর আনীর চৌধুরীর সঞ্চালনায় একটি প্যানেল আলোচনায় আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং গাম্বিয়ার কমিউনিকেশনস ও ডিজিটাল ইকোনমি মন্ত্রী ওসমান উক্ত সম্মেলনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডিপিআই এর মাধ্যমে ডিজিটাল ডিভাইডের বিষয় তুলে ধরেন। আলোচনায় গাম্বিয়া, সাও টোমে এবং প্রিন্সিপসহ বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীরা বক্তব্য তুলে ধরেন। এসময় ডিজিটাল বৈষম্যহীন ও টেকসই বিশ্ব গড়ার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এর সর্বোত্তম ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
এসময় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি খাতের নেতৃবৃন্দ, একাডেমিয়া, উদ্যোক্তা এবং দেশ-বিদেশের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞসহ তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগ এবং এটুআই-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৮তম অধিবেশনের সাইড ইভেন্টে ডিজিটাল বৈষম্যহীন বিশ্ব গড়তে ‘ই-কোয়ালিটি সেন্টার ফর জিরো ডিজিটাল ডিভাইড’ উদ্বোধন করা হয়। এর পটভূমিতে বৈশ্বিক গুরুত্বের ওপর ভিত্তি করে এই সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে।