ড. এম. মনির উদ্দিন:সুমি আর শামিমা বগুড়া জেলার অন্তর্গত শিবগঞ্জ উপজেলার গড়িয়ার পাড়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের দুই বোন। দেশে বর্তমানে যেখানে শিক্ষার হার ৭৫ শতাংশ সে মুহুর্তে শিক্ষার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে এই গড়িয়ার পাড়া গ্রাম। শামিমা বড় আর সুমি ছোট। দরিদ্র বাবা সেকেন্দার আলী যিনি পেশায় একজন রাজমিস্ত্রী। গ্রাম এলাকায় রাজমিস্ত্রীর কাজের কোন সুযোগ না থাকায় বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে কাজ করতেন। সংসারে স্বাভাবিকভাবেই অভাব আর অস্বচ্ছলতা সব সময় ভর করে থাকতো। দরিদ্র বাবা কষ্টের মধ্যেও মেয়েদের আগ্রহের কারনে স্কুলে ভর্তি করান। শামিমা যখন ১০ম শ্রেনীর ছাত্রী তখনই সমস্যাটা ঘটে যায়। বড়বোন শামিমার বিয়ে হয়ে যায় মাত্র ১৫ বছর বয়সে। বন্ধ হয়ে যায় এক বোন শামিমার পড়ালেখা। স্কুলে যেতে থাকে সুমি। ২০১১ সালে এস.এস.সি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে ফেলে সুমি।
এরপর অদম্য হয়ে যায় সুমি। যে কোনভাবেই হোক পড়ালেখা চালিয়ে যেতেই হবে। কলেজে ভর্তি হয় সুমি। পড়াশোনার খরচ যোগানোর জন্য সুমি স্কুলের ছেলেমেয়েদের পড়ানো শুরু করে। এভাবেই টিউশনির আয় দিয়ে চলে সুমির পড়ালেখা। এর মধ্যে সুমির বাবা সেকেন্দার আলী ভাগ্য বদলানোর জন্য চড়া সুদে ঋন নিয়ে সৌদি আরব যায় রাজমিস্ত্রীর কাজে। বাড়ীতে কিছু কিছু টাকা পাঠাতে থাকে যা ঋনের টাকা শোধের জন্যও যথেষ্ট ছিল না। এভাবে বিদেশে ভালো করতে না পেরে ও দুর্ঘনায় পায়ের সমস্যা নিয়ে অনেকটা নিঃস্ব হয়ে দেশে ফেরত আসেন বাবা সেকেন্দার আলী।
২০১৩ সালে ভাল রেজাল্ট করে এইচ.এস.সি পাশ করে যায় সুমি। বিভিন্ন সময়ে সুমির বিয়ের প্রস্তাব আসে তবে মেয়ের ইচ্ছার কাছে হার মানে বাবা। আরো অদম্য হয়ে পড়ে সুমি। স্বপ্ন দেখে দেশের সেরা ’ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে’ পড়ার। কিন্তু ২০১৩-১৪ সেশনে ভর্তি পরীক্ষায় ভর্তির সুযোগ হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। মনের মাঝে হতাশা নিয়ে সুমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং সুমি ভাবে, তার স্বপ্ন কি অধরাই থেকে গেল। কিন্তু না, ২০১৪-১৫ সেশনে ভর্তি পরীক্ষায় সফল হয় সুমি, সুযোগ পেয়ে যায় ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যান বিভাগে ভর্তির।
ইতিমধ্যে সুমির বড় বোন শামিমা এক কিশোরী সন্তানের মা হয়ে স্বামীর বাড়ী থেকে বিতাড়িত হয়ে সন্তানকে নিয়ে চলে আসে বাবার বাড়িতে। সুমিদের সংসারে তখন আরো দুঃসময় ঘনিয়ে আসে। বাবার কর্মক্ষমতা বা আয় রোজগারও দিন দিন কমে আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই সুমি সহপাঠীদের সহযোগীতায় টিউশনি শুরু করে। টিউশনির টাকা দিয়ে শুধু সুমির পড়াশোনাই চলেনি, চলেছে সুমিদের সংসারও। এভাবে সুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৯ সালে তার গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে মার্স্টাসে ভর্তি হয়। সফলতার সাথে ২০২০ সালের মার্চে সুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকল্যান বিভাগে এম এস পাশ করে।
২০২০ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশে করোনা মহামারী শুরুর ঠিক কয়েকদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ত্যাগ করে সুমি তার বাড়িতে চলে আসে। সুমির ইচ্ছা ছিল ভাল একটি সরকারী চাকুরী করার। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারনে পরবর্তীতে সে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে বা চাকুরীর চেষ্টার জন্য ঢাকায় ফিরে যেতে পারেনি। করোনাকালীন সময়ে কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিন অতিবাহিত করায় বাড়ী থেকে চাকুরীর কোন চেষ্টাই করতে পারেনি সুমি। সুমি তার বোনকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় কাজের সন্ধান করে কিন্তু কোন কাজই জোটেনি সুমির বা তার বোনের। সুমি তার বোনসহ একটি দোকানে টেইলারিং এর কাজ করার চেষ্টা করে সেইসাথে থ্রি-পিস নিয়ে গ্রামে গ্রামে বিক্রিরও চেষ্টা চালায়। কিন্তু সেটিও ব্যর্থ হয়।
এ সময় ফেসবুকে ঢাকার ধানমন্ডিতে জনাব রাশিদ আলম নামক এক উদ্যোক্তা মাশরুম চাষের উপর প্রশিক্ষনের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেন যেটি চোখে পড়ে সুমির। দুই বোন চলে যায় প্রশিক্ষনে। প্রশিক্ষন নিয়ে বাড়ী ফিরে বোনকে নিয়ে মাশরুম চাষের কার্যক্রম শুরু করে। ফলনও ভালই ছিল কিন্তু অর্থের অভাবে সুমি মাশরুম উৎপাদন ও বাজার সম্প্রসানের কাজ করতে না পেরে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়।
মাশরুমের প্রশিক্ষনের সময় সুমি শুনেছিল যে, কেঁচো দিয়ে ভার্মিকম্পোস্ট সার তৈরী করা যায়। সুমির মনে পড়ে যায় হঠাৎ করেই সেই কথাটি। যেই কথা সেই কাজ। বৃষ্টির দিনে সুমি আর তার বোন বালতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাইরে। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসে অনেকগুলো কেঁচো (সাধারন দেশী কেঁচো)। তারপর, সুমি আশেপাশের বাড়ী থেকে নিয়ে আসে কিছু গোবর এবং সংগৃহীত কেঁচো ছেড়ে দেয় গোবরের মধ্যে। সুমি তখনও জানতো না যে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরী করার জন্য যে কেঁচো ব্যবহার করা হয় সেটা সাধারন কেঁচো নয়। কাজেই সে ভাল সার তৈরী করতে ব্যর্থ হয়। হাল না ছেড়ে এরপর সুমি স্থানীয় উপজেলা কৃষি অফিসে গিয়ে জানতে পারে, ভার্মিকম্পোস্ট তৈরী করতে যে কেঁচো ব্যবহার করা হয় তার নাম লাল কেঁচো এবং এর প্রজাতির নাম Eisenia foetida। এ সময় সুমি বাংলাদেশ ভার্মিকম্পোস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারন সম্পাদক বদরুল হায়দার ব্যাপারীর সহযোগীতা ও পরামর্শ পান।
সুমি কৃষি অফিস থেকে আরো জানতে পারে, বগুড়ার শেরপুর এলাকায় এক উদ্যোক্তার কাছে লাল কেঁচো পাওয়া যায় এবং ১ কেজি কেঁচোর মুল্য ১ হাজার টাকা। সুমি বাড়ী চলে আসে আর ভাবে কোথা থেকে এই টাকা পাবো? ভাবতে ভাবতে বাড়ীতে এসে বিস্তারিত বড় বোন শামিমাকে জানায়। শামিমা তার সংসার জীবনে তিল তিল করে জমানো ৮ হাজার টাকা সুমির হাতে তুলে দেয়। টাকা পেয়ে সুমি পরের দিন চলে যায় শেরপুরে এবং বাড়ীতে ফেরে ৮ কেজি লাল কেঁচো নিয়ে। নুতন স্বপ্ন বাধে সুমি আর শামিমা। শুরু হয় তাদের জীবন সংগ্রাম। আশেপাশের গৃহস্তবাড়ী থেকে বাকীতে প্রতি কেজি গোবর ১ টাকা দরে ক্রয় করে জমাতে থাকে এবং কেঁচোগুলো গোবরে ছেড়ে দেয়। সুমিদের বসতভিটা বড় না হওয়ায় বারান্দা এবং ঘরের রুমে চেম্বার তৈরী করে সেখানে লাল কেঁচো দিয়ে ভার্মিকম্পোস্ট সার উৎপাদন শুরু করে। তার বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন যিনি বর্তমানে সুমির সংগ্রামী জীবনের সাথে সহযোদ্ধা হিসেবে কাজ করছেন।
প্রথম ভার্মিকম্পোস্ট তৈরী করার পর সুমির সামনে নুতন চ্যালেঞ্জ চলে আসে। ভাবনায় পড়ে, তার উৎপাদিত ভার্মিকম্পোস্ট কিভাবে বা কোথায় বিক্রয় করবে? যেহেতু এমনিতেই পরিবারে আর্থিক সংকট, এমতাবস্থায় ভার্মিকম্পোস্ট সার বিক্রয় করার জন্য প্যাকেট বা বস্তা তৈরী করা একটি অসম্ভব বিষয়। তাই বাজার থেকে পলিথিন এবং ব্যবহার করা প্লাস্টিক ব্যাগ কিনে তার উৎপাদিত ভার্মিকম্পোস্ট সার ১ কজির ব্যাগ ও ২৫ কেজির বস্তায় প্যাকেট করে এবং গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের কাছে বিক্রির চেষ্টা চালায় কিন্তু কেউ তার সার কেনেনি।
দুঃচিন্তা নিয়ে সুমি যোগাযোগ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অফিসে। তারা এবং গেইন বাংলাদেশ এর সহযোগী পার্টনার প্রতিষ্ঠান; এগ্রিভেঞ্চার সুমিকে ফেসবুক আইডিতে ভার্মিকম্পোস্ট বিক্রির প্রচার চালাতে পরামর্শ দেয়। বাড়িতে এসে সুমি তার ভাগ্নিকে দিয়ে ফেসবুকে ভার্মিকম্পোস্ট বিক্রির জন্য যথারীতি প্রচার চালাতে থাকে এবং এভাবে তার ভার্মিকম্পোস্ট কিছু কিছু করে বিক্রি হতে থাকে। অনেকটাই আশার সঞ্চার হয় সুমির ও তার বোন শামিমার। কৃষি অফিসের সহায়তায় সুমির ভার্মিকম্পোস্ট সার বিক্রি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এবং সুমিও তার উৎপাদন আস্তে আস্তে বাড়াতে থাকে। কৃষি অফিসের পরামর্শে সুমি ট্রাইকোডারমা সংগ্রহ করে ট্রাইকো-কম্পোস্ট সারও তৈরী শুরু করে। বাড়ির জায়গাটি ছোট হওয়ায় সুমি তাদের বাস করা ঘরের রুমকেও ভার্মিকম্পোস্ট সার তৈরীর জন্য ব্যবহার করে।
বর্তমানে সুমি প্রতিমাসে ২.৫ টন ভার্মিকম্পোস্ট সার এবং ৬ টন ট্রাইকোকম্পোস্ট সার উৎপাদন করছে। সুমি প্রতি কেজি ভার্মিকম্পোস্ট ও ট্রাইকোকম্পোস্ট যথাক্রমে ১৫ টাকা ও ১২ টাকা দরে বিক্রয় করছে। মাঝে মাঝে কেঁচোও বিক্রয় হয় প্রতি কেজি ২ হাজার টাকায়। যে সুমি পোকামাকড় দেখলে চিৎকার করে উঠতো সেই সুমি আজ তার কেঁচো বন্ধুদের অতি যতেœর সাথে দেখভাল করছে। এই কেঁচোগুলোই যেন সুমির সংগ্রামী জীবনের চলার পথে একমাত্র সহযোদ্ধা। কেঁচো বন্ধুদের কারনেই সুমি তার পরিবারের মুখে আহার তুলে দিতে পারছে। সুমির এ পর্যন্ত আসতে স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা- এহেড সোশ্যাল অর্গানাইজেশন সুমিকে ২৫ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছে এবং স্ট্যান্ডার্ড ফিনিশ ওয়েল কোম্পানী বিনা সুদে কিছু টাকা দিয়েছে যা সুমি প্রতিমাসে কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধ করে যাচ্ছে।
সুমির কাছ থেকে জানা যায়, বর্তমানে সে যে পরিমান সার উৎপাদন করছে তার চেয়ে বেশী চাহিদা তৈরী হয়েছে কিন্তু জায়গার অভাবে সে তার উৎপাদন বাড়াতে পারছেনা। সুমির ভবিষ্যতে ইচ্ছে কি তা জানতে চাওয়া হলে জানায়, তার এলাকার দরিদ্র মহিলারা অনেক কষ্টে জীবন কাটায়। তাদের কথা ভেবে সুমি ইতিমধ্যে ’চেতনায়ন মহিলা সংঘ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছে যদিও অর্থের অভাবে সেটির রেজিস্ট্রেশন করেনি। তবে এই প্রতিষ্ঠানের ছায়াতলে স্থানীয় মহিলাদের নিয়ে সুমি সভা করে এবং নিজেদেরকে আয়মুলক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত করে নিজের পায়ে দাড়ানোর জন্য পরামর্শ প্রদান করে। সেইসাথে প্রতিটি সন্তানকে পড়ালেখা করানো এবং মেয়েদেরকে যাতে বাল্যবিবাহ না দেয় তার জন্য সচেতনতামুলক পরামর্শ দেয়।
এই সমস্ত দরিদ্র মহিলাদেরকে সে সংগঠিত করে তাদেরকে ভার্মিকম্পোস্ট ও ট্রাইকোকম্পোস্ট সার উৎপাদনের বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে তাদের মাধ্যমে এই সার উৎপাদন কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করবে। এর মাধ্যমে এলাকার দরিদ্র মহিলাদের কর্মসংস্থান হবে এবং তাদের সংসারের আয় রোজগার বাড়লে ছেলেমেয়েদেরকে ভালভাবে পড়াশোনা করাতে পারবে। সুমির ইচ্ছা, এভাবেই তার গ্রামের মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা আসবে এবং পর্যায়ক্রমে তার পুরো গ্রামটিই কম্পোস্ট ভিলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এই সার ব্যবহার করে দেশের কৃষক নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করবে, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পাবে, দেশের উন্নতি হবে।
কিছুদিন আগেই সুমি প্রথম ক্যাটাগরিতে জয়িতা পুরস্কারে ভুষিত হয়েছে। গেইন বাংলাদেশ এগ্রিভেঞ্চার নামক একটি স্ট্রার্ট আপ প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করছে এবং এগ্রিভেঞ্চার গেইন এর কর্মকর্তাদেরকে সুমির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এগ্রিভেঞ্চার সুমির তৈরী ভার্মিকম্পোস্ট বিক্রয়েও সহযোগীতা করছে এবং সুমির মাধ্যমে এই এলাকায় ভার্মিকম্পোস্ট প্রযুক্তির সম্প্রসারণ করে দরিদ্র মহিলাদের কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা করছে। যদি কোন দাতা প্রতিষ্ঠান, প্রাইভেট সেক্টর বা ব্যক্তি সুমির সহযোগীতায় এগিয়ে আসে তাহলে এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সুমির মাঝে যে অদম্য সাহস ও আগ্রহ দেখা যায়, এটি নিশ্চিত যে, সুমি অবশ্যই তার জীবন সংগ্রামে জয়ী হবে। ভবিষ্যতে সুমি একজন সফল ও প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তায় পরিনত হোক-এটিই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
লেখক: এগ্রোনমিস্ট ও কনসালট্যান্ট
গেইন বাংলাদেশ