কৃষিবিদ দীন মোহাম্মদ দীনু।। পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে আমাদের সবাইকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। মাছ অত্যন্ত পুষ্টিকর খাবার, ভালো আমিষ আমরা মাছ থেকে পাই। বর্তমান সরকারও এবিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। নিরাপদ মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে তা বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভূমিকা রাখবে। এতে দেশের অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি হবে।
"বাংলাদেশের মাছ ও মুরগির মূল্য শৃঙ্খলে খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধিকরণ" " শীর্ষক প্রদর্শনী ও প্রচার কর্মসূচি বৃহস্পতিবার (৯ মার্চ) দুপুর ১টায় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার রুপালি হ্যাচারিতে ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফোর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) ফিড দ্য ফিউচার ইনোভেশন ল্যাব ফর ফুড সেফটি (এফএসআইএল) প্রকল্পের অর্থায়নে ওই অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড লুৎফুল হাসান।
প্রকল্পের প্রধান গবেষক (বাংলাদেশ অংশের) এবং বাকৃবির কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান জানান, প্রকল্পটি ২০২১ সাল থেকে সাড়ে তিন বছর মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) একদল গবেষকের সমন্বয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এ প্রকল্পের যুক্তরাষ্ট্র অংশের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রফেসর ড. মদন মোহন দে।
প্রকল্পের প্রধান গবেষক (বাংলাদেশ অংশের) এবং বাকৃবির কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাকৃবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান, ফিশারিজ অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. আবুল মনসুর, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ড. মো. আনিসুর রহমান, ময়মনসিংহের মৎস্য বিভাগের উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম। এছাড়াও মাইক্রোবায়োলজি এন্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. কে. এইচ. এম নাজমুল হোসাইন নাজির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফাসহ রূপালি হ্যাচারির আশেপাশের মাছচাষীরা অংশ নেন।
এসময় রুই মাছ চাষাবাদে খাদ্য প্রস্তুত থেকে শুরু করে পোনা অবমুক্তকরণ, সময়ে সময়ে মাছের বৃদ্ধি ও ওজন নিরক্ষণ, নিয়মিত পুকুর পরিদর্শন, মাছ আহরণ ও বিক্রয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে সমস্ত কার্যাবলী সম্পাদন করা হয়েছে এবং ভবিষ্যৎ কর্ম পরিকল্পনাসমূহ কি হবে, সে সম্পর্কে আলোকপাত করেন অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান। হ্যাচারী প্রাঙ্গণে পরবর্তীতে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
অধ্যাপক ড. কে. এইচ. এম নাজমুল হোসাইন নাজির গবেষণাগারে করা রুইমাছের মাইক্রোবায়োলজিক্যাল ফলাফল তুলে ধরে বলেন, দেশের বাজারে মাছ নিয়ে ভুল ধারণা রয়েছে তা হলো বাজারের মাছ খারাপ বা মাছে দূষিত এবং ভারি ধাতুর উপস্থিতি বেশি। কিন্তু আমরা মুক্তাগাছা বাজারের মাছ এবং আমাদের প্রকল্পের রুপালি হ্যাচারিতে চাষকৃত মাছের ব্যাকটেরিয়া এবং ভারি ধাতুর (আর্সেনিক, লেড, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম) পরীক্ষা করি। ফলাফলে দেখা যায় সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে দুই জায়গার মাছেই ব্যাকটেরিয়া এবং ভারি ধাতুর পরিমাণ কম রয়েছে। তবে আমাদের প্রকল্পের হ্যাচারিতে চাষকৃত মাছে ভারি ধাতুর পরিমাণ বাজারের মাছের তুলনায় কম ছিলো। ময়মনসিংহের বাজারের মাছ নিরাপদ এটি এ গবেষণার ফলাফলে উঠে এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা বলেন, মাছ চাষের সকল কার্যক্রমে নারীদের ভূমিকা রয়েছে কিন্তু তাদের কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা নাই। নিরাপদ মাছ চাষে আরও অবদান রাখতে নারীদের একটি বড় সুযোগ রয়েছে। তবে তাদের সে সুযোগ করে দিতে হবে। নারীদের মতামতের গুরুত্ব দিবে হবে।
মাছ চাষী সৌরভ দাস জানান, আমরা অনেক ক্ষেত্রে সঠিক ও মানসম্মত পোনা নির্বাচনে ভুল করি। বছর শেষে অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন কম হয়। আমরা তো আসলে জানি না যে কোন খাবার মাছের জন্য ভালো। কেউ যদি বলে যে এই খাবার ভালো বা কারো যদি দেখি যে একটি খাবার ব্যবহার করে উৎপাদন বেড়েছে। তাহলে আমরা সেটি ব্যবহার করি। কিন্তু সেটি নিরাপদ কি না জানি না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলে আমরা নিরাপদ মাছের খাদ্য এবং মাছ পাবো।
প্রকল্পের প্রধান গবেষক (বাংলাদেশ অংশের) এবং বাকৃবির কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান এ প্রতিবেদককে জানান, প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিরাপদ খাদ্য, বিশেষ করে নিরাপদ মাছ ও মুরগি উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ভোগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জ্ঞানের পরিধি, তাদের মনোভাব ও বাস্তব জীবনে তা অনুশীলন করার মাত্রা কেমন তা জানা, সে অনুযায়ী বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার রুপরেখা প্রস্ততকরণ এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলকে কার্যকরী নীতিমালা প্রণয়নে উৎসাহিত করা।
এছাড়াও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎপাদিত অধিকতর নিরাপদ মৎস খাদ্য প্রয়োগের মাধ্যমে পাঙ্গাস, তেলাপিয়া ও রুই মাছ উৎপাদন করা এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় তা কতটুকু নিরাপদ তা নিরুপণ করা। একই সাথে প্রচলিত খাদ্য ব্যবস্থাপনায় চাষকৃত মাছসমূহ থেকে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় উৎপাদিত মাছ প্রাপ্তিতে ভোক্তাদের চাহিদা কেমন বা ভোক্তারা কত দাম প্রদান করতে ইচ্ছুক তা অকশন বা নিলাম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ণয় করা এবং নীতি নির্ধারক মহলে তা প্রকাশ করে নিরাপদ মাছ চাষের প্রসারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের স্বার্থে পরামর্শ প্রদান করাও এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ।
তিনি আরও জানান, এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রকল্প সংশ্লিষ্ট গবেষকবৃন্দ অধিকতর নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় ময়মনসিংহের ফুলপুরে দুটি পুকুরে তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস এবং মুক্তাগাছার একটি পুকুরে রুই মাষ চাষ করেছেন। স্থানীয় খাদ্য প্রস্তুতকারী একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মৎস্য বিজ্ঞানীদের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্য প্রস্তুত করা হয়েছে যেখানে কোন এন্টিবায়োটিক, হরমোন, বৃদ্ধি প্রবর্ধক কিংবা কোন ফিড এডিটিভস ব্যবহার করা হয়নি।
প্রকল্পের বিভিন্ন কর্মকান্ড যা ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে তা প্রদর্শনী ও প্রচারের উদ্দেশ্যে এ প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়, যেখানে নীতি নির্ধারণী কার্যে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন এমন ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে কৃষক পর্যায়ে অধিকতর নিরাপদ মাছ চাষে উৎসাহ প্রদানের স্বার্থে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ২০ এর অধিক মৎস্য উদ্যোক্তা ও চাষীকে।
অনুষ্ঠানে মৎস্যচাষী,সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা ও গবেষকগণ অংশ নেন।