লেখা ও ছবি: ফয়েজুর রহমান সৌখিন: মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন ফাল্গুন মাসে এখনো বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা হয়নি জমির পাকা ধান ঘরে তুলে জামাই বরণ আর বাড়ির আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত করে খাওয়াবেন কৃষক রুহুল মোল্লা। ধানের ফলনও বেশ ভালো হয়েছে এবার। তাই রুহুল মোল্লার চোখ মূখে যেন উচ্ছ্বলতার প্রতিচ্ছবি। জমির আইলে বসে বসে ভাবেন তাঁর মেয়ের ভবিষ্যতের কথা, আর ধান কেটে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পরের পরিকল্পনা। রাশেদ ঘরের বড় ছেলে তাকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন। এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে রাশেদ। বাবা তাঁর পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের টাকা ধার করে এনে রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন। কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টি কম হওয়ায় এবার ফসলি জমিতে ধানের ফলন ও ভালো তাই ধান বিক্রি করে সেই ধার পরিশোধ করবেন। ধান কে ঘিরে আমাদের কৃষক পরিবারগুলোতে এরকম হাজারো গল্প।
আমাদের গ্রামের প্রতিটি কৃষকের বাড়িতে এখন ধানকেন্দ্রিক ব্যস্ততা। পাকা ধান কাটা, মাড়াই-ঝাড়াই, শুকানো, সিদ্ধ করা, ঘরে তোলাসহ নানা কাজে ব্যস্ত কৃষান-কৃষাণীরা। সকাল হতেই কৃষক তাঁর জমির দিকে ছুটছে বাড়িতে গৃহিনীরা ব্যস্ত উঠান পরিস্কার করে শুকানো, সিদ্ধ করা ও সংরক্ষণের উপযুক্ত করতে। এ যেন এক উৎসব, নবান্নের উৎসব!! চারাপশে শুধু পাকা ধানের ঘ্রান। কেউ কেউ আবার উঠানের পাশে আম গাছের ছা্ওয়ায় বসে ধান তোলার কাজে ব্যাবহৃত পুরোনো ধামা, পইয়া, তাফাল, গোলা ঠিক করছে। আবার কারো বাড়ি ছেলে বুড়ো সবাই মিলে ভোর হতে তাফালে ধান সিদ্ধ করতে ব্যাস্ত। আর কারো কারো বাড়ির উঠানতো টইটুম্বুর হয়ে গেছে সোনালী ধানে।
কৃষকের ধান রোপন থেকে শুরু করে ঘরে তোলা পর্যন্ত সবকিছুতে বেশ ভালোভাবে লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। গরুর হালের পরিবর্তে এসেছে কলের লাঙ্গল। ধান রোপণ করা হচ্ছে রোপণ যন্ত্রে। আর কম্বাইন্ড হারভেস্টার যন্ত্রের মাধ্যমে ধান কেটে সঙ্গে সঙ্গে মাড়াই করে একেবারে খড়কুটো পরিষ্কার করে বস্তায় ভরছে। এতে কৃষকদের ধান তোলার সময়ের সাথে আর্থিকভাবেও সাশ্রয় হচ্ছে। তবে প্রযুক্তির কল্যানে হারিয়ে গিয়েছে গরুর-লাঙল আর মলনের ব্যবহার । কাচি দিয়ে ধান কাটা গরুর গাড়িতে ধান বাড়িতে এনে মলন এর মাধ্যমে ধান মাড়াই করার এসব এখন প্রাচীন প্রথা। এ প্রসঙ্গে কথা হয় টুঙ্গিপাড়ার কৃষক দুলহাস শেখ এর সঙ্গে। তিনি বলেন ”যুগ বদলাইছে এহন ধান কাটতি কিষান পাওয়া যায় না, আর পাইলেও অনেক টাকা কিষান এর দাম তাই আমাদেরও মেশিন ব্যবহার করতি হয়। ভালোই হইছে ধন্যবাদ সরকার কে আমাদের এসব মেশিন ব্যবহারের সুবিধা দেওয়ার জন্য।
একটা সময় আমাদের দেশে আউশ আমন বোরো এই তিন মওসুমে দেশি ধানই বেশি চাষ হত। বিজ্ঞানীদের প্রযুক্তির কল্যানে এখন ধানের নতুন নতুন উচ্চফলনশীল জাতের উদ্ভাবন ও ব্যবহার করার ফলে ফলন ও উৎপাদন দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষনা ইনস্টিটিউট ধান নিয়ে গবেষনা করে এখন পর্যন্ত উদ্ভাবন করেছে আউশ আমন বোরো এই তিন মওসুমে প্রায় ১১৩টি জাত। যেগুলোর ফলন দেশি জাতের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। ফলে অল্প জমিতে অধিক ফলন পাচ্ছেন কৃষকরা।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় ধান গবেষনা ইনস্টিটিউট, সিনিয়র লিয়াঁজো অফিসার, কৃষিবিদ মোঃ আব্দুল মোমিন এর সঙ্গে। তিনি জানান, বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ এবং আমাদের অর্থনীতিতে বড় একটা ভুমিকা রাখে আমাদের উৎপাদিত ধান তাই ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিতে আমাদের বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টা সব সময় বিদ্যমান। আগে আমাদের দেশের ৩৩ শতাংশের বিঘায় যেখানে ১৮ থেকে ২০ মন ধান পাওয়া যেত এখন সেখানে আমাদের ধান গবেষণা উদ্ভাবিত ধান (ব্রি ধান৮৯, ব্রি ধান৯২, ব্রি ধান১০২ এবং বঙ্গবন্ধু ধান১০০) চাষ করে বিঘায় ৩৩ মনেরও বেশি ধান উৎপাদন সম্ভব এবং যার ফলে আমাদের কৃষকরা খুশি। একটা সময় কায়িক পরিশ্রম বেশি হওয়ায় অনেকের অনীহা থাকতো কিন্তু এখন ফলন ভালো হওয়ায় এবং প্রযুক্তির কল্যানে আমাদের কৃষি কৃষক ভাইদের জন্য আর্শীবাদ হয়ে এসেছে।