"নিষিদ্ধ কার্বোফুরান"-হুমকিতে প্রকৃতি ও পরিবেশ

সমীরণ বিশ্বাস: কার্বোফুরানের বিষাক্ততা মানব স্বাস্থ্য ও আবাদযোগ্য জমির উর্বরতা উভয়ের জন্য ক্ষতিকর উল্লেখ করে ২০১৬ সালে তা নিষিদ্ধের আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। কার্বোফুরান নিষেদ্ধ করা ৮৮তম দেশ হয় বাংলাদেশ।গত জুনের পর কার্বোফুরান গ্রুপের নিবন্ধিত কীটনাশকের বিজ্ঞাপন প্রচারসহ নবায়ন, আমদানি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের আবদারে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা গেল ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বহু আগেই এ কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।

সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) শ্রেণী অনুযায়ী কার্বোফুরান টেকনিক্যাল এবং ফরমুলেশনের বিষাক্ততা মানুষসহ প্রাণীকূলের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় কার্বোফুরানের রেজিস্টার্ড প্রোডাক্টগুলোর নবায়ন, আমদানি ও ব্যবহার কার্যক্রম আগামী জুন পর্যন্ত চলমান থাকবে। এ সময়ের পর কোনোক্রমেই কার্বোফুরানের রেজিস্টার্ড প্রোডাক্টগুলোর বিজ্ঞাপন প্রচারসহ নবায়ন, আমদানি ও ব্যবহার করা যাবে না। বালাইনাশক আমদানি, উৎপাদন, পুনঃউৎপাদন, বিক্রয়, বিতরণ ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং এ সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক বিষয়ে বিধান প্রণয়নে ‘বালাইনাশক আইন-২০১৮’ এর ধারা ১৫, ১৮, ১৯, ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ধারা এবং ‘বালাইনাশক বিধিমালা, ১৯৮৫’ এ দেয়া ক্ষমতাবলে সরকার এ আদেশ জারি করেছে।

দানাদার কীটনাশক কার্বোফুরান প্রতিরোধক ও প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করে। অর্থাৎ পোকা লাগার আগে কার্বোফুরান ব্যবহার করলে পোকা লাগবে না এবং পোকা লাগার পর ব্যবহার করলে পোকা মারা যাবে। এটি মানবস্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। এর সংস্পর্শে আসলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারেন মানুষ। কার্বোফুরানের একটি দানা একটি পাখি মেরে ফেলতে পারে। পাখিরা প্রায়ই ভুল করে বীজের বদলে এ কীটনাশক খেয়ে মারা যায়। এরআগে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দানাদার এই কীটনাশক এতটাই ভয়ংকর, জমিতে একবার ব্যবহার করলে ৩০ দিন পর্যন্ত ফসলে থাকে এর বিষাক্ততা
কার্বোফুরান একটি দানাদার কীটনাশক।

সাধারণত ধান, গম, ভুট্টার মতো শস্যের পোকা দমনে এটি ব্যবহার করা হয়। কার্বোফুরানের কারণে কৃষক নিজে তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ই; একই সঙ্গে তা ভোক্তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বয়ে আনে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্লান্ট প্রটেকশন বিভাগের এক সূত্র বলছে, দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ৪২ হাজার টন বালাইনাশক ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্যে আট থেকে দশ হাজার টন হচ্ছে কার্বোফুরান-জাতীয়। দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত কীটনাশক এটি। কিন্তু যথাযথ নজরদারির অভাবে এখনো সারা দেশে প্রকাশ্যেই এই কীটনাশক বিক্রি হচ্ছে।

এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, গত মাসে মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, সুনামগঞ্জ, রাজবাড়ী, ঢাকা ও মানিকগঞ্জসহ ১০টি জেলার এক ডজন দোকানে কার্বোফুরান বিক্রি হতে দেখা গেছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি ই-কমার্স সাইটও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রকাশ্যে এই নিষিদ্ধ কীটনাশক বিক্রি করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২৫২টি প্রতিষ্ঠান কার্বোফুরান আমদানি, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিক্রি করে থাকে। কীটনাশক কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির (পিটাক) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ৩ হাজার ২৮৫ টন কার্বোফুরান মজুদ ছিল। যেসব কোম্পানির কাছে কার্বোফুরান আছে, তাদের গত ৩০ অক্টোবরের মধ্যে সব ধ্বংস করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল পিটাক। অন্যথায় কোম্পানিগুলোকে নিবন্ধন বাতিলসহ আইনি পদক্ষেপের মুখোমুখি হতে হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের থেকে জানা যায়, নিষিদ্ধ-পরবর্তী বিক্রি, তদারকি বা বন্ধ করতে কোথাও কোনো অভিযান চালানো হয়নি।

ক্যান্সারের জন্য দায়ী কার্বোফুরান:
মানুষের ক্যানসারের জন্য দায়ী বালাইনাশক কার্বোফুরানের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এক ধরনের লুকোচুরি খেলছে কৃষি মন্ত্রণালয় ও বালাইনাশক কারিগরি উপদেষ্টা কমিটি (পিটাক)। জুনের মধ্যেই বিষটির প্রয়োগ বন্ধে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও সময়সীমা আরও বাড়ানোর দাবি ব্যবসায়ীদের। ইতোমধ্যে সুপারিশও করেছে পিটাক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতি দ্রুত দেশ থেকে কার্বোফুরান নিশ্চিহ্ন না করা গেলে মাশুল গুণতে হবে সবাইকে। ধান, গম, টমেটা, ঢেঁড়স, আম, লিচু, বিশেষ করে আখে যেন পোকায় না ধরে; সেজন্য যেসব বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়; তার একটি বড় অংশ দখলে রয়েছে কার্বোফুরানের। তবে এমন সুফলের চরম মূল্য দিতে হয় প্রকৃতি ও পরিবেশকে। কারণ, এর ধারাবাহিক প্রয়োগে নষ্ট হয় মাটির গুণাগুণ। মরে যায় উপকারী অনুজীব। অন্যদিকে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে ঢুকে তৈরি করে ক্যানসার-হাঁপানির মতো জটিল রোগ্যব্যাধি। মানুষের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করে। শিশুর বিকলাঙ্গতা তৈরি করে। তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের করা সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগির এক-তৃতীয়াংশই কৃষক।

দূর্বল নজরদারি :
কার্বোফুরানের উৎপাদন, বিক্রয় ও ব্যবহার বন্ধ হলো কিনা, সেটা এখন কঠোর নজরদারি দরকার। কার্বোফুরান নিষিদ্ধ করেছে সরকার। কিন্তু যথাযথ নজরদারির অভাবে এখনো সারাদেশে বিক্রি হচ্ছে এই নিষিদ্ধ ঘাতক কীটনাশক ! বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ হৃদরোগ ও স্ট্রোকে মারা যায় এবং এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ খাদ্যে বিষক্রিয়া। এ ছাড়া কার্বোফুরানের ব্যবহার ফলে মাটির উর্বরতাও কমছে। এ অবস্থায় প্রাণী ও প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই কীটনাশকটি ব্যবহার বন্ধ করার বিকল্প নেই। নিষিদ্ধ ঘোষিত কার্বোফুরান এখনো যেসব এলাকায় বিক্রি হচ্ছে সেসব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান পরিচালনা করতে হবে। এর ব্যবহার বন্ধ না করা গেলে মানবদেহ ও প্রকৃতির ক্ষতি আরো বাড়বে।

লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।