ড. মোঃ মাহমুদুল হাসান খান: ২০৫০ সালে সম্ভাব্য ২০ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কৃষি উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার কাজ চলছে। দেশে একদিকে আবাদি জমি কমছে, বিপরীতে বাড়ছে জনসংখ্যা ও জলবায়ূ পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি। এই ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে চালের উৎপাদনশীলতা বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বাড়াতে হবে। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে।
বিশ্ববাজারে ও দেশের অভ্যান্তরে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার ফলে দিন দিন বাড়ছে সরিষার তেলের চাহিদা। একই সঙ্গে দাম ভালো পাওয়ায় লাভের মুখ দেখছেন চাষিরা। এছাড়া স্বল্প সময়ে চাষযোগ্য, উৎপাদন খরচ কম এবং লাভ বেশি হওয়ায় সাথী ফসল হিসেবে জমিতে সরিষা উৎপাদনে ঝুঁকেছেন চাষিরা। তৈলবীজ গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর গবেষণায় বলা হয়েছে, বারি-১৮ জাতের সরিষা বিঘাপ্রতি ফলন সাড়ে আট-নয় মণ। তাই প্রচলিত সরিষার চেয়ে তেলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় অন্তত দুই শতাংশ। প্রচলিত সরিষার ইউরেসিক এসিডের হার আড়াই শতাংশের উপরে থাকায় অনেকে ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষাকে পরিহার করেন। কিন্তু বারি-১৮ জাতের সরিষার তেলে ইউরেসিক এসিডের হার পয়েন্ট পাঁচ শতাংশের নীচে। এ কারণে এ তেল স্বাস্থ্যসম্মত। ফ্যাটি এসিডের হার কম থাকায় হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপের জন্যে মোটেই ক্ষতিকর নয়। এ সরিষা জাতকে সম্প্রসারিত করতে পারলে দেশে উপকারী ভোজ্যতেলের অপার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র তৈরী হবে।
তেল আমদানীতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের ক্ষেত্র হবে সংকুচিত। মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধির কারনে দেশে ভোজ্য তেলের চাহিদা বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। মাথাপিছু দৈনিক ৪০ গ্রাম ধরে ২০৩০ সালে ভোজ্য তেলের দেশীয় চাহিদা দাঁড়াবে প্রায় ২৮.০০ লাখ টন। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায় ভোজ্য তেল আমদানি করতে বাংলাদেশ সরকারকে প্রতি বছর ২০.০-২৫.০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয় (২০২৩)। তেলজাতীয় ফসলের দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানিব্যয় কমানো সম্ভব। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে তেল ফসলের উৎপাদন ২৮.০ লাখ টনে উন্নীত করা।
দ্যা অয়েল ওয়ার্ল্ড-২০২২, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব অনুযায়ী সর্বশেষ ২০২১ অর্থবছরে দেশে ১.৩৭ মিলিয়ন টন পামতেল, ০.৫২ মিলিয়ন টন সরিষা/ক্যানোলা এবং ২.৩৪ মিলিয়ন টন সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে যাতে ব্যয় হয় ৪১৩০ মিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৫ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এভাবে চলতে থাকলে ২০২৫ সাল নাগাদ মোট ভোজ্য তেলর কনজামশন চাহিদা দাড়াবে ৩.১৮ মিলিয়ন টন (পামতেল,সরিষা/ক্যানোলা,সয়াবিন)। বর্তমানে চাহিদা ২৪.০ লাখ টনের বিপরীতে দেশে ভোজ্য তেল উৎপাদন মাত্র ৩.০ লাখ টন, যা চাহিদার মাত্র ১২ শতাংশ। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ভোজ্য তেলের মধ্যে সরিষার তেলই প্রধান, যা দেশীয় ভোজ্যতেলের প্রায় ৩৬%। সয়াবিন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈলবীজ ফসল, যা বছরে প্রায় ১৪৫,০০০ টন উৎপাদিত হয় তবে এর পুরো পরিমাণ তেল নিষ্কাশন ছাড়াই পোল্ট্রি ফিড হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের মাথাপিছু ব্যবহার গত পাঁচ বছরে ২০ শতাংশ বেড়ে ২০২০ সালে ১৮.৪ (কেজি) এ পৌঁছেছে (২০১৬ সালে, ভোজ্যতেলের মাথাপিছু ব্যবহার ১৫.৩ কেজি)। ভোজ্যতেলের ব্যবহার চার বছরে ৩৯ শতাংশ বেড়ে ২০১৯ সালে ৩০.৮ লক্ষ টনে পৌঁছেছে যা ২০১৫ সালে ২২.২ লক্ষ টন ছিল। ভোজ্য তেলের অভ্যন্তরীণ বাজার: $২ বিলিয়নেরও বেশি (২৫টি স্থানীয় শোধনাগারের সম্মিলিত ক্ষমতা প্রায় ৫৫.৭ লক্ষ টন, যা বর্তমান প্রয়োজনের প্রায় দ্বিগুণ।
‘তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প’র মাধ্যমে জুন ২০২৫ পর্যন্ত সময়ে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৪০ ভাগ ভোজ্য তেল স্থানীয়ভাবেই উৎপাদনের কাজ করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। ভোজ্য তেল হিসেবে সরিষা তেলের চাহিদা বৃদ্ধি, অনুকূল আবহাওয়া, সরিষা আবাদে কৃষকের সচেতনতা বৃদ্ধি ও উচ্চফলনশীল জাতের সরিষা কৃষকপর্যায়ে সম্প্রসারিত হওয়ায় চলতি অর্থবছরে সরিষার উৎপাদনও প্রত্যাশার চেয়ে বেশি হবে। ভোজ্য তেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে বাংলাদেশে তেলজাতীয় ফসল সরিষা চাষের আওতায় জমির পরিমাণ বৃদ্ধিসহ উচ্চফলনশীল জাতের দ্রুত সম্প্রসারণ ও উৎপাদন কলাকৌশলে আধুনিক পদ্ধতির অনুসরণই একমাত্র উপায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৮.০ লাখ হেক্টর জমিতে তেলজাতীয় ফসল উৎপাদন হচ্ছে, যার বেশির ভাগই সরিষা। ভোজ্য তেলের আমদানি নির্ভরতা হ্রাস তথা দেশীয় উৎপাদন বাড়িয়ে চাহিদার ৪০ শতাংশ পূরণে প্রয়োজন প্রায় ২৪.০ লাখ হেক্টর জমি তেলজাতীয় ফসল বিশেষ করে সরিষাকে প্রাধান্য দিয়ে আবাদের আওতায় আনা প্রয়োজন। বাংলাদেশে ভোজ্য তেল হিসেবে সরিষাই প্রধান। এমতাবস্থায়, ভোজ্য তেলের আমদানিনির্ভরতা কমাতে দেশে সরিষার চাষের আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ানো, উচ্চফলনশীল জাতের সরিষা অন্তর্ভুক্তিই একমাত্র উপায়। উল্লেখ্য, ভোজ্য তেল হিসেবে সরিষার তেলে সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ ৩০ শতাংশের নিচে ও অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ ৫০ শতাংশের ওপরে এবং ওমেগা-৩, ওমেগা-৬ ও ওমেগা-৯ -এর অনুপাত ১:২:৬ বিদ্যমান, যা পুরোপুরি স্বাস্থ্যসম্মত ।
২০১৮ সালে উদ্ভাবিত জাত বারি সরিষা ১৮ এর গড় ফলন ২.০-২.৫ টন/হেক্টর, বীজে তেলের পরিমাণ ৪০-৪২%, জীবনকাল ৯৫-১০০ দিন। জাতটি বাংলাদেশে উদ্ভাবিত প্রথম ‘ক্যানোলা’ বৈশিষ্ট্রের। জীবনকাল কম হওয়ায় ধান ফসলের সাথে রিলে ফসল হিসাবে চাষ করার জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এ জাতের সরিষা গাছের উচ্চতা ৮৮-১২৬ সে.মি.। জাতটি বাংলাদেশে উদ্ভাবিত প্রথম ‘ক্যানোলা’ বৈশিষ্ট্যের। যেসব কৃষকেরা দীর্ঘমেয়াদী (৯৫-১০০দিন) সরিষার জাত ব্যবহার করতে চান, তারা ঝাঁঝমুক্ত বারি সরিষা-১৮ (ক্যানোলা জাত) ব্যবহার করতে পারেন যা রান্নার তেল হিসেবে ব্যবহার হয়। বারি সরিষা-১৮ জাতের তেলে ইরুসিক এসিডের পরিমাণ ১.০৬% যেখানে বর্তমান বাংলাদেশে চাষকৃত অন্যান্য উন্নত সরিষার জাতে ইরুসিক এসিডের পরিমাণ ৪০-৪৫%। পরিমাণ মত সার ও সেচ প্রয়োগে এ জাত ২.০-২.৫ টন /হেক্টর (৮-১০ কেজি/শতাংশ) পর্যন্ত ফলন দেয়। বারি সরিষা-১৪ চেয়ে বারি সরিষা-১৮ শতাংশে প্রায় ২ থেকে ৬ কেজি বেশি ফলন দিয়ে থাকে। বর্তমান দেশে প্রায় ৫.৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয় যা প্রায় ২ লক্ষ মেট্রিক টন তেল পাওয়া যায়। এদেশের কৃষকরা সাধারনত স্থানীয় জাতের সরিষার আবাদ করে থাকে যার হেক্টর প্রতি গড় ফলন মাত্র ৮৫০ কেজি বা প্রতি শতাংশে ৩.৫ কেজি।তাই নতুন জাত আবাদে কৃষক আর্থিক ভাবে লাভবান হয় ও খুব সহজে তাদের প্রচলিত ফসল ধারায় খাপ খাওয়াতে পারেন। বারি সরিষা-১৮ লবনাক্ত সহনশীল ৬-৮ ds/m মাত্রার লবনাক্ততা সহ্য করতে পারে যা দেশের দক্ষিনাঞ্চলে চাষ উপযোগী। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলেও ভালো ফলন পাওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়ায় কৃষকরা এ সরিষা চাষে লাভবান হবেন। প্রচলিত জাতের সরিষার স্থলে শুধু বারি উদ্ভাবিত সরিষার উল্লিখিত জাতসমূহ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে দেশের সরিষা উৎপাদন অনেকাংশেই বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। সরিষার মাঠে মৌ-বক্স স্থাপন করা হলে সরিষার ফলন আরো বৃদ্ধি পাবে একই সাথে এসব মৌ-বক্স থেকে লক্ষ টাকার মধুও পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশে প্রায় ২২.০ লাখ হেক্টর জমি আমন-পতিত-বোরো শস্য বিন্যাসের অন্তর্ভুক্ত (সূত্র : ডিএই)। স্বাভাবিক চাষাবাদ পদ্ধতিসহ শূন্যচাষ ও রিলে চাষ পদ্ধতিতে আবাদযোগ্য বিএআরআই উদ্ভাবিত বারি সরিষা-১৮ জাতের সরিষা শস্য বিন্যাসে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সাময়িক পতিত জমি সহজেই চাষের আওতায় আনা সম্ভব। এছাড়াও বারি সরিষা-১৮ আবাদ করে উল্লিখিত জমির অনেকটাই শস্যবিন্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে অতিরিক্ত সরিষার উৎপাদন করে দেশীয় চাহিদার অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব। এই জাত সমুহ দেশের প্রায় ১.৭ লাখ হেক্টর চরের পতিত জমিতে সরিষার আধুনিক ও প্রতিকূলতা সহনশীল জাতের সরিষা চাষের আওতায় এনে অতিরিক্ত প্রায় ২.২ লাখ টন সরিষা উৎপাদন করা সম্ভব। বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের সমুদ্র উপকূলসহ অনেক জমিই এক ফসলি এবং ওইসব জমির অধিকাংশেই দীর্ঘ জীবনকালের আমন ধান আবাদ হয়ে থাকে, ফলে আমন ধান সংগ্রহ করতে হয় ডিসেম্বর মাসে এবং আমন ধান সংগ্রহের পর সব জমি পতিত থাকে। নাবিতে বপনোপযোগী বিএআরআই উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ও রোগপ্রতিরোধী জাত সমুহ যেমন শূন্যচাষে বা প্রয়োজনে রিলে চাষ পদ্ধতিতে আবাদযোগ্য জাতগুলো সহজেই ওই এলাকায় সম্প্রসারণ করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী ও সঠিক দিকনির্দেশনায় কৃষিবান্ধব বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ এবং সুযোগ্য কৃষিমন্ত্রীর দক্ষ নেতৃত্বে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণে দেশের ভোজ্য তেলের আমদানি নির্ভরতা কমপক্ষে ৪০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অবশ্যই সম্ভব হবে। বিএআরআই এর বিজ্ঞানীগন পরিবর্তনশীল আবহাওয়া উপযোগী ও উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে যাহা উল্লেক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বারি উদ্ভাবিত সরিষার জাতগুলোর বীজের সহজলভ্যের জন্য প্রয়োজন সরকারি বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএডিসি ও বেসরকারি বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উন্নতজাতের মানসম্পন্ন বীজ পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন। একই সাথে কৃষি সম্প্রসারণ ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) মাধ্যমে সরিষা চাষে কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধকরণ, সরিষার সঠিক চাষাবাদ পদ্ধতি বিষয়ে কৃষক ভাইদের অবহিতকরণ ও মাঠপর্যায়ে মনিটর জোরদারকরণ ও যথাসময়ে বীজ সরবরাহের নিশ্চয়তা প্রদান।
লেখক: গবেষক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট