কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন:বাজারের সবচেয়ে জনপ্রিয় চালের ব্র্যান্ড নাম মিনিকেট। ঝকঝকে, ঝরঝরে অপেক্ষাকৃত সরু ও চিকন এই চালের দাম কিছুটা বেশি হলেও ক্রেতাদের প্রথম পছন্দ এই চাল। কিন্তু অবাক করার ব্যাপার হল পৃথিবীতে মিনিকেট নামে কোন ধানের জাতই নেই, অথচ বাজারের মিনিকেট চালের ব্যবসা চলছে রমরমা। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, যে ধানের অস্তিত্ব নেই সেই নামে এত চাল আসে কোথায় থেকে?
আসলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি মিনিকেট চাল আসে উত্তর বঙ্গের শস্যভান্ডারখ্যাত দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। এসব এলাকার এক শ্রেণির চাল কল মালিক আছেন যারা মোটা জাতের ধান থেকে উৎপাদিত চাল পলিশ করে মিনিকেট নামে ব্রান্ডিং করছে। কাটিং এবং পলিশ করার জন্য চালে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক যা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
আশার কথা হচ্ছে সম্প্রতি এ বিষয়টি সরকারের নীতি নির্ধারক মহলের বিবেচনায় এসেছে। গত সোমবার সরকারের খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এ বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, মিনিকেট জাতের কোনো ধান নেই অথচ অন্যজাতের ধানে উৎপাদিত চাল মিনিকেট নামে ব্রান্ডিং ও বাজারজাত করা হচ্ছে। অবশ্য দেশে ধান গবেষণার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বা ব্রি গত প্রায় তিন দশক ধরে এই নিয়ে ভোক্তা সচেতনতামূলক বিভিন্ন প্রচারণা চালিয়ে আসছে। দেরিতে হলেও সরকার এখন এই ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ভাবছে। সে জন্য বস্তার গায়ে ধানের নাম লেখা বাধ্যতামূলক করার কথা ঘোষণা দিয়েছে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯, ব্রি হাইব্রিড ধান ও কাজল লতা জাতের ধান ছেঁটে মিনিকেট বলে বস্তায় ভরে বিক্রি করা হচ্ছে। বাজারে এ চালের ব্যাপক চাহিদার জন্য ‘মিনিকেট’ নামে প্রতারণার ব্যবসা চলছে জমজমাট। তাহলে মিনিকেট নামটা আসলো কোথা থেকে? আসলে ‘১৯৯৫ সালে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ভারতের কৃষকদের মাঝে সে দেশের কৃষি বিভাগ নতুন জাতের চিকন ‘শতাব্দী’ ধানবীজ বিতরণ করে। মাঠপর্যায়ে চাষের জন্য কৃষকদের এ ধানবীজের সঙ্গে আরো কিছু কৃষি উপকরণসহ একটি মিনি প্যাকেট দেয়া হয়। ওই মিনি বা ছোট প্যাকেটটাকে বলা হতো ‘মিনি কিটস’। সেখান থেকেই ‘শতাব্দী’ ধানের নাম হয়ে যায় ‘মিনিকেট’। তবে নামের পেছনে ঘটনা যা-ই থাক, মিনিকেট নামে কোনো চালের জাত দেশে নেই এটাই বাস্তবতা। মোটা চালকে পলিশ করে মিনিকেট চাল বলে বিক্রি করা হচ্ছে দেশের বাজারে। খোঁজ নিয়ে মিনিকেট চাল বানানোর একটা যান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা গেছে। চলুন জেনে নেয়া যাক প্রক্রিয়াটি।
অটোরাইস মিলে এমন অতিবেগুনি রশ্মি রয়েছে যার ডিজিটাল সেন্সর চাল থেকে সকল কালো বা নষ্ট চাল, পাথর, ময়লা সরিয়ে ফেলে। তারপর এই চাল চলে যায় অটোমিলের বয়লার ইউনিটে সেখানে ৫টি ধাপে পলিশ করার মাধ্যমে মোটা চাল সাদা রং ধারণ করে। এর পর পলিশিং মেশিনে মোটা চাল কেটে চিকন করা হয়। আর চকচকে করার জন্য ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ক্যামিকেল ।
এক সময় বরিশালে বালামের সুনাম ছিল সারা ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে। কালের বিবর্তনে ফলন প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় বালামসহ সরু জাতের ধান চাষ ক্রমশ কমে যায়। তবে বাজারে সরু চালের সন্ধান করতে থাকেন ক্রেতারা। এই সুযোগে বাজারে কথিত মিনিকেটের আর্বিভাব ঘটান মিল বা চাল কল মালিকরা। ক্রেতারাও লুফে নেন এ সরু জাতের চাল। সুযোগ বুঝে একশ্রেণির মিলমালিক মাঝারি সরু ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান২৯ ও ব্রি ধান৩৯সহ বিভিন্ন ইনব্রিড ও হাইব্রিড জাতের ধান ছেঁটে মিনিকেট বলে বাজারজাত করতে শুরু করে। বর্তমানে সারাদেশে চিকন চাল বলতে এখন মিনিকেটকেই বোঝায়, যার দামও চড়া। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়ার খাজানগর, পাবনা, নওগাঁ প্রভৃতি স্থানের চালকল থেকে সারাদেশে কথিত মিনিকেট চালের সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, লাখ লাখ মন এই মিনিকেট চালের যোগান কোথা থেকে আসছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে আউশ, আমন ও বোরোর তিন মৌসুমে ধান আবাদ হয়েছে ১ কোটি ২০ লাখ ৯৫০ হেক্টরে। এর মধ্যে এ তিন মৌসুমে হাইব্রিড ধান আবাদ হচ্ছে প্রায় ১৩ লাখ ৬২ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ মোট আবাদি জমির মাত্র ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশকে হাইব্রিড ধানের চাষ হ্েচ্ছ। এর মধ্যে বোরোতে ১১ লাখ ৪ হাজার ৬৩০ হেক্টর, আমনে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৬০০ ও আউশে ৫৯ হাজার ১০০ হেক্টর। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে চালের বাজারে হাইব্রিড চাল দেখা যায় না। ভোক্তাদের মনে কী প্রশ্ন জাগে না এই হাইব্রিড ধান যায় কোথায়? এ থেকেই কথিত মিনিকেট তৈরি করা হচ্ছে না তো!
আড়তদাররা জানান, অটো রাইচমিল মালিকরা কথিত মিনিকেট বলে যে চাল সরবরাহ করছে তারাও মিনিকেট বলে তাই বাজারে বিক্রি করছেন। তবে এ নামে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত ও সরকার অনুমোদিত কোনো জাতের ধান নেই তারাও বিষয়টি জানেন। বিভিন্ন ধরনের হাইব্রিড জাত- কল্যানী, তেজ গোল্ড, রত্না, বেড়ে রত্না, স্বর্ণা, গুটি স্বর্ণা, লাল স্বর্ণা, জাম্বু ও কাজল লতা জাতের ধান ছেঁটে মিনিকেট বলে বিক্রি করা হচ্ছে। বছর কয়েক আগে সুপার ফাস্ট নামে বোরো মৌসুমে চাষের জন্য ভারতীয় কৃষি বিভাগ একটি সরু জাতের ধান অবমুক্ত করে। এ ধানের চাল একশ্রেণির মিলমালিক সুপার মিনিকেট বলে এখন বাজারে বিক্রি করছে। এ চাল কথিত মিনিকেটের চেয়ে আরো বেশি চিকন। দেশব্যাপী মিনিকেট চালের নামে যে চালবাজি চলছে তা কেবল ক্রেতাদের মাঝে সচেতনতা বাড়লেই নিরসন সম্ভব।
লেখক: উর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর এবং পিএইচডি ফেলো, কৃষি সম্প্রসারণ ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ, শেকৃবি, ঢাকা।