খন্দকার তায়েফুর রহমান রিয়াদ: ‘ইতিহাসের মহানায়ক’ হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ সব কালে, সব যুগে জন্মগ্রহণ করেন না। যুগ-যুগান্তরের পরিক্রমায় হাতে গোনা দু-একজন মানুষই শুধু ‘ইতিহাসের মহানায়ক’ হয়ে উঠতে পারেন। ইতিহাস তার আপন তাগিদেই সৃষ্টি করে মহানায়কের। আর সেই ‘মহানায়ক’ই হয়ে ওঠেন তার কালের প্রধান কারিগর ও স্থপতি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তেমনই একজন কালজয়ী মহাপুরুষ, যিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। আবার সেই স্বপ্নের ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠাও করেছিলেন।
১৯৩৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সামনে সাহসী উপস্থাপনায় সহপাঠী ও বিদ্যালয়ের ন্যায্য দাবি আদায়ে নেতৃত্ব দিয়ে যিনি কিশোর ছাত্রনেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। ১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষে সহায়হীন মানুষের প্রাণ বাঁচান তিনি। ভাতের অভাবে কঙ্কালসার হয়ে চোখের সামনে অসংখ্য বাঙালির মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার দৃশ্য বঙ্গবন্ধুকে আত্মিকভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৪৬-এর দাঙ্গা প্রতিরোধে অগ্রণী যে কণ্ঠস্বর, ১৯৪৮ ও ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে আজ পর্যন্ত বাংলার প্রতিটি মানুষের প্রতিটি মুখের বুলিতে নতুন করে জন্ম নিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৩ অবহেলিত বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের একুশ দফা থেকে স্বাধীনতার সূর্য হয়ে তিনি জন্মেছেন। ১৯৫৮, ৬৬, ৬৯, ৭০, ৭১ এই যে ধারাবাহিক সংগ্রামের ইতিহাসে বাংলার মানুষের স্বাধীনতা-স্বাধিকারে বেঁচে থাকার প্রতিদিনের অনুপ্রেরণা হয়ে মিশে আছেন তিনি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি জান্তার ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা বাংলাকে ৭২ থেকে ৭৫-এর প্রতিটি দিনের পরিশ্রমে নতুন জীবন দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর ইস্পাতসম যে দৃঢ়তা ইতিহাস দেখেছে তার নেপথ্যের মূল বিষয় হলো: অপরের দুঃখ-কষ্ট তাকে সর্বদাই আবেগাল্পুত করত। এক জনসভায় বক্তৃতাকালে তিনি বলেছিলেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে আমি আর কী চাইতে পারি? আমি যখন ভাবি দূরে, জনশূন্য এক পথের ধারে আলো-ছায়ায় এক লোক লণ্ঠন হাতে দাঁডিয়ে আছে শুধু আমাকে একনজর দেখবে বলে, তখন মনে হয়, মানুষ হিসেবে আমার আর কী চাওয়া-পাওয়ার থাকতে পারে!’ ইনিই তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েও সরকারি বাসভবনে থাকতেন না। খুব সাধারণ ৩২ নম্বরের বাড়িটিতেই আমৃত্যু থেকেছেন। স্বাধীকার আন্দোলনের জন্য সমগ্র রাজনৈতিক জীবনকালে শেখ মুজিবুর রহমান যে ত্যাগ ও উৎসর্গের নজির রেখে গিয়েছেন, তা পৃথিবীর অন্য কোন নেতা করতে পারেনি। কিশোর বয়স থেকে নিয়ে আমরণ বঙ্গবন্ধু সর্বমোট ৪,৬৮২ দিন কারাবাস যাপন করেছেন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলার সুচারু পরিকল্পনা সম্পন্ন করেছিলেন।
'১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউজউইক পত্রিকা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাজনীতির কবি’ বলে আখ্যায়িত করে লিখেছিল, ‘তিনি লাখ লাখ মানুষকে আকর্ষণ করতে পারেন, সমাবেশে এবং আবেগময় বাগ্মিতায় তরঙ্গের পর তরঙ্গে তাদের সম্মোহিত করে রাখতে পারেন। তিনি রাজনীতির কবি।’ পুরো বিশ্ব তার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করেছে। বিশ্বব্যাপী তার মানবতার জয়গান অদ্যাবধি বিদ্যমান।
১৯৭৩ সালের ন্যাম সম্মেলনে কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্বকে হিমালয় পর্বতমালার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ২০০৪ সালে 'বিবিসি বাংলা' সারা বিশ্বের জরিপের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে নির্বাচিত করে। যার ফলে রোলমডেল হিসেবে তরুণদের মনে জায়গা পাওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার। ১৯৯০-এর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রচলন এবং ইন্টারনেট দুনিয়ার দরজাগুলো খুলতে শুরু করলে ইতিহাসের পুননির্মাণ সহজ হয়ে পড়ল। তরুণেরা বঙ্গবন্ধুকে পুনরাবিষ্কার করল। দেশ যতই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করল, তরুণেরা ইতিহাসের সত্য আর সংস্কৃতির সঞ্জীবনী শক্তির জন্য ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ল। ‘সত্য যে কঠিন,’ তারা জানল, কিন্তু সত্যকে ভালোবাসলও। বঙ্গবন্ধুকে আড়াল করে যেসব অসত্যের প্রচার চলছিল, সেগুলো তারা চিহ্নিত করল এবং বঙ্গবন্ধুর দুটি বই যখন বাজারে এল, তারা নতুনভাবে তাঁকে কাছে পেল।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের মত নৃশংস পারিবারিক হত্যাযজ্ঞের পরেও ঘাতকরা কি পেরেছিল বঙ্গবন্ধুকে বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে? সেদিন বঙ্গবন্ধুর শরীর থেকে যে রক্ত ওরা ঝরিয়েছে, সেই রক্তেই আবার নতুন করে জন্ম নিয়েছে হার না মানা বাংলাদেশ। ঘাতকের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দেহ থেকে রক্ত বাংলার অবারিত প্রকৃতি, প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে আরো তেজোময়ী হয়ে জেগে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন চিরকাল বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে, পথ দেখাবে। তরুণ প্রজন্ম অবচেতন মনে খুঁজতে থাকে মহত অনুকরণীয়, অনুসরণীয় বিশাল হৃদয়ের ব্যক্তিত্বকে।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ