সমীরণ বিশ্বাস: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বদলে যাচ্ছে রোগ-জীবাণুর ধরন। একদিকে সংক্রামক রোগগুলো যেমন নতুন মাত্রা লাভ করছে, তেমনি অসংক্রামক রোগের প্রকোপও বাড়ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিত্য নতুন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া উদ্ভবের সঙ্গে আবহাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে শরীরের নানান পদ্ধতির পরিবর্তন হয়। এসব পরিবর্তন আমাদের অসংক্রামক রোগ (ক্রনিক বা লাইফ স্টাইল ডিজিজ) বাড়িয়ে দেয়।
পরিবেশগত অবক্ষয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের প্রতিটি দেশের শিশু-কিশোরের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে। শোষণমূলক বিপণনের চর্চায় ফাস্টফুড, মিষ্টি পানীয়, অ্যালকোহল আর তামাকের অভ্যাস গড়ে উঠছে শিশুদের মধ্যে, যা সংকটে ফেলছে তাদের স্বাস্থ্যকে। জলবায়ু পরিবর্তন আর বাণিজ্য চাপের কারণে বিশ্বজুড়েই শিশুরা টিকে থাকার হুমকিতে রয়েছে। ঢাকার ৭০ শতাংশ বস্তিবাসী পরিবেশগত অভিবাসী যারা গৃহহারা হয়েছে। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সার্বজনীন সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি, শিশু বিবাহ ও শিশু শ্রম বন্ধ এবং ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূরীকরণের মতো বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক অর্জনগুলোকে হুমকির মুখে ফেলেছে জলবায়ু পরিবর্তন।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সামগ্রিক প্রভাব পরিমাপ করা একটি অত্যন্ত জটিল কাজ। বৈশ্বিক উষ্ণতা, ক্রমবর্ধমান তাপ এবং আবহাওয়ার তাৎক্ষণিক বিপদ থেকে দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য ও পানির ঘাটতি, বায়ু দূষণ এবং রোগের কারণে স্বাস্থ্যকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। ডব্লিউএইচও’র আশঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রভাবে ২০৩০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে দাবদাহের পাশাপাশি অপুষ্টি, ম্যালেরিয়া ও ডায়রিয়ায় প্রতিবছর আড়াই লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। গবেষকরা সতর্ক করেছেন যে, উষ্ণ তাপমাত্রা মশার মতো ভাইরাস বহনকারী প্রাণীকে নতুন এলাকায় ঠেলে দিচ্ছে, যা রোগের বিস্তার বাড়িয়ে দিচ্ছে। ল্যানসেট কাউন্টডাউনের প্রতিবেদন বলা হয়েছে, গত ৫০ বছরে ডেঙ্গু সংক্রমণের শঙ্কা ১২ শতাংশ বেড়েছে। উষ্ণ তাপমাত্রার কারণে আফ্রিকার কিছু অংশে ম্যালেরিয়া ১৪ শতাংশ বেড়েছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি এবং ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট ল্যাব সতর্ক করে বলছে, বিশ্বের কিছু অংশে উষ্ণতা- ক্যান্সারের চেয়েও মারাত্মক হতে পারে। যার কারণে ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী বাড়তে পারে মৃত্যুর হার।
ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট ল্যাবের হান্না হেস বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ভেক্টর-বাহিত রোগের মতো সম্ভাব্য হুমকি সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। অদূর ভবিষ্যতে শহরটিতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত মৃত্যু ক্যানসার থেকেও দ্বিগুণ হতে পারে। এ ধরনের অতিরিক্ত মৃত্যুকে ‘সোশ্যাল কস্ট অব কার্বনে’ অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দাবি উঠেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব হচ্ছে লবণাক্ত পানি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে। আমাদের খাদ্য চক্রেও লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে। লবণাক্ততা বাড়ার ফলে উচ্চ রক্তচাপ বাড়ছে, সেসঙ্গে বাড়ছে হৃদরোগের ঝুঁকি। পাশাপাশি বায়ুদূষণের ফলে আমাদের বিভিন্ন ধরনের বক্ষব্যাধি রোগের প্রকোপ বাড়ছে। নিশ্বাসের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ শরীরে প্রবেশ করছে। এসব ক্ষতিকর পদার্থ শরীর থেকে বের করতে কিডনি এবং লিভারের ওপর তৈরি হচ্ছে বাড়তি চাপ। এতে শরীরে টক্সিসিটি ইফেক্ট বেড়ে যাচ্ছে। দূষণের ফলে আমাদের মানসিক অশান্তিও বেড়ে যায়। এ কারণে দৈহিক, মানসিক ও সংক্রামক এবং অসংক্রামক সব রোগ শোকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাধারণত যেসব রোগ জীবাণু মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, সেগুলো ক্ষতিকর রূপে আবির্ভূত হচ্ছে। যে রোগগুলো অন্য কোনো পশু কিংবা প্রাণীর হওয়ার কথা, মানুষের হতো না, সেগুলো এখন পশু ও প্রাণী থেকে মানুষের হচ্ছে। অর্থাৎ আগে যে রোগগুলো বনে-বাদাড়ে সীমাবদ্ধ থাকতো, বন-বাদাড় পরিবেশ প্রকৃতি ধ্বংসের ফলে সেগুলো এখন মানুষের শরীরে সংক্রামিত হচ্ছে। যেমন করোনার মতো জুনোটিক ডিজিজ। পাশাপাশি এর ফলে জলজীবন, ভূমি জীবন, প্রাণী অথবা মানুষের জীবনের পরিপার্শিকতা ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মানুষের সুস্বাস্থ্য পরিবেশের সঙ্গে জীবনের যে ভারসাম্য তার ওপর নির্ভর করে। যখন সেই প্রতিবেশ এবং পরিবেশ বিপদাপন্ন হয়, তখন জীবনের সব কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন মানব স্বাস্থ্যের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি। আবহাওয়া, তাপমাত্রার উঠানামা, মাটি এবং পানিতে দূষণের ফলে রোগ জীবাণুর ধরন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো রোগ জীবাণুর পুনরাবির্ভাব হচ্ছে। বেশ কিছু রোগ জীবাণুর মিউটেশন হয়ে নতুন ধরনের মারাত্মক কিছু রোগ তৈরি হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে আমরা সেগুলোর ভয়াবহতা লক্ষ্য করেছি। ঘন ঘন এ ধরনের মহামারি দেখা দিচ্ছে, কোনোটা আবার অতি মহামারি রূপ লাভ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংক্রামক ব্যাধিগুলোর প্রভাব শুরু হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্যের কম্পোজিশনের পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। যেমন অতিরিক্ত লবণাক্ততা এবং সুপেয় পানির অভাব। এর সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ এবং অন্যান্য রোগের সম্পর্ক রয়েছে। খাদ্য উপাদানেও মারাত্মক পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। খাদ্যের পরিমাণ বাড়লেও পুষ্টিমান কমে যাচ্ছে। ফলে পুষ্টিগত অসুখগুলো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।
আবহাওয়ার কারণে মানুষের আচরণগত পরিবর্তন হচ্ছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে মানুষের ঘরে বসে থাকার প্রবণতা বেড়েছে এবং কায়িক শ্রমের প্রবণতা কমে গেছে। ফলে স্থুলতা বাড়ছে। স্থুলতার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় শরীরে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলছে। অসংক্রামক ব্যাধি যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসার, শ্বাসতন্ত্রের রোগের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। যত ধরনের রোগ অর্থাৎ সংক্রামক এবং অসংক্রামক কিংবা পুষ্টি গত ব্যাধি সব কিছুর মধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তন রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে রোগ-জীবাণুর পরিবর্তন হচ্ছে, প্রকৃতি এবং পরিবেশ পরিবর্তনে আমাদের খাদ্য উপাদান এবং অভ্যাসের পরিবর্তন হচ্ছে। সবকিছুর যোগফল স্বাস্থ্যগত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ! জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, পৃথিবীব্যাপী এখন যে উন্নয়নের নেশা চলছে, সেই উন্নয়নকে পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করে এমন যাবতীয় কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে। পরিবেশ প্রকৃতি ধ্বংস করে উন্নয়ন করলে, তাতে হিতে বিপরীত হবে এবং মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়বে।
লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, লিড-এগ্রিকালচারিস্ট, ঢাকা।