লোডশেডিং ও তাপপ্রবাহ- কৃষিতে আশঙ্কা !

সমীরণ বিশ্বাস: সারা দেশে এলাকাভিত্তিক ঘণ্টা পর ঘণ্টা থাকছে না বিদ্যুৎ। গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে বন্দর-শহর, বাসা-বাড়ি, হাটবাজার, শপিংমল কিংবা অফিস-আদালত সবখানেই চলছে লোডশেডিং। দেশজুড়ে শিডিউল অনুযায়ী শুরু হয়েছে ঘণ্টাব্যাপী লোডশেডিং। তবে আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে কৃষিবিভাগ। একদিকে লোডশেডিং, অন্যদিকে ভরা বর্ষায় খরায় পুড়ছে কৃষি জমি। সেচের জন্য বিশেষ সুবিধা চান কৃষকরা।

সারা দেশে লোডশেডিংয়ের প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কায় দেশের কৃষক। সরকারের এ সিদ্ধান্ত ভাবাচ্ছে কৃষি বিভাগকে। অন্যদিকে ডিজেলের দাম বাড়ায় শ্যালো মেশিনে সেচ দিতে হিমশিমে চাষিরা। এমন অবস্থায় মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে লোডশেডিং। এতে সেচ নিয়ে ব্যাপক দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা। তীব্র তাপদাহে বিদ্যুৎ এর ঘনঘন লোড শেডিং এবং সেচ কাজে পানি সংকট জনজীবন বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে। ফলে খেটে খাওয়া মানুষ সহ কেউই ঠিকমত কাজ করতে পাচ্ছেনা। তীব্র খরায় পুড়ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের উপজেলাগুলি। বেড়েছে ভ্যাপসা গরম। প্রচন্ড গরমে মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে অস্থিরতা। ঘনঘন লোড শেডিং ও টানা তাপদাহে জনজীবন দুর্বিষহ উঠেছে। রোজগারের আশায় প্রচন্ড গরম আবহাওয়া উপেক্ষা করেই তাদেরকে হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে যেতে হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় মটর স্থাপন করায় রিং কুয়া গুলোতে পানি শুকিয়ে গেছে বলে জানানগেছে। অপরদিক ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে ঠিকমত সেচ কাজ পরিচালনা করা যাচ্ছেনা। ফলে অনেক এলাকায় সেচ সংকটে আউশ ও আমন ধান উৎপাদন ব্যহত হতে পারে বলে অনেকে ধারনা করছেন। এতে ধান উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। খরার কারনে বাড়তি সেচ দিতে হচ্ছে। ঘনঘন লোড শেডিং এ সেচ কাজ চরম ব্যহত হচ্ছে বলে তারা জানান। ফলে আউষ ও আমন উৎপাদন ঠিক রাখতে পারবেন কিনা তা নিয়েও চিন্তিত তারা। তারা জানান, এ খরা আরো অব্যাহত থাকলে ধানের উৎপাদন কম হতে পারে। বৃষ্টি না থাকায় ঘনঘন সেচ দিতে হচ্ছে।

বৃষ্টির অভাবে এ মৌসুমে আম, কাঁঠালের মতো মৌসুমি ফলগুলোরও ক্ষতি করতে পারে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। আর বৃষ্টি না হলে এসব এলাকায় আউশ ও আমন আবাদসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদনে কিছুটা হলেও বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। লোডশেডিং-এর কারনে দেশের অগভীর হাজার হাজার ডিপ টিউবওয়েল অবিরামগতিতে চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কৃষি ,মৎস্য এবং পোল্ট্রি খাতে পড়তে শুরু করেছে লোডশেডিংয়ের প্রভাব।

লোডশেডিংয়ের প্রভাব কিছু প্রাথমিক উৎপাদকদের উপর মারাত্মক হতে পারে এবং এমনকি কৃষিকাজ বন্ধ করে দিতে পারে কৃষকরা । লোডশেডিং বগুড়ায় কৃষি যন্ত্রাংশ উৎপাদনে প্রভাব ফেলেছে। অব্যাহত লোডশেডিংয়ের কারণে সেচপাম্প বন্ধ থাকছে। খেতের মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পানি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ সময় জমিতে সেচ দিতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত ফসল উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না থাকায় এলাকার কৃষকেরা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন।

অনীদকে ক্রমাগত তাপপ্রবাহ কৃষিকে ফেলেছে ঝুঁকিতে ! ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ক্লাইমেট নলেজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রার ব্যাপ্তিটা হলো, ১৫ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই আমাদের দেশের ক্ষেত্রে কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটাকে মৃদু দাবদাহ বলে ধরা হয়। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে গেলে ধরা হয় মাঝারি দাবদাহ। আর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলে ধরা হয় তীব্র দাবদাহ চলছে। ঢাকায় বর্তমানে তীব্র দাবদাহের কাছাকাছি তাপমাত্রা রয়েছে। কোনো অঞ্চলে দুই দিন থেকে মাসখানেক সময় ধরে অতি অস্বাভাবিক গরম আবহাওয়া বিরাজ করলে সেটাকে দাবদাহ বলা যাবে। তীব্র এই গরম আবহাওয়াকে বলা হয় দাবদাহ বা তাপপ্রবাহ।

দাবদাহ প্রাণ-বৈচিত্র্যের তথা কৃষির জন্য ভালো কিছু নয়। এর ফলে ফসলের মারত্মক ক্ষতি হয়। অতিগরমে অসুস্থ হয়ে পৃথিবীজুড়ে প্রতিবছর মারা যান হাজারও মানুষ। দাবানলের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে দাবদাহ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী জুড়েই আবহাওয়া অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। তারপরও আগের মতোই জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াচ্ছি আমরা, উজাড় করছি বন, প্লাস্টিক ব্যবহার করছি প্রতিদিন। যার ফলে কৃষিতে তৈরি হয়েছে মারাত্মক হুমকি !

কৃষিতে একটা ইতিবাচক কিছু দেখা দিলে সাথে আরও তিনটা নেতিবাচক খবর এসে সামনে পড়ে। ফসল ভালো হলো তো বন্যা এসে ভাসিয়ে নিলো। কখনও অতিবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হলো। কিন্তু এবার নতুন করে এক শঙ্কার দেখা দিয়েছে। আর তা হলো তীব্র গরম বা দাবদাহ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভাষ্যমতে, এ তাপপ্রবাহ বজায় থাকতে পারে আরো কিছুদিন। প্রতি বছরই গ্রীষ্মের শুরুতে তীব্র দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে সারাদেশের ওপর দিয়ে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সামনের দিনগুলোয় প্রায় প্রতি বছরই এমন দীর্ঘায়িত খরা, দাবদাহ ও অনাবৃষ্টির মোকাবেলা করতে হবে বলে বিভিন্ন সময়ে বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসে উঠে এসেছে।

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কৃষি উৎপাদন ও খাদ্যনিরাপত্তায় আগামীতে বড়ো ধরনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ‘বাংলাদেশ সেক্টর অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি’ শিরোনামে মার্চে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনের বক্তব্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণেই জিডিপির ২ শতাংশ হারাবে বাংলাদেশ। এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে ফসলের রোগবালাই এবং পোকামাকড়ের আক্রমণও। এমনকি মোটামুটি সহনীয় মাত্রার জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে দেশে ধান উৎপাদন কমবে ১৭ শতাংশ। গরমের কারনে এর হার কমবে ৬১ শতাংশ। এ ফসলহানির প্রধানতম কারণ হবে দীর্ঘায়িত দাবদাহ ও খরা। পরিবেশে বাড়তি তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার কারণে কৃষি খাতে উৎপাদনের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে শ্রমিকের কর্মদক্ষতা। এছাড়া দেশের মৎস্যসম্পদের ওপরেও খরা, লবণাক্ততা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এসব সংকটকে আরো জটিল করে তুলবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও উন্নয়ন। সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে খাদ্যনিরাপত্তা, জীবিকা ও জীবন।

দেশের ফসল উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা ক্ষতি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। কিছুদিন আগেই দিনে ও রাতের তাপমাত্রায় ব্যাপক পার্থক্য থাকায় বিভিন্ন জেলায় ধানে ব্লাস্ট রোগের সংক্রমণ দেখা দেয়। এতে ফসলের কিছুটা বেশ ক্ষতি হয়েছে। আবার বর্তমানে দাপদাহের কারণে ধানের চিটাসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। নিয়মিতভাবে দৈনিক তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হওয়ায় ধানে ‘হিট শকে’র আশঙ্কা দেখছেন ধান গবেষকেরা। খরার মধ্যে আক্রান্ত জেলাগুলোর কৃষকরা এখন মারাত্মক বিপাকে পড়েছেন। তীব্র রোদে খেতে কাজ করতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে তাদের। বোরো ধান ও সবজি খেতে প্রতিদিনই সেচ দিতে হচ্ছে। এতে একদিকে কৃষকের সেচব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে চাপ পড়েছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর। ধানের শীষে দানা শক্ত না হওয়া পর্যন্ত জমিতে অবশ্যই ২-৩ ইঞ্চি পানি রাখতে হবে। এছাড়া ফল ও সবজির চারাকে তাপপ্রবাহের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য সেচ নিশ্চিত করতে হবে। খরা দীর্ঘায়িত হওয়ায় এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দিনে দিনে আরো নেমে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, তাপমাত্রা আরো বাড়তে পারে। কৃষি খাতে দাবদাহের প্রভাব মারাত্মক। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বেড়ে যাওয়া তাপমাত্রা সামনের দিনগুলোয় খরার মাত্রা বাড়াবে। একই সঙ্গে তা সেচের জন্য পানির প্রাপ্যতাকেও কমিয়ে দেবে। এতে কৃষক তিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি খাদ্যনিরাপত্তার সংকটও আরো বাড়বে।’

আমরা যেহেতু গরম কমাতে পারছি না, সেহেতু গরমসহিষ্ণু কৃষি ব্যবস্থার দিকে যেতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণসহিষ্ণু জাতগুলো দিয়ে চাষাবাদ করতে হবে। বরেন্দ্র অঞ্চলে আম-লিচুসহ বিভিন্ন ফসল চাষে গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষি জলবায়ুর ওপর নির্ভর করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া অসহিষ্ণু হবে। বৃষ্টির সময়- পরিবর্তন হবে। লবণাক্ততা বাড়বে। গত আষাঢ়-শ্রাবণে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম বৃষ্টি হয়েছে। আবার ভাদ্র-আশ্বিনে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বৃষ্টি হয়েছে। উপকূলীয় লবণাক্ততা বাড়ছে, তা আরো বাড়বে। হাওর অঞ্চলে বন্যা, দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলে বর্ষার শেষদিকে বৃষ্টি বেশি হওয়া, উত্তরবঙ্গে খরা, সার্বিকভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও এর কারণে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় প্রভাব ধীরে ধীরে দেখা যাবে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটগুলো ফসলের উপকারী পোকামাকড়ের অস্তিত্বকেও এখন হুমকির দিকে ঠেলে দিয়েছে। আবার এ সমস্যাকে আরো প্রকট করে তুলেছে কৃষিতে নির্বিচারে রাসায়নিক ও কীটনাশক প্রয়োগ। বাংলাদেশে যা তাপমাত্রা, তার চেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে, কারণ আর্দ্রতা অনেক কমে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ফলে এগুলোর প্রভাবও এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে, যার ব্যবস্থাপনাও অনেক কঠিন হয়ে পড়ছে। যার ব্যবস্থাপনাও অনেক কঠিন হয়ে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশ এককভাবে আসলে কিছু করতে পারবে না। বাংলাদেশের পক্ষে আগামী দিনে এককভাবে এই সমস্যা মোকাবেলা করা খুবই কঠিন সাধ্য হয়ে পড়বে।

লেখক: সমীরণ বিশ্বাস, লিড-এগ্রিকালচারিস্ট, ঢাকা।