লবণ সহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল সয়াবিনের জাত উদ্ভাবনে বশেমুরকৃবির সাফল্য

আব্দুল মান্নান, বশেমুরকৃবি: বিইউ সয়াবিন-৩ ও বিইউ সয়াবিন-৪ নামে সয়াবিনের দুটি লবনসহিষ্ণু বড় দানাদার বিশিষ্ট উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরকৃবি) এর কৃষিতত্ত্ব বিভাগ। তাইওয়ানের Asian Vegetable Research and Development Center (AVRDC/ World Vegetable Center), বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনষ্টিটিউট এবং দেশের নোয়াখালী ও লক্ষীপুর এলাকা থেকে প্রায় ২০০ জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে ২০০৫ সাল থেকেই বিভিন্ন আঙ্গিকে সয়াবিন নিয়ে গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছে বশেমুরকৃবির কৃষিতত্ত্ব বিভাগ।

উপকূলীয় অঞ্চলে লবনাক্ততা সয়াবিন উৎপাদনে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। এই প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে লবনাক্ত সহিষ্ণু জাত বের করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষিবিশ্ববিদ্যালয় ও জাপানের কিওটো বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌথভাবে নিবিড় গবেষনা শুরু করে। এ পর্যন্ত সয়াবিন উৎপাদনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ৬ জন পিএইচ.ডি ও ১৫ জন ছাত্র এম.এস ডিগ্রী অর্জন করেছেন। তারই ধারাবাহিক গবেষনায় দেখা গেছে যে, AVRDC থেকে সংগৃহীত AGS313 ও G00028 জার্মপ্লাজম দুটি উচ্চ ফলনের পাশাপাশি লবনাক্ততা, জলাবদ্ধতা ও খরা সহিষ্ণু।

জাত দুটি উদ্ভাবন টিমের প্রধান প্রফেসর ড. আব্দুল করিম জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে কৃষকপর্যায়ে এর সঠিকতা যাচাই করার জন্য নোয়াখালী, লক্ষীপুর ও ভোলা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিভিন্ন মাত্রার লবনাক্ত জমিতে জাত দুটির মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সম্পৃক্ত করে রবি ও খরিফ দুই মৌসুমেই চাষ করা হয়। দীর্ঘমেয়াদী এ গবেষনায় আর্থিক সহযোগিতা করেছে কৃষি গবেষনা ফাউন্ডেশন (কেজিএফ) ও বশেমুরকৃবি, এবং কৃষকের মাঠ পর্যায়ে গষেনায় বিভিন্ন আঙ্গিকে সহযোগীতা করেছে সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া নামে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের স্থানীয় কর্মকর্তাবৃন্দ। সংশ্লিষ্ট কৃষক ও গবেষকদের মতামতের ভিত্তিতে AGS313 ও G00028 জার্মপ্লাজম দুটি যথাক্রমে বিইউ সয়াবিন-৩ ও বিইউ সয়াবিন-৪ নামে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অনুবিভাগে নিবন্ধন করা হয়। বিভিন্ন উপজেলায় জাত দুটির গড় ফলন পাওয়া গিয়েছে ৩.২ মে: টন।

তিনি আরও বলেন, জাত দুটির উপযোগিতা যাচাইয়ের সময় দেশের বিদ্যমান অন্যান্য জাতগুলি ৫-৮ ডে.সি./মি: লবনাক্ততায় যেখানে হেক্টর প্রতি ২০০-৪০০ কেজি ফলন দিয়েছে, সেখানে উক্ত জাত দুটির সমপরিমান লবণাক্ততায় গড় ফলন ছিল ৮০০-১১০০ কেজি। বিইউ সয়াবিন-৩ ও বিইউ সয়াবিন-৪ জাত দুটির যথাক্রমে ১০০০-বীজের ওজন ২২০ ও ২২৫ গ্রাম যা বাংলাদেশের বিদ্যমান যে কোন জাতের চেয়ে বেশী, প্রোটিনের পরিমান ৪২ ও ৩৯%, তেল ১৯ ও ১৭%, ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড ১২.৬ ও ১১.৫ এবং ট্রিপসিন ইনহিবিটর ৩০.৩ ও ৪৩.৩৮ টিইউআই/ মি:গ্রা:।

বাংলাদেশে এখনও পশু ও মাছের খাদ্য হিসেবেই মুলত: সয়াবিন মিল ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তবে ইদানিং বিভিন্ন স্নাকস, সয়ামিট বল ও সয়ামিল্ক হিসেবে এর ব্যবহার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে meat of the field বা meat without bone বলা হয়। কারণ সয়াবিনে প্রোটিন বা আমিষের পরিমান (৩০-৫৫%), যা অন্যান্য যে কোন ফসল, যেমন ডাল, তেল কিংবা দানাদার শষ্যের তুলনায় অনেক বেশী। তাছাড়া সয়াবিনে ১৮-২০% তেল, ভিটামিন A, B, C ও K এবং পর্যাপ্ত পরিমানে খনিজ পদার্থ থাকে। এতে যথেষ্ট পরিমান isoflavines থাকে- যা এন্টিঅক্সিড্যান্ট হিসেবে ক্যান্সারের ঝুঁকি, উচ্চ রক্তচাপ ও LDL কোলেস্টারল কমানোসহ হৃদরোগ, মহিলাদের menopausal symptom, বিষন্নতা বা অবসাদ Type 2 diabetes, বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে শ্লথ করাসহ বহুবিধ রোগের প্রতিশেধক হিসেবে কাজ করে। এতে বিদ্যমান ভিটামিন K হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ উপযোগী। কাজেই বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক পুষ্টি সমস্যা সমাধানের জন্য সয়াবিনের ব্যবহার বৃদ্ধি একান্ত অবশ্যক।

উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে ২০১৪ সালে বশেমুরকৃবি এর কৃষিতত্ত্ব বিভাগ থেকে বিইউ সয়াবিন-১ নামে খর্বাকৃতি ও অপেক্ষাকৃত কম সময়ে পরিপক্ক (short duration) উচ্চ ফলনশীল এবং বিইউ সয়াবিন-২ নামে উচ্চ ফলনশীল, খরা ও জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে- যা কৃষক পর্যায়ে ব্যপকভাবে সমাদৃত। উপকুলীয় অঞ্চলের লবনাক্ত এলাকায় সয়াবিনের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নতুন জাত বিইউ সয়াবিন-৩ এবং বিইউ সয়াবিন-৪ বিশেষ ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবে।