সুজয় দাস: শিক্ষক দিবসে গলাচিপার শ্যামাকান্ত বিশ্বাস স্যারকে একটু স্মরণ করি! গলাচিপা হাই স্কুলের বিএসসিবিএড শিক্ষক ছিলেন শ্যামাকান্ত স্যার। বৃহৎ পরিসরে গণিত ও বিজ্ঞানকে আমি দেখতে শিখেছি শ্যামাকান্ত স্যারের হাত ধরেই। বিজ্ঞান ও দর্শনের মিথষ্ক্রিয়ার বিভিন্ন দিক তিনিই আমাকে প্রথম শিখিয়েছেন। বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে ও বিজ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে নিজের মনকে কিভাবে নির্মোহ বানাতে হয়, পার্সোনাল বায়াসকে কিভাবে মিনিমাইজ করতে হয়, রক্ষণশীলতা ও কূপমন্ডুকতার বিপরীতে বিজ্ঞানমনস্ক চেতনাকে কিভাবে সজীব-সতেজ রাখতে হয় তার প্রশিক্ষণও আমি আমার কৈশোরেই পেয়েছি শ্যামাকান্ত স্যারের কাছ থেকে।
ক্লাসের বইয়ের পড়াতো তিনি পড়াতেনই। কিন্তু ক্লাসের বইয়ের বাইরেও যে বিশাল-বিস্তৃত জগত আছে তার সন্ধান আমার শৈশব-কৈশোরে তিনিই আমাকে দিয়েছিলেন। চিন্তার চর্চা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা আর বিভিন্ন পার্সপেক্টিভে কোন জিনিসকে দেখার চর্চা জারি রাখার তাগিদ তার কাছ থেকে আমি পেয়েছি অসংখ্য-অজস্রবার।
শ্যামাকান্ত স্যার আমার শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগত পরিসরে আমরা ছিলাম দাদু-নাতি। স্যারের ছেলে-মেয়ে-পুত্রবধূরা সবাই আমার মামা-মাসি-মামী। সুতরাং, তাদের সাথে আমাদের ছিল পারিবারিক সম্পর্ক এবং তাদের বাসার দরজা আমার জন্য সবসময়ই ছিল খোলা। ফলে শ্যামাকান্ত স্যারের সাথে স্কুলের বাইরেও আমি মিশতে পারতাম অনায়াসে এবং মিশেছিও। আমার শৈশব-কৈশোরের বিরাট একটা সময় কেটেছে স্যারের সান্নিধ্যে। স্যার আমাকে হাতে ধরে ধরে শিখিয়েছেন এই মানব জীবনের বহু গভীর-গুরুত্বপূর্ণ পাঠ! এ আমার এক মহাসৌভাগ্য!
শ্যামাকান্ত স্যার যুক্তিবাদী, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, আধুনিকমনস্ক ও মুক্ত চিন্তার মানুষ ছিলেন। নানান রকম গোঁড়ামি আর পশ্চাদপদ চিন্তা আমৃত্যু তাকে ছুঁতে পারেনি। কী চমৎকার করে যে তিনি সবকিছুকে যুক্তির আলোয় ব্যাখ্যা করতেন! কী চমৎকার করে যে তিনি ছাত্রদের মনে জাগিয়ে দিতেন জ্ঞানের তৃষ্ণা! কী চমৎকার করে যে তিনি দিনের পর দিন উপকূলীয় এলাকায় জ্বালিয়ে গেছের জ্ঞানের দীপশিখা!
শ্যামাকান্ত স্যার গলাচিপা হাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু তার খ্যাতি এবং ব্যাপ্তি সমগ্র দক্ষিণ উপকূলজুড়ে! তিনি বরিশাল বিভাগের সেরা শিক্ষক হয়েছেন বেশ কয়েকবার। তার হাতে উপকূলীয় জনপদের অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীর মন আলোকিত হয়েছে জ্ঞান, যুক্তি, বুদ্ধি ও মুক্তির আলোয়। সারাটা জীবন তিনি কাটিয়েছেন উদারনৈতিক ও উচ্চতর চিন্তার একজন সুবাসিত মানুষ হিসেবে। গলাচিপা আর উপকূলবাসীও তাই তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে কখনো কুন্ঠিত হয়নি!
২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি তার মৃত্যুর সংবাদ যখন গলাচিপায় এসে পৌঁছায় তখন পুরো গলাচিপা একযোগে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল! গলাচিপা সেদিন হয়ে উঠেছিল গাঢ় শোকের জনপদ। গণমানুষের এমন ভালবাসা কয়জনেরইবা আর জোটে!
লেখক: Ph.D. Fellow at Bangladesh University of Engineering and Technology (BUET)