বকুল হাসান খান: ইঁদুর নিধন অভিযান চলবে ১১ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর/২৩ পর্যন্ত। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- জাতীয় সম্পদ রক্ষার্থে, ইঁদুর মারি একসাথে। ইঁদুর আমাদের যে ক্ষতি করছে তা অপূরণীয়। প্রায়ই দেখা সংবাদপত্রগুলোতে দেখা যাচ্ছে কৃষকের ফসল খেয়ে সাবার করে দিচ্ছে। আসুন এই শত্রæকে দমন করার কিছু কৌশল জেনে নেই। কোনো প্রকার বিষ বা বিষটোপ ব্যবহার না করে ইঁদুর দমন প্রচেষ্টা বহুদিন আগে থেকেই চলে আসছে এবং এখনো চলছে।
১.ইঁদুরের ফাঁদ ব্যবহার:- বিভিন্ন ধরণের ফাঁদের ভেতর টোপ হিসেবে শুটকি মাছ, নারকেল কোরা, বিস্কুট, রুটি ইত্যাদি যা ইঁদুরের কাছে লোভনীয় খাবার হিসেবে গণ্য বলে মনে হয় তা ব্যবহার করে ইঁদুর ধরা যায়, পরে এগুলোকে পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলতে হয়। তাছাড়া মাচা, ডুলি বা ঘরের অন্যান্য জায়গায় যেখানে ইঁদুরের আনাগোনা বেশি, সেখানেও ফাঁদ পাতা যেতে পারে।
২.আইল চিকন রাখা:- জমির আইল ছেঁটে ছোট বা চিকন করে রাখতে হবে, যাতে ইঁদুর জমির আইলে গর্ত করে বসবাস করতে পারে না।
৩. ইঁদুরের গর্তে পানি দিয়ে:- ইঁদুরের গর্তে পানি ঢেলে ইঁদুর দমন সম্ভব। গর্তে পানি দিলে ইঁদুর গর্ত থেকে বেরিয়ে আসবে, তখন একে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে।
৪. গর্ত খনন করে:- ইঁদুরের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়ে গর্তের মাটি খুঁড়ে ইঁদুর দমন করা যেতে পারে।
৫. গর্তে ধোঁয়া প্রয়োগ করা:- শুকনা মরিচ পোড়া ধোঁয়া গর্তে ঢুকিয়ে দিলে ইঁদুর গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে, তখন একে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে।
৬.সমকালীন চাষাবাদ:- মাঠে সবাই মিলে একসাথে ফসল রোপণ ও কেটে আনলে ইঁদুর দীর্ঘদিন মাঠে খাবার না পেয়ে পরোক্ষভাবে ইঁদুর দমনে সহায়ক হবে।
৭. পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা রেখে:-বাড়িঘর, গুদাম ও জমির আশপাশে আগাছা ও ঝোপ-জঙ্গল নির্মূল করে, বাড়িতে উচ্ছিষ্ট বা বাড়তি খাবার যত্রতত্র না ফেলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইঁদুুর দমন করা সম্ভব।
৮. প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে:- ঘরবাড়ি, খাদ্যগুদাম এবং দালান কোঠায় ধাতবপাত বা তারের জালি দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ইঁদুরের প্রবেশ বন্ধ করা যায়। এছাড়াও নারকেল, সুপারিসহ অন্যান্য ফল ফলাদির ইঁদুরের উপদ্রব হতে রেহাই পেতে হলে মাটি থেকে ২ মিটার উপরে গাছের খাড়া কান্ডের চারদিকে ৪৫ সেমি. প্রশস্ত টিনের পাত শক্ত করে আটকিয়ে দিলে ইঁদুর টিনের পাত টপকিয়ে উপরে উঠতে পারবে না।
৯. বৈদ্যুতিক বাধা সৃষ্টির মাধ্যম:- কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় তারের বেড়ার মধ্য দিয়ে স্বল্প বিদ্যুৎ প্রবাহিত করে ইদুর দমন সম্ভব।
১০. আঠা ব্যবহারের মাধ্যমে:- ইদুর ধরার জন্য গুদামে বা ঘরে এক প্রকার আঠা সাধারণত কাঠ বোর্ডে, শক্ত মোটা কাগজ, টিন, প্লাষ্টিক টাইলস এ প্রলেপ দিয়ে চলাচলের রাস্তায় ব্যবহার করা হয়। ইদুর খাবার খেতে এসে আঠার সংস্পর্শে এর পা, লোম আটকিয়ে যায়, ফলে নড়াচড়া করতে পারে না। এ ধরনের আঠা বাংলাদেশের বড় বড় দোকানগুলোতে পাওয়া যায়।
১১.ইঁদুর খাবার অভ্যাস করে: উপজাতীয়রা ইদুরের মাংস সুস্বাদু খাবার হিসেবে খেতে থাকে এতে ঐসব অঞ্চলে ইদুরের আগমন কম থাকে।
১২. ইঁদুরের লেজ সংগ্রহের মাধ্যমে:- সরকারীভাবে ইদুরের লেজের বিনিময়ে টাকা ও গম প্রদানের মাধ্যমে ইতিমধ্যে কয়েকবার আমাদের দেশে ইদুর দমন খুব সুফল পাওয়া গেছে।
১৩. ইঁদুর দমন কর্মসূচীর মাধ্যমে:- বছরে কমপক্ষে ২ বার (বর্ষাকালে ও শীতকালে) ইদুর দমন কর্মসূচী ঘোষণা করে কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর ইদুর দমনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
১৪. জৈব নিয়ন্ত্রণ বা পরভোজী প্রাণীর মাধ্যমে:- জীবিত কোনো প্রাণীকে অন্য কোনো জীবিত প্রাণীর দ্বারা নিয়ন্ত্রণকেই জৈব নিয়ন্ত্রণ বলে। ঈগল, পেঁচা, বনবিড়াল, শিয়াল, বেজি, সাপ, গুইশাপ ইত্যাদি প্রাণী প্রচুর ইদুর খেয়ে থাকে। এ সব উপকারী পরভোজী প্রাণীর মাধ্যমে ইদুরের সংখ্যা বহলাংশে কমানো যাবে।
এছাড়া রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইদুর ধ্বংস করা যায়। এ পদ্ধতিতে ইদুরকে দমনের জন্য দু’ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
১. তীব্র বিষ:- তীব্র বিষ খাওয়ার সাথে সাথে ইদুর মারা যায়। তীব্র বিষ হচ্ছে- জিঙ্ক ফসফাইড। তীব্র বিষ ব্যবহারের কিছু কিছু অসুবিধা আছে তা হচ্ছে, জিঙ্ক ফসফাইড দ্বারা তৈরীকৃত বিষটোপ ইদুর পরিমিত মাত্রায় খাওয়ার পূর্বে অল্প কিছুটা মুখে দিয়ে পরখ করে ও অসুস্থ হয়ে পড়ে কিন্তু মরে না। আবার পরিমিত মাত্রায় বিষটোপ খাওয়ার পর এক সাথে অনেকগুলো ইদুর যেতে দেখে যেসব ইদুর বিষটোপ খায়নি তাদের বিষটোপের প্রতি অনীহা লক্ষ করা যায়-একে ইদুরের বিষটোপ লাজুকতা বলে। কাজেই তীব্র বিষ ব্যবহার করে মাঠের বা ঘরের সব ইদুর দমন করা সম্ভব নয়।
২. দীর্ঘস্থায়ী বিষ:- দীর্ঘস্থায়ী বিষ খাওয়ার সাথে সাথে ইদুর মারা যায় না, ইদুর মারা যেতে ৫ থেকে ১৩ দিন সময় লাগে। দীর্ঘস্থায়ী বিষ দিয়ে তৈরীকৃত বিষটোপ ইদুর খাওয়ার পর ইদুরের রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়, ফলে ইদুরের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে ও ক্রমেই ইদুর দুর্বল হতে থাকে এবং ৫-১৩ দিনের মধ্যে ইদুর মারা যায়। দীর্ঘস্থায়ী বিষ প্রয়োগ করে অনেক ইদুর মারা সম্ভব। এছাড়া ইদুরের গর্তে বিষবাষ্প প্রয়োগ করেও ইদুরকে মারা যায়। যথা: সাইনোগ্যাস ফসটক্সিন ট্যাবলেট।
১। ঘরে অথবা গুদামে অথবা দোকানে যদি গর্ত থাকে তবে নুতন গর্তের সম্মুখে পাত্রে বিষটোপ প্রয়োগ করতে হবে। যদি গর্ত না থাকে তবে ইঁদুরের সম্ভাব্য উপস্থিতির স্থানগুলোতে বিষটোপ প্রয়োগ করতে হবে।
২। বিষটোপ একই পাত্রে একই স্থানে কমপক্ষে ৩-৪ রাত্র রাখতে হবে।
৩। গুদামে অথবা ঘরে ১০ হাত পর পর একটি বিষটোপ রাখতে হবে।
৪। মাঠে যতটি নতুন গর্ত রয়েছে প্রত্যেকটি গর্তের সম্মুখে এবং এ ছাড়া মাঝে মধ্যে বিষটোপ রাখতে হবে।
৫। বিষটোপ পাত্র হিসেবে নারকেলের খোলস, কলা গাছের খোলস, মাটির ছোট ছোট পাত্র, বাঁশ অথবা পাইপ ব্যবহার করা যেতে পারে।
৬। প্রতিটি পাত্রে ৫০-১০০ প্রাম বিষটোপ প্রয়োগ করতে হবে।
৭। বহুমাত্রা বিষটোপের ক্ষেত্রে যতদিন ইদুর খাওয়া বন্ধ না করে ততদিন পাত্রে বিষটোপ রাখতে হবে।
৮। ঘরবাড়ি, গুদাম অথবা দোকানে কমপক্ষে ২০-৩০ দিন অন্তর বিষটোপ প্রয়োগ করতে হবে (যদি ইদুরের উপস্থিতি থাকে)।
৯। জিঙ্ক ফসফাইড বিষটোপ ঘন ঘন ব্যবহার করা উচিত নয়।
১০। গুদামে অথবা শিল্প কারখানায় ইদুরের উপদ্রব থাকলে স্থায়ী কয়েকটি বিষটোপ পাত্র রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বহুমাত্রা বিষটোপ প্রয়োগ করতে হবে।
১১। আনারস বাগানে ফল ধরার সময় ১২ টি বিষটোপ পাত্র প্রতি একরে স্থাপন করতে হবে। প্রতি পাত্রে দীর্ঘমেয়াদি ৫০ গ্রাম করে বিষটোপ প্রয়োগ করতে হবে। বিষপাত্র ফল তোলার পূর্ব পর্যন্ত আনারস বাগানে রাখতে হবে।
১২। নারকেল গাছের মাথায় বিষটোপ ছোট পলিথিনে করে সুতা দিয়ে মুখ বেঁেধ রাখতে হবে।নারকেল বাগান হলে প্রত্যেক গাছে বিষটোপ প্রয়োগ না করে প্রতি ১০টি নারকেল গাছের জন্য একটি গাছে বিষটোপ মাসে একবার প্রয়োগ করতে হবে।
সাবধানতা
ইঁদুর মারার বিষ খুবই মারাতœক। বিষ প্রয়োগের সময় পানাহার বা ধূমপান থেকে বিরত থাকুন। কাজের শেষে হাত মুখ এবং শরীরের অনাবৃত অংশ ভালো করে ধুয়ে ফেলুন। সন্ধ্যায় দেয়া বিষটোপ কিছু থেকে গেলে সকালে উঠিয়ে রাখুন। বিষের খালি প্যাকেট অন্য কাজে ব্যবহার করবেন না। খালি প্যাকেট এবং মরা ইদুর মাটির বেশ নিচে নিরাপদ স্থানে পুঁতে ফেলুন।