কৃষিবিদ ডক্টর এস. এম. রাজিউর রহমান: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে পর্যাপ্ত পুষ্টি প্রাপ্যতা একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে (সংবিধানের ১৮:১ অনুচ্ছেদ) । এখন থেকে ৫২ বছর আগে জনগণের পুষ্টি উন্নয়নে রাষ্ট্রের এ ধরনের অঙ্গীকার বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নীতির প্রতিফলন।
কিন্তুু দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ মানুষের এখনো খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে ৬ লাখ শিশু। দেশের ৬ মাস বয়স থেকে ৫ বছরের বয়সের মধ্যে ৪৩ শতাংশ শিশু অ্যানেমিয়া বা রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৪ শতাংশ শিশু অপুষ্টির কারনে খাটো বা বেঁটে হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ২৩ শতাংশ শিশুর তুলনামুলকভাবে ওজন কম। এর কারণ হল দেশের অনেক শিশু সিভিয়ার অ্যাকিউট ম্যালনিউট্রিশন বা তীব্রতম অপুষ্টিতে ভুগছে। মহিলাদের এক তৃতীয়াংশের ওজন কম এবং ১৩ শতাংশ উচ্চতায় খাটো যাদের সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় নানা জটিলতা দেখা দেয় এবং কম ওজনের শিশুর জন্ম দেয়। দেশের প্রায় অর্ধেক নারী অ্যানেমিয়ায় ভুগছে যার মুল কারন অপুষ্টি। বিশেষ করে গত এক বছরে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির এ তীব্রতম মাত্রার প্রকোপ বেড়েছে অনেক বেশি ( ২০২১ সালে ৭২শতাংশ)। তাই মা ও শিশুর পুষ্টির দিকটি যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। বিগত সময়ে প্রাণীজ পুষ্টি গরিবের আমিষ খ্যাত ডিম এ ক্ষেত্রে গুররুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো কারণ ডিমে রয়েছে শরীরের প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি উপাদান।
পৃথিবীতে যত খাবার আছে, সেগুলোর মধ্যে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারগুলোর অন্যতম ডিম। ডিম স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। একটি ডিমে অ্যানার্জি থাকে ১৪৩ ক্যালোরি। আর কার্বোহাইড্রেট থাকে ০.৭২ গ্রাম মতো। প্রোটিন থাকে ১২.৫৬ গ্রাম, ফ্যাট থাকে ৯.৫১ গ্রাম। এছাড়া ফসফরাস থাকে ১৯৮ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ১৩৮ মিলিগ্রাম, জিঙ্ক থাকে ১.২৯ মিলিগ্রাম । ডিমের সাদা অংশে থাকে প্রোটিন ও কুসুমে থাকে ভালো ফ্যাট, আয়রন ও ভিটামিন। শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি, হাড় শক্ত করতে ও মেধার বিকাশে ডিম খুবই কার্যকর। নারী স্বাস্থ্যের উন্নতিতে জন্য প্রতিদিন ৫০-৬০ শতাংশ প্রোটিন দরকার হয়। যা ডিম থেকেই পাওয়া যায়। ডিমের কুসুমে রয়েছে এন্টিবডি যা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও বিভিন্ন জীবাণু ঘটিত রোগ প্রতিরোধ করে। ডিমে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
ডিমে প্রাপ্ত ভিটামিন-এ চোখের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং বার্ধক্য প্রক্রিয়া রোধ করে। ডিমে কোলেস্টেরল থাকলেও তা রক্তের কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে না। বরং রক্তের ভালো কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে (এইচ ডি এল)। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা বলেছেন; প্রতিদিন একটা করে ডিম খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। ডিমের বায়োলজিক্যাল ভেলু ৯৪% বা এর অধিক হওয়ায়, আমাদের অধিক সময় কর্মক্ষম রাখতে সহায়তা করে। ডিমের পুষ্টিমান শিশুদের মেধা বিকাশ, গর্ভবতী মহিলার পুষ্টি নিশ্চিত, হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখা, টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়, সর্বোপরি মানুষকে কর্মক্ষম রাখে। ডিমের কুসুমের কলিন মস্তিষ্কের কার্যকারিতা সঠিক রাখে ও স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। কুসুমের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট লুটিন এবং জেকসানথিন চোখের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তাই সম্পূর্ণকুসুমসহ প্রতিদিন একটি করে ডিম খাই, নিজেকে সুস্থ রাখি, তারুণ্য ধরে রাখি এবং মেধা সম্পন্ন প্রজন্ম তৈরি করি ।
প্রতিবছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার বিশ্ব ডিম দিবস পালিত হয়। তাই এবার ১৩ই অক্টোবর বিশ্ব ডিম দিবস পালিত হল। এ বছর এ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ছিল : ডিমে পুষ্টি, ডিমে শক্তি, ডিমে আছে রোগ মুক্তি।
স্লোগানটা শুনতে ভালো লাগলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে ডিমের বাজার ব্যবস্থাপনা ও এর উচ্চ মুল্যের কারনে সাধারণ মানুষের ডিম গ্রহণের মাত্রা কমে গেছে। ফলশ্রুতিতে জাতি দীর্ঘমেয়াদী পুষ্টি ঘাটতিতে পড়তে পারে যা মেধা সম্পন্ন সুস্থ প্রজন্ম তৈরিতে হুমকি হতে পারে। সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরীর যাত্রা বিলম্বিত হতে পারে। তাই ডিমকে সাকলের কাছে সহজলভ্য না করতে পারলে স্মার্ট সিটিজেন পাবোনা। ডিম দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়টি ডিম গ্রহণ ও উৎপাদনের সচেতনতা তৈরি করলেও, সাধারণ মানুষের কাছে ডিমের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করাই ডিম দিবসের প্রধান সুপারিশ হওয়া উচিত । তাই আমরা এই দিবসের মাধ্যমে সকলের কাছে ডিমকে সহজলভ্য করার জন্য কাজ করি, সকলের পুষ্টি নিশ্চিত করি, মেধা সম্পন্ন সুস্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরিতে ভূমিকা রাখি।
গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স রিপোর্ট ২০২২ অনুসারে, ১১২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৪তম; ২০২০ সালে যা ছিল ৭৫ তম। এটা স্পষ্টভাবে বলে যে, কোভিড-১৯ মহামারী অগ্রগতিকে বীপরিতমুখী করেছে। সেইসাথে ইউক্রেনের সংঘাত, এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের কারনে একদিকে যেমন লক্ষ লক্ষ মানুষকে খাদ্য সংকটের ঝুকিতে ফেলেছে সেইসাথে খাদ্য, সার এবং জ্বালানীর বৈশ্বিক সরবরাহ ইত্যাদি এই সংকটকে আরো ঘণিভূত করেছে। ২০২২ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স আমাদেরকে এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি করে।
ডিমের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে এবং তা সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। ইচ্ছামতো অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছেন। লুটে নিচ্ছেন মানুষের টাকা। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ডিমের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। ডিমের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ে স্বল্প আয়ের মানুষ। কারণ ডিমের দামে মাছ বা মাংস কোনোটাই কেনা সম্ভব নয়। তাই স্বল্প আয়ের মানুষের প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে একমাত্র ভরসা ডিম। কিন্তু এখন তাও নাগালের বাইরে চলে গেছে যা মোটেই কাম্য নয়। চলমান পরিস্থিতিতে স্বল্প আয়ের মানুষের নিত্যদিনের চাহিদায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। আর এ কারণেই ডিম উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম কমানো প্রয়োজন। প্রাণী খাদ্য ভর্তুকির মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ে ডিমের উৎপাদন বাড়াতে পারলে ডিমের দাম কমতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আদলে সার যেভাবে ভর্তুকি দেওয়া হয়, একই পদ্ধতিতে প্রাণী খামারিদের জন্য খামারে প্রাণীর খাদ্যে ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে। সতর্ক থাকতে হবে যে,এ ভর্তুকি যেন সরাসরি খামারি পর্যায়ে পৌঁছে। আর তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব একমাত্র সরকারের অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। তাই জাতীয় বাজেটে প্রাণী খাদ্যে ভর্তুকি দিলে পরোক্ষভাবে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট ব্যায় কমে যাবে। খাদ্য ও অন্য উপকরণের উচ্চমূল্য ও কোভিড-১৯ এর প্রভাবে প্রান্তিক খামার সমূহ প্রায় ৫০-৬০% বন্ধ হয়ে গেছে । এ ধরনের উদ্যোগের কারণে প্রান্তিক খামারিসমূহ পুনরায় খামার চালু করার মাধ্যমে ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। যার ফলে ডিমের দাম কমবে এবং জাতির পুষ্টি চাহিদা পূরণ হবে।
এছাড়ও বাজার ব্যবস্থাপনা তদারকি একান্ত প্রয়োজন। তাই ডিম ব্যবসায় নিয়োজিত ব্যবসায়ীদেরও সততার পরিচয় দিতে হবে। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন আল্লাহ তাআলা ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন। তাই ডিমের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে নিজেরা পকেট ভারি করা আল্লাহতালা পছন্দ কররেন না। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে (তিরমিজি, হাদিস:১২০৯)।
লেখক-জাতীয় প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি বিশেষজ্ঞ, জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা ।