ওমরাহ সফর-২০২৩: স্বপ্ন ও স্মৃতি- (৫ম পর্ব) "বিশাল ময়দানের নাম মিনা"

মাহফুজুর রহমান: বিশাল ময়দানের নাম মিনা। মক্কা নগরীর এক পাশে কাবা শরিফ থেকে ৫কিঃ মিঃ দূরেই এটি অবস্থিত। পুরো ময়দানটিই সাদা রঙের স্থায়ী তাঁবু দিয়ে সাজানো। দূর থেকে এগুলোকে অসংখ্য গম্বুজ মনে হবে। হাজীদের ৮ জিলহজ জোহরের আগে মিনায় থাকতে হয়। এদিন জোহর থেকে পরের দিন ফজর পর্যন্ত এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া সুন্নত। ৯ জিলহজ হাজীদের মিনা থেকে আরাফাহ ময়দানে যেতে হয়। ১০ জিলহজ মুজদালিফায় রাত যাপন করে ১১ জিলহজ সকালে মিনায় ফিরে জামরায় পাথর নিক্ষেপ করতে হয়। জামারা এখন বন্ধ থাকায় আমরা কাছে যেয়ে সেটি দেখতে পারি নাই। দূর থেকে শয়তানকে পাথর মারার স্থান আমরা অবলোকন করি। জিলহজের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ এই তিনদিন মিনায় অবস্থান করা সুন্নত। মিনার বর্তমান চিত্র খুবই সুন্দর ও পরিপাটি একটি শহর। এটাকে বিশ্বের বৃহত্তর তাঁবুর শহরও ধরা হয়। এখানকার তিন দিন অবস্থানকারী হাজীদের জন্য কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে তৈরি করা হয়েছে এসব তাঁবু।

মিনা দেখার পর আমরা গেলাম মুজদালিফায়।আরাফা ও মিনার মাঝামাঝি একটি জায়গার নাম মুজদালিফা। ৯ জিলহজ হাজীদেরকে আরাফাহ থেকে সূর্যাস্তের পর মিনার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার পর এখানেই রাত্রি যাপন করে। হাজীরা এখানে মাগরিব ও এশার নামাজ একসাথে আদায় করেন। মুজদালিফার পূর্ব সীমানার পিলারে আল্লাহর কুদরতে হজরত আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) দুনিয়াতে আসার পর এক সাথে প্রথম মিলিত হয়েছেন বলে রেওয়ায়েত আছে। মুজদালিফাতে অবস্থিত মসজিদটিতে হজের সময় হাজীরা নামাজ আদায় করেন। মুজদালিফায় হাজীদের রাত যাপন করতে হয়। এরপর হাজীরা এখান থেকে কঙ্কর নিয়ে মিনার উদ্দেশে রওনা দেন। মুজদালিফায় রাত্রি যাপনকারীকে আল্লাহতায়ালা রহমতের চাদরে আবৃত করে নেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুজদালিফার বর্তমানে অবস্থিত মসজিদের স্থানে ফজরের নামাজের পর দোয়া ও জিকিরে ব্যস্ত ছিলেন এবং সূর্যোদয়ের আগে আকাশ ফর্সা হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখেন। মুজদালিফাতে অবস্থিত মসজিদটির সামনে আমরা বেশ কিছু সময় কাটালাম। রায়হান ভাইয়ের হাদিয়া দেওয়া বিভিন্ন জুস পান শেষ করে আমরা চললাম আরাফাহ ময়দানের দিকে।

সুবিশাল প্রান্তর। দৈর্ঘ্য দুই মাইল। প্রস্থ দুই মাইল। যার তিন দিকেই পাহাড়। দক্ষিণ দিকে মক্কা শরিফ। এর পাশেই অবস্থিত উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় নগরী। এই ময়দানেই ৯ জিলহজ হাজিরা ‘উকুফে আরাফা’ করেন, যা হজের অন্যতম ফরজ বা রোকন। মক্কার মুয়াল্লা থেকে আরাফাতের মক্কা সংলগ্ন পশ্চিম সীমান্তের দূরত্ব সাড়ে ২১ কিলোমিটার। ঠিক এ পশ্চিম সীমান্তেই, আরাফাতের সীমানা শুরুর স্থানে দুটো পিলার নির্মাণ করা হয়েছে। আরাফার ময়দানের পুরো অংশই হারাম এলাকার বাইরে অবস্থিত। আরাফার ময়দান এক সময় উত্তপ্ত বালুময় হলেও এখন অবস্থা পাল্টেছে। এখন সেখানে সবুজ বৃক্ষ আর শীতল ফোয়ার পানি সব সময় পরিবেশকে কিছুটা হালকা ও শীতল করে রাখে। আরাফার ময়দান থেকেই হজের খুতবা দেওয়া হয়। আমরা যতটুকু সম্ভব ঘুরে ঘুরে আরাফাহ ময়দান দেখলাম। দেখা শেষ করে আরাফাহ মসজিদে দু’রাকাত নামাজ আদায় করে আমরা আমাদের হোটেলের দিকে রওনা করলাম।

ফজরের আগে ঘুম থেকে উঠেই কাবার দিকে যাত্রা। কাবায় তাহাজ্জুদের জন্য ও আহবান (আজান) জানানো হয়। আমরা মক্কায় অবস্থানের প্রায় প্রতিদিনই কাবায় ফজরের আগে প্রবেশ করার চেষ্টা করতাম। কারণ আজানের পর কাবা চত্বরে প্রবেশ করার সূযোগ পাওয়া কঠিন ছিলো। অধিকাংশ মানুষই আজানের আগেই কাবায় চলে আসতেন। আমাদের বেশিরভাগ দিনের রুটিন ছিলো রাতে না ঘুমিয়ে ফজরের নামাজের পর ঘুমানো। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে সাধারণত সকালের নাস্তা করা হতো। এর পরই আবার শুরু হয়ে যেতো জোহরের নামাজ কাবায় আদায় করার প্রস্তুতি। কারন ১১.০০ টার মধ্যে কাবায় না প্রবেশ করতে পারলে মূল চত্বরে নামাজ আদায় করা সম্ভব হতোনা। আমরা একটু আগেই কাবায় প্রবেশ করার চেষ্টা করতাম। সেখানে জোহরের নামাজ আদায় করে কিছু সময় অতিবাহিত করে হোটেলে ফিরে দুপুরের খাবার খাওয়া হতো। দুপুরের খাবার শেষ করে আবার আছরের নামাজের প্রস্তুতি। এখানে প্রতি ওয়াক্ত নামাজের জামায়াত হয় সাধারনত আওয়াল (শুরুর) সময়ে। অর্থ্যাৎ নামাজের সময় হওয়ার সাথে সাথেই সাধারনত নামাজ আদায় করা হয়।

পরদিন, আমাদের গন্তব্য আরও কিছু স্থান জিয়ারাহ করা। রায়হান ভাইয়ের গাড়িতে করে আমরা আয়েশা মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আয়েশা মসজিদ, উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা. এখান থেকে উমরার ইহরাম বেঁধে উমরা করেছিলেন। পরে সেখানে একটি বিশাল মসজিদ গড়ে উঠে। মসজিদটি ইসলামি শিল্পনৈপুণ্যের এক অনুপম নিদর্শন। এজন্য এটিকে মসজিদে আয়েশা রা. বলা হয়। আমাদের আয়েশা মসজিদে দুইবার যাওয়ার সুযোগ হয়। প্রথমদিন মাগরিবের নামাজ এবং পরে অন্য একদিন সেখানে আছরের নামাজ আদায় করি আমরা। যতগুলো মসজিদে আমরা গিয়েছি প্রত্যেক মসজিদই আলাদা শিল্পনৈপুণ্যের অধিকারী। মসজিদে প্রবেশ করলেই আপনার মন প্রশান্তিতে ভরে যাবে।

পরদিন আমাদের যাত্রা তায়েফের উদ্দেশ্যে। তায়েফের অজস্র স্মৃতি আমাদের চোখের সামনে। মশিউর ভাই এর সেই গান “তায়েফের গ্রাম আর কতদূর......”। মুজাহিদ ভাই এর গান শুনতে শুনতে আমরা পৌছে যায় সেই ঐতিহাসিক তায়েফে। ইতিহাসের পাতায় তায়েফ নানা কারণে আলোচিত। এ তায়েফের বনি সাকিফ গোত্রে নবী করিম (সঃ) দুধমাতা হযরত হালিমা সাদিয়ার ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। আবার নবুয়ত প্রাপ্তির পর হজরত রাসূলুল্লাহ (সঃ) মক্কা থেকে তায়েফ গিয়েছিলেন ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে।

কিন্তু তায়েফবাসী ইসলাম গ্রহণের পরিবর্তে নবীকে অত্যাচার ও নিগ্রহ করেছেন। ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তায়েফে প্রায় ১০ দিন অবস্থান করেছিলেন। তারপর ফিরে গেছেন তায়েফবাসীর নানা নির্যাতন সহ্য করে। এরপরও মোহাম্মদ (সঃ) তায়েফ বাসীর জন্য দোয়া করে গেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস মসজিদ তায়েফ শহরে অবস্থিত। এটিই তায়েফের কেন্দ্রীয় মসজিদ। আমরা এখানে দু’রাকাত নামাজ আদায় করে সামনে অগ্রসর হই। তায়েফের আর একটি আলোচিত স্থান হলো বুড়ির বাড়ি।-চলবে
-লেখক:জেনারেল ম্যানেজার, এগ্রোভেট ফার্মা