আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে : বিশ্ব দুগ্ধ দিবস ১ জুন ২০২৪

কৃষিবিদ ডক্টর এস এম রাজিউর রহমান; আজ বিশ্ব দুগ্ধ দিবস । বৈশ্বিক খাদ্য হিসেবে দুধের গুরুত্ব তুলে ধরার লক্ষ্যে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ঘোষিত একটি আন্তর্জাতিক দিবস। ২০০১ সালে জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা ০১ জুনকে বিশ্ব দুগ্ধ দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। আর এর ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর বাংলাদেশে ০১ জুন খ্রিস্টাব্দ তারিখে , বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কর্মশালা ও র‌্যালি আয়োজন করে। যার প্রধান লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে দুধ উৎপাদন, দুগ্ধ পুষ্টির গুরুত্ব, বিপণন, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যে খাওয়ার ব্যাপারে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মাঝে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করা।

এ বছরে দুগ্ধ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো: Celebrating Dairy’s role in global nutrition! অর্থাৎ বিশ্বকে মানসম্পন্ন পুষ্টি সরবরাহের জন্য দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা উদযাপনের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে; যা হতে হবে সহজ প্রাপ্য সুলভ মূল্যের, এবং পুষ্টি-ঘন খাদ্য, যা সারা বিশ্বে সুষম খাদ্যের একটি অপরিহার্য অংশ। তাই এ দুগ্ধ দিবসে আমাদেরও প্রত্যাশা হোক মঙ্গলকাব্যের কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের মতো ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে'। সন্তানগুলোকে দুধে ভাতে রাখলেই আমরা পাব স্মার্ট সন্তান, যা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে আবশ্যক। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে চাই স্মার্ট সিটিজেন। আর স্মার্ট সিটিজেন পেতে হলে চাই মেধা সম্পন্ন সন্তান।

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল বয়সের নর-নারীর জন্য দুধ একটি আদর্শ খাদ্য। সুস্থ সন্তান মানেই মেধাবী জাতি। আর মেধাবী জাতির জন্য মা ও সন্তানকে সুস্থ রাখতে খেতে হবে প্রতিদিন নিরাপদ দুধ । বাংলাদেশ প্রতিটি মানুষের জন্য প্রতিদিন ২৫০ মিলি লিটার দুধ প্রয়োজন। অথচ সরকারি তথ্যমতে বর্তমানে আমরা দুধ পাচ্ছি প্রতিদিন ২২০-২২২ মিলি লিটার। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য তা আরো অপ্রতুল।

এক জরিপে জানা যায়, ২০১৫ সালে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে ২৯% বাসিন্দা সপ্তাহে একবার দুধ খেত, ২০২১ সালে তা বেড়ে ৬৯% হয়েছে (দৈনিক প্রথম আলো ০২ জুন ২০২১) । নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের প্রতি ৬ জন মানুষের মধ্যে একজন অপুষ্টির শিকার। অপুষ্টির কারণে ৫ বছরের কম বয়সী ৩৬ শতাংশ শিশু উচ্চতা কম (অথাৎ খর্বকায়) ও ৩৩ শতাংশ ওজনে কম (অথাৎ কৃষকায়)। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বাংলাদেশ ২০২০ সালের তথ্য অনুসারে শিশুর মাঝারি ও গুরুতর কম ওজনের প্রবণতা ২০১২-১৩ সালে ছিল ৩১.৯ শতাংশ যা ২০১৯ সালে ২২.৬ শতাংশে নেমে এসেছে। একইভাবে, শিশুর মাঝারি এবং গুরুতর উচ্চতা ২০১২-১৩ সালে ৪২ শতাংশ থেকে ২০১৯ সালে ২৮ শতাংশে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।

আল্লাহ তাআলার অনন্য নেয়ামতের মধ্যে দুধ একটি। একে সুপারফুড বলা যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে দুধকে সুস্বাস্থ্যের জন্য অতুলনীয় পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। গৃহপালিত গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও উট থেকে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এসব দুধ পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন- ‘আর গবাদিপশুর মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে শিক্ষা। তার উদরস্থিত গোবর ও রক্তের মধ্য থেকে পান করাই বিশুদ্ধ দুধ, যা পানকারীদের জন্য সুস্বাদু।’ (সুরা নাহল : আয়াত ৬৬)।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,‘দুধ ছাড়া আর কোনো (খাবার) জিনিস নেই, যা একই সঙ্গে খাবার ও পানীয় উভয়টির জন্য যথেষ্ট হয়।’ (আবু দাউদ)।

দুধে রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ,যেমন পানি,আমিষ, ক্যালসিয়াম,পটাশিয়াম,ফসফরাস, প্রোটিন, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-ডি, ভিটামিন-বি ১২, নিয়াসিন, কোলেস্টেরল ও রিবোফ্লভিন। দুধ দেহের পেশী গঠনে,ক্ষয়পূরণের কার্যকরী। দুধে প্রায় ৭০% স্যাচুরেটেড ফ্যাটিএসিড ও ২৭% মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড থাকে। এতে আছে কনজুগেটেড লিনোলিক এসিড ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ও হার্টের সুস্বাস্থ্য রক্ষাকরে। দুধের কার্বোহাইড্রেট গ্লুকোজ ও গ্যালাকটোজ এর সমন্বয়ে গঠিত ল্যাকটোজ যা মস্তিষ্ক বিকাশের সহায়ক। দুধের ল্যাকটোপারঅক্সিডেজ এনজাইম ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে । দুধে আছে ল্যাকটোব্যাসিলাস ব্যাকটেরিয়া যা পাকস্থলীর ক্ষুদ্রান্তের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। তাছাড়া দুধের ল্যাকটোফেরিন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ল্যাক্টোফেরিন, একটি মাল্টিফ্যাকশনাল গ্লাইকোপ্রোটিন, যা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং ইমিউন নিয়ন্ত্রক প্রোটিন। এর জৈবিক ক্রিয়াকলাপগুলি অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল,অ্যান্টিভাইরাল,অ্যান্টিফাঙ্গাল ও অ্যান্টিকারসনোজেনিক (ওয়াং এট আল, ২০১৭)।

পাস্তুুরাইজ দুধে ল্যাকটোফেরিন অবস্থা ইউ.এইচ.টি দুধের চেয়ে ভালো থাকে। সুতরাং আমাদের পাস্তুুরাইজ দুধ খাওয়ার দিকে গুরুত্ব দেয়া ভালো। দুধে ল্যাকটোফেরিন নামক প্রোটিন এন্টিভাইরাল এজেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘(ক) অন্ন,বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা...’ হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। তবে এখন শুধু খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করলেই হবে না, সেটিকে নিরাপদও রাখতে হবে। তাই আমাদের নিরাপদ দুধ উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে ।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গবাদিপ্রাণি পালনের হার না বাড়ায় দুধ উৎপাদনের ঘাটতি এখনও বিদ্যমান । দুধের চাহিদা বাড়ায় খোলা বাজারে গাভীর তরল দুধে ভেজাল মেশানোর প্রবণতাও বৃদ্ধি পায়েছে। একসময় দুধের পরিমাণ বাড়াতে পানি মেশানো হলেও এখন আর তা পানিতে সীমাবদ্ধ নেই। এখন দুধে মিশে যাচ্ছে মানবস্বাস্থ্যের জন্য নানাবিধ ক্ষতিকর অণুজীব ও রাসায়নিক; যেমনঃ অ্যাণ্টিবায়োটি রেসিডউ, ফরমালিন, ডিটারজেন্ট, কীটনাশক, ভারী ধাতু ইত্যাদি। কেবল খোলা তরল দুধেই নয়, বিভিন্ন কোম্পানির বাজারজাত করা প্যাকেটজাত তরল দুধেও পাওয়া যেতে পারে ক্ষতিকর এসব অণুজীব ও রাসায়নিক পদার্থ। এসব পদার্থ সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশী হলে দুধ খাওয়াার অনুপযোগী হয়, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

যেমনঃ দুধে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি নিয়েও মান নির্ধারন রয়েছে; উত্তম পাস্তুরাইজ দুধে মোট ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা প্রতি মিলি দুধে ২০ হাজারের বেশি থাকবে না আবার একইভাবে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া প্রতি মিলি দুধে দশটির বেশি থাকা উচিত নয়। গরু অসুস্থ হলে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার যেমন প্রয়োজন তেমনি এন্টিবায়োটিকের প্রত্যাহার কাল ৭ থেকে ১০ দিন নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। এ সময় দুধ দোহন করে উক্ত দুধ খাবারের জন্য বিক্রয় করা যাবেনা। কিন্তু এ ব্যবস্থা সঠিকভাবে নিশ্চিত করার জন্য খামারিদের প্রণোদনা প্রদানের ব্যবস্থা থাকা আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে একান্ত প্রয়োজন। এর জন্য সঠিক নিয়ম-নীতির প্রয়োগ করতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। আবার গবাদি পশুর খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের আদর্শ ডোজ অনুসরণ, নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেয়ে খাদ্যের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উৎপাদনের জন্য নিয়মিত ব্যবহার করা হয়। গুড এনিমেল হাজবেন্ড্রী প্রাক্টিস, গুড হাইজেনিক প্রাকটিসের মাধ্যমে নিরাপদ দুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সাথে জড়িত সকল খামারি ও অংশিজনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। দুগ্ধ উৎপাদন থেকে শুরু করে ভক্তা পর্যন্ত দুগ্ধ ও দুগ্ধ জাতীয় দ্রব্য যেতে প্রতিটি পর্যায়ে কুল চেইন ফ্যাসিলিটি নিশ্চিত করে দুধ বিক্রয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে দুগ্ধশিল্পের অবকাঠামো উন্নয়ন করা, খাদ্যপণ্য মান নিয়ন্ত্রণের জন্য উন্নত ল্যাবরেটরী তৈরি, নিবিড় তদারকি ব্যবস্থাপনা, বেসরকারি বিনিযয়োগ, সঠিক পলিসি তৈরি নিরাপদ দুধ উৎপাদনের জন্য একান্ত প্রয়োজন ।

পরিশেষে বলা যেতে পারে নিরাপদ দুধ উৎপাদন, বিপনণ ও বিতরণ নিশ্চিত করে, পরিবারের সকলকে দুধ খেতে উৎসাহিত করতে হবে। পরিবারের প্রতিটি সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখতে পারলে দেশ পাবে মেধা সম্পন্ন একটি সুস্থ জাতি। আর আমরা তাহলেই পাবো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।

লেখক:এম এস (দুগ্ধবিজ্ঞান); পি.এইচ.ডি.(দুগ্ধবিজ্ঞান);
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ ।
দুগ্ধ ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ, আইআরজি-ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ, কুল চেইন প্রকল্প, বাংলাদেশ