ড. মোঃ গাজী গোলাম মর্তুজা:আজ ০৭ অক্টোবর ২০২২ বিশ্ব তুলা দিবস, তুলার বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরার জন্য ২০১৯ সাল থেকে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। বিশ্বের ৭৫ টিরও বেশি দেশে তুলা উৎপাদিত হয়। এটি বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশে দারিদ্র্য-বিমোচনকারী ফসল, যা মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। এটি একমাত্র কৃষি পণ্য যা আঁশ এবং খাদ্য উভয়ই সরবরাহ করে। শুষ্ক, খড়া ও লবনাক্ততা জমিতে ও তুলা উৎপাদন করা যায়, যা অন্য ফসলে সম্ভব নয় । বিশ্ব তুলা দিবস ২০২২-এর উদ্দেশ্য হল স্বল্পোন্নত দেশগুলিতে (এলডিসি) কর্মসংস্থান সৃষ্টি, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা তুলে ধরার একটি সুযোগ, টেকসই বাণিজ্য নীতিকে উৎসাহিত করা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিকে তুলার প্রতিটি ধাপ থেকে উপকৃত হতে সক্ষম করা।
বিশ্ব তুলা দিবস ২০২২-এর মাধ্যমে, আমরা প্রত্যেক স্টেকহোল্ডারের কাছে পৌঁছতে চাই, যারা মূল স্টেকহোল্ডার যেমন তুলা চাষী, টেক্সটাইল মিল বা আরএমজি, ব্র্যান্ড বা খুচরা বিক্রেতা, ভোক্তা, শিক্ষাবিদ, গবেষক, মিডিয়া কর্মী, এনজিও এবং সরকারি কর্তৃপক্ষ। তুলা চাষী তুলার উৎপাদন বাড়ায়, বস্ত্রমিল তুলা ব্যবহার করে নানা রকমের তুলাজাত পণ্যের উৎপাদন করে, ব্র্যান্ড/খুচরা বিক্রেতারা তুলার সোর্সিং সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে, সবশেষে ভোক্তারা তুলার চাহিদা ও পছন্দ তৈরী করে। শিক্ষাবিদরা ইতিবাচক ধারণা তৈরি করে, গবেষকরা তুলা শিল্পে ক্রমাগত উন্নতির জন্য গবেষণা করে। মিডিয়া তুলা সম্পর্কে নেতিবাচক কল্পকাহিনী দূর করে, এনজিওগুলি ইতিবাচক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে জনগনকে সচেতন করে এবং শেষ পর্যন্ত সরকারী কর্তৃপক্ষ তুলাবান্ধব বাণিজ্য নীতি ও তুলা উৎপাদনে সহায়তা করে।
২০০৩ সালে তুলা বিষয়টি ডব্লিউটিও (WTO)-এর কৃষি আলোচনায় আফ্রিকার চারটি স্বল্প-উন্নত দেশ- বেনিন, বুরকিনা ফাসো, চাদ এবং মালি কর্তৃক উত্থাপিত হয় এবং, যা কটন ফোর বা সি-4 নামে পরিচিত। ডব্লিউটিও (WTO)সদস্য দেশসমূহ তুলার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে বালি কনফারেন্স ২০২১৩ এবং নাইরোবি মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্স ২০১৫-এ তুলাকে অন্তর্ভুক্ত করেন।
তুলা-4 দেশ- বেনিন, বুরকিনা ফাসো, চাদ এবং মালি বিশ্ব তুলা দিবস প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে (UNGA) একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়। বিশ্বের বৃহত্তম তুলা সংস্থাগুলির মধ্যে একটি, ব্রেমেন কটন এক্সচেঞ্জ (Bremen Cotton Exchange)ও এই প্রস্তাবটিকে সমর্থন করেছিল।
তুলা-4 দেশের উদ্যোগে ডব্লিউটিও (WTO) 7 অক্টোবর ২০১৯-এ প্রথমবারের মত বিশ্ব তুলা দিবসের আয়োজন করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO), বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক জাতিসংঘ সম্মেলন (UNCTAD), ITC এবং আন্তর্জাতিক তুলা উপদেষ্টা কমিটি (ICAC) এর সহযোগিতায় জেনেভায় ডব্লিউটিও সদর দপ্তরে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
বিশ্ব তুলা দিবস প্রতিষ্ঠার জন্য তুলা-4 দেশ - বেনিন, বুরকিনা ফাসো, চাদ এবং মালি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে (UNGA) একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব (A/RES/75/318) দেয়। সে মোতাবেক জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৩০ আগস্ট, ২০২০ আনুষ্ঠানিকভাবে ৭ অক্টোবরকে বিশ্ব তুলা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বিশ্বজুড়ে তুলার বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবকে স্বীকার করে এবং স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘ
বিশ্ব তুলা দিবস ঘোষণা করে এবং এটি জাতিসংঘের স্থায়ী ক্যালেন্ডারে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
এই বছর, ২০২২ সালের ৭ অক্টোবর, তুলা বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য বিশ্ব তুলা দিবস পালন করার উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে। প্রাকৃতিক তন্তু হিসাবে বিশ্বজুড়ে তুলার উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ী এবং ব্যবহারকারী কিভাবে উপকৃত হবে, তা তুলে ধরা হবে। বিশ্ব তুলা দিবস তুলার উপর ইতিবাচক প্রভাব প্রদর্শন করার একটি বিরাট সুযোগ। এক টন তুলা আনুমানিক ৫ বা ৬ জন লোকের জন্য সারা বছরের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে।
বিশ্ব তুলা দিবস খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ- এটি বিশ্বের কিছু স্বল্পোন্নত দেশে দারিদ্র্য বিমোচনকারী ফসল, যা সারা বিশ্বের মানুষকে টেকসই এবং উপযুক্ত কর্মসংস্থান প্রদান করে। কৃত্রিম তন্তুর সাথে তুলনা করলে তুলা দ্রুত পচনশীল, এটি আমাদের জলপথে প্লাস্টিকের পরিমাণ হ্রাস করে এবং আমাদের মহাসাগরকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এটি একমাত্র কৃষি পণ্য যা বস্ত্র এবং খাদ্য উভয়ই সরবরাহ করে। তুলা ফসল শুষ্ক আবহাওয়ায় জন্মে, যা অন্য কোন ফসল পারে না।
বিশ্ব তুলা দিবস ২০২২ -এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে 'ভালোর জন্য তুলা'। তুলা উৎপাদন দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করে, প্লাস্টিকের দূষণকে পরিবেশের বাইরে রাখে, নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করে এবং তুলার নেতিবাচক কার্বন পদচিহ্নের মতো সুবিধাগুলি উপস্থাপন করে। বিশ্বে তুলা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থকরী ফসল। বিশ্বের গ্রীষ্মমন্ডলীয় ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের জন্য তুলা ফসল পুরোপুরি উপযুক্ত।
সামগ্রিকভাবে, তুলা বিশ্বের আবাদযোগ্য জমির মাত্র ২.৫ শতাংশ দখল করে এবং এখনও বিশ্বের টেক্সটাইল সেক্টরের ২৭ শতাংশ পূরণ করে। প্রতি বছর ৩৩-৩৫ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে বিশ্বের গ্রীষ্মমন্ডলীয় ও নাতিশীতোষ্ঞ অঞ্চলের ৭৫টিরও বেশি দেশের তুলা চাষ করা হয়, যা সমস্ত পৃথিবীর আবাদকৃত জমির ২.৫ শতাংশ। ১০০ মিলিয়নেরও বেশি পরিবার সরাসরি তুলা উৎপাদনের সাথে জড়িত এবং ২৫-২৬ মিলিয়ন টন কাঁচা তুলা উৎপাদন করে, যেখানে প্রতি হেক্টরে গড়ে প্রায় ৮০০ কেজি আঁশতুলা উৎপাদিত হয়। কৃষি ফসলের মধ্যে তুলাই একমাত্র ফসল, যা থেকে খাদ্য ও বস্ত্র দুই ই পাওয়া যায়। বীজতুলা থেকে প্রথমত আমরা আঁশ পেয়ে থাকি, এছাড়া উপজাত হিসেবে বিশ্বে প্রতি বছর পাঁচ কোটি টনেরও বেশি তুলাবীজ উৎপাদিত হয়। তুলাবীজ থেকে আমরা ভোজ্য তেল ও খৈল পেয়ে থাকি। খৈল গবাদি পশু ও মাছের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
১০০ টিরও বেশি দেশ তুলা আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যে জড়িত। তুলা উৎপাদন, জিনিং, টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, ভোজ্যতেল এবং সাবান শিল্প ইত্যাদির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ লোকের জীবিকা নির্বাহ করে। তুলা বিশ্বের অন্যতম টেক্সটাইল তন্তু এবং তুলা অর্থনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
প্রাকৃতিক তন্তু তুলা ব্যবহার দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এক সময় পঞ্চাশ ভাগের অধিক প্রাকৃতিক তন্তু তুলার ব্যবহার ছিল, বর্তমানে তা ২৭ ভাগে নেমে এসেছে। এই কারণে, প্রকৃতিক তন্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে ২০০৯ সালকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক তন্তু বছর ঘোষণা করেছিল।
বিশ্ব তুলা দিবস ২০২২ এর উদ্দেশ্যগুলি হলো, তুলার ব্যবহার ও চাহিদা বৃদ্ধি করা এবং তুলার উপকারিতা এবং মূল্য সম্পর্কে জনগনকে অবহিত করা, বিশ্বজুড়ে তুলার জন্য ইতিবাচক মিডিয়া কভারেজ তৈরি করা, তুলার গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির সরকারী প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সমর্থন পাওয়া, ডাব্লুটিও এবং জাতিসংঘকে জড়িত করা, ব্র্যান্ড এবং খুচরা বিক্রেতাদের তাদের স্টোরগুলিতে বা তাদের ওয়েবসাইটে তুলার ব্যাপক প্রচার করা।
মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো হলো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। সভ্যতার দিক থেকে বিবেচনায় বস্ত্রই হচ্ছে আমাদের প্রথম মৌলিক চাহিদা। এই বস্ত্র শিল্পের মূল ও প্রধান উপাদান তুলা। এক সময় বাংলাদেশের মসলিন ছিল বিশ্ব বিখ্যাত। এদেশে তৈরি রাজকীয় শাড়ী “মসলিন” বিশ্ব বিখ্যাত ছিল। এই মসলিনের তুলা এ দেশেই উৎপাদিত হতো। ব্রিটিশ শাসনামলে সেই তুলা ও মসলিন কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। বর্তমানে আবার বস্ত্র এবং গার্মেন্টস খাত বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। বাংলাদেশে বস্ত্র খাতের ৪৫০ টি সুতাকলের জন্য বছরে প্রায় ৭৫-৮০ লক্ষ বেল আঁশ তুলার প্রয়োজন হয়, যার সিংহভাগ বিদেশ থেকে আমদানী করে মেটানো হচ্ছে এবং এই চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পরিমান তুলা আমদানী করতে প্রতিবছর প্রায় ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে মোট চাহিদার মাত্র তিন ভাগ পূরণ করতে পারে, বাকী ৯৭ ভাগ তুলা বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। তাছাড়া আমাদের বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের ৮৪ ভাগই আসে তৈরী পোশাক খাত থেকে। ৫০০০ গার্মেন্টস ও তৈরী পোশাকের অন্যান্য খাতে প্রায় ৫০ লক্ষ লোক সরাসরি জড়িত। এসব বিবেচনায় বিশ্ব তুলা দিবস বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ লোক তুলা থেকে উৎপাদিত পোশাক ব্যবহার করছে এবং আগামীতে তুলার চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এই চাহিদা বৃদ্ধির ফলে টেকসই তুলার প্রয়োজ বাড়বে। আমাদের পরিবেশকে ঠিক রেখে তুলা উৎপাদন করতে হবে। বিশ্বব্যাপী প্রচলিত তুলা উৎপাদনে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষিত হয়। তাই টেকসই তুলা উৎপাদন এই সমস্যার সবচেয়ে ভালো সমাধান। বিপজ্জনক রাসায়নিকের ব্যবহার হ্রাস করে ও কম পানি ব্যবহার করে টেকসই তুলা উৎপাদন করতে হবে। এতে কৃষকের আয় বৃদ্ধি পাবে ও দারিদ্র্য হ্রাস পাবে।
সরকার এবং অন্যান্য নীতিনির্ধারকদের উচিত তুলা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ইতিবাচক সহায়তা গড়ে তোলা। বিশ্ব তুলা দিবস, ২০২২ হল তুলার উপর ইতিবাচক প্রভাব দেখানোর একটি সুযোগ, যা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদযাপনে যোগ দিতে রাজি করাবে। এটি বিভিন্ন দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কারণ তুলা বিশ্বের ৭৫ টিরও বেশি দেশে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি পরিবারকে উপকৃত করছে। বিশ্ব তুলা দিবস জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়ার এবং তুলা-সম্পর্কিত ক্রিয়াকলাপ এবং পণ্যগুলি প্রদর্শনের একটি মূল সুযোগ হিসাবে কাজ করবে। বিশ্ব তুলা দিবস অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে সকল স্টেকহোল্ডারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
লেখক:প্রকল্প পরিচালক, সম্প্রসারিত তুলাচাষ প্রকল্প, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা
ইমেইল:This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.