ধান চাষাবাদে ব্যবহৃত আধুনিক যন্ত্রপাতি বিষয়ক কৃষক প্রশিক্ষণ

এগ্রিলাইফ প্রতিনিধি:বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এর ফার্ম মেশিনারি এন্ড পোস্ট হারেভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের উদ্যোগে এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগীতায় কেজিএফ-বিকেজিইটি এর অর্থায়নে পরিচালিত “ভ্যালিডেশন এন্ড আপস্কেলিং অফ রাইস ট্রান্সপ্লান্টিং এন্ড হারভেস্টিং টেকনোলজি ইন দ্যা সিলেক্টেড সাইটস অফ বাংলাদেশ (ভিআরটিএইচবি)” শীর্ষক গবেষণা প্রকল্পের আওতায় “ধান চাষাবাদে ব্যবহৃত আধুনিক যন্ত্রপাতি” বিষয়ক একদিন ব্যাপী কৃষক প্রশিক্ষণ আনন্দপুর এবং বনদক্ষিণ, সদর, হবিগঞ্জে অনুষ্টিত হয়।

১২-১৩ আগষ্ট, ২০২২ ইং তারিখে আয়োজিত উক্ত প্রশিক্ষণে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার কাম সার প্রয়োগযন্ত্র এবং ব্রি পাওয়ার উইডার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। আলোচনা পরবর্তী প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে মেশিন দুটির চালানো হাতে-কলমে শেখানো হয়। মাঠ পর্যায়ে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার কাম সার প্রয়োগযন্ত্র এবং ব্রি পাওয়ার উইডার চালানোর সময় কি কি সমস্যা হতে পারে এবং সমস্যা সমূহ কিভাবে সমাধান করা যায় তা দেখানো হয়।



এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর একদল গবেষক ড. মো. আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার কাম সার প্রয়োগযন্ত্রটি উদ্ভাবন করেন। যন্ত্রটির বৈশিষ্ট হলো

১. এই যন্ত্রের সাহায্যে একই সাথে ধানের চারা রোপনের পাশাপাশি সার মাটির গভীরে সুষম মাত্রায় প্রয়োগ করা যায়। পরবর্তীতে কোনো সার প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয়না।

২. প্রয়োজনে সার প্রয়োগ বন্ধ রেখে শুধুমাত্র ধানের চারা রোপণ করা সম্ভব। একসাথে যৌথ কাজ করার জন্যে যন্ত্রের কর্মদক্ষতার কোন পরিবর্তন হয় না।

৩. মাটির গভীরে সার প্রয়োগের ফলে জমিতে আগাছা কম হয় এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সার অপচয়ের মাধ্যমে পরিবেশকে দূষণের ক্ষতির প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা যায়।

৪. মওসুম ভেদে এই যন্ত্রের সাহায্যে চারা রোপণ ও সার প্রয়োগ বাবাদ শতকারা ২০-৩০ ভাগ ইউরিয়া সাশ্রয় করা যায়।

৫. সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগের ফলে এবং মাটির গভীরে সার প্রয়োগের দরুণ গাছের পুষ্ঠি গ্রহণ মাত্রা বৃদ্ধি পায়। যার ফলে ধানের ফসল প্রায় ১০% বেশী হয়।



যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চারা রোপণ এবং গভীরে সার প্রয়োগের জন্য ১. ট্রের চারা সমঘনত্বের এবং সমউচ্চতার হওয়া বাঞ্চনীয়, ২. মাঠে ফসলের সমরূপতা এবং ট্র্যান্সপ্লান্টারের সঠিক কার্যদক্ষতা পাওয়ার জন্য মাঠ সমতল করতে হবে, ৩. জমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত হতে চারা রোপণের মধ্যবর্তী সময় এবং চারা রোপণের সময় জমিতে পানির পরিমাণ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে রোপণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ৪. জমিতে সর্বশেষ মই দেয়ার (সম্পূর্ণ তৈরির) পর মাটির প্রকার ভেদে ১২-৪৮ ঘণ্টা পর চারা রোপণ করতে হবে, ৫. চারা রোপণের সময় জমিতে আনুমানিক ০.৫-১.০ সেমি পানি অথবা ছিপছিপে অবস্থা বজায় রাখতে হবে।, ৬. যন্ত্র চালানো এবং রোপণকৃত চারা মাটিতে ধরে রাখার জন্য মাটির পর্যাপ্ত বহন শক্তি থাকা জরুরি। ৭. চারা রোপণের পর মাটির প্রকার ভেদে ২৪-৭২ ঘণ্টা পর প্রথম সেচ দিতে হবে। চারা রোপণের পর পরই সেচ দিলে কিছু চারা পানির স্রোতে ভেসে যেতে পারে, ৮. যে সারিতে সার প্রয়োগ করা হবে সেই সারিতে যন্ত্র চালানোর সময় হাঁটা যাবে না, ৯. সম্পূর্ণ সার শেষ হওয়ার পূর্বেই সারের ধারকটি মিশ্রসার দ্বারা পূর্ণ করে দিতে হবে, ১০. সার ধারক পাত্রে সারের জমাট বাঁধা ঢেলাসমূহ ভেঙ্গে দিতে হবে অন্যথায় স্পাইরাল স্ক্রু বা সার ধারকের নির্গমন পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, ১১. নির্দিষ্ট গভীরতায় সার প্রয়োগের জন্য নালা তৈরি এবং সঠিকভাবে নালা বন্ধ হচ্ছে কিনা তা মাঝে মাঝে লক্ষ করতে হবে, ১২. আগাছা, কাদা মাটি বা অন্য কোনো ভাবে জমিতে সার নির্গমনের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে তা সাথে সাথে পরিষ্কার করে দিতে হবে, ১৩. চারা রোপণের সময় কোনো কারণে যন্ত্রটি পিছনের দিকে সরাতে হলে হাইড্রোলিক এর মাধ্যমে উঁচু করে যন্ত্রটি পিছনে টানতে হবে, অন্যতায় সার নির্গমন নালাটি কাদা মাটি দ্বারা বন্ধ হয়ে যাবে।



যন্ত্রটি চালানোর আগে ১. মেশিন চালানোর কৌশল সম্পর্কে ভালো ভাবে পড়তে হবে এবং জানতে হবে, ২. মেশিনের নিরাপত্তা চিহ্ন সম্পর্কে জানতে হবে এবং মানতে হবে, ৩. রাইস ট্র্যান্সপ্লান্টার ব্যবহার করার আগে ইঞ্জিন, মেশিন এবং অন্যান্য অংশ সতর্কতার সঙ্গে চেক করতে হবে এবং প্রতিটি অংশ ভালো অবস্থায় আছে কি-না তা নিশ্চিত হতে হবে, ৪. জ্বালানি তেল, গিয়ার ওয়েল এবং ইঞ্জিন ওয়েলের সঠিক পরিমাণ এবং গুণগত মান চেক করতে হবে, ৫. অ্যাপ্লিকেটর গিয়ার বক্সের গ্রীজ, বেল্ট টেনশন এবং ইম্পেলরের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে এবং ৬. মিশ্রিত সার ঝরঝরে আছে কি-না তা নিশ্চিত হতে হবে।



তাছাড়া চালানো সময় ১. সর্বোচ্চ কার্যক্ষমতা পেতে হলে ৭০-৮০% ট্র্যান্সপ্লান্টিং গতিতে চারা রোপণ করতে হবে, ২. উন্মুক্ত ঘুর্ণায়মান এবং গরম অংশ হতে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, ৩. ঢিলেঢালা জামা পরে মেশিন চালানো যাবে না, ৪. জমির আইলের উপর পিকার চালানো যাবে না, ৫. জমির পাশে পর্যাপ্ত জায়গা রেখে মেশিন চালাতে হবে, ৬. উচ্চ গতিতে চালানো, হঠাৎ বন্ধ করা বা হঠাৎ ঘুরানো যাবে না। একটি বক্র রেখায় ঘুরাতে হবে, ৭. বন্ধ করার অগে সকল গিয়ার নিউট্রাল পজিশনে রাখতে হবে, ৮. উচুঁ-নিচুঁ জায়গায় কম গতিতে সাবধানে চালাতে হবে এবং ৯. মেশিন কোনো অস্বাভাবিক শব্দ করলে সাথে সাথে বন্ধ করে দিতে হবে।



উক্ত প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার কাম সার প্রয়োগযন্ত্রটির পাশাপাশি ব্রি পাওয়ার উইডার নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করা হয় এবং হাতে-কলমে চালানো শেখানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে উক্ত মেশিন দুটি সকলের উপস্থিতে মাঠ চালানো হয় এবং সকলের সামনে মেশিনের কার্যকারীতা প্রদর্শন করা হয়।

উক্ত প্রশিক্ষণ এবং মাঠ দিবস অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন উক্ত প্রকল্পের প্রধান গবেষক এবং ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আনোয়ার হোসেন এবং প্রকল্পের সহযোগী গবেষক ইঞ্জিনিয়ার সুব্রত পাল। আরো উপস্থিত ছিলেন কৃষিবিদ সুকান্ত ধর, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এবং উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাবৃন্দ, সদর, হবিগঞ্জ।