প্রান্তিক পোল্ট্রি খামারিরা যেন রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আগত অজানা গন্তব্যের এক যাত্রী

রাজধানী প্রতিনিধি:প্রান্তিক পর্যায়ের পোল্ট্রি খামারিদের অবস্থা রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মের যাত্রীর মত। সারা বছরের প্রতিটি দিনেই রেল ষ্টেশনের প্লাটফর্মটি সরগরম থাকে। পোল্ট্রি খামারিরা হল ষ্টেশনে আসা এক অজানা গন্তব্যের যাত্রী। যাদের গন্তব্য এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে। রেল ষ্টেশনের প্লাটফর্মে হকার, ভবঘুরে, যাত্রী সব মিলিয়েই মনে হয় কতই না জমজমাট। তবে অজানা গন্তব্যের কতোজন যাত্রী আর তাদের যাত্রা এই সেক্টরে চালিয়ে যাচ্ছেন তা শুধু পোল্ট্রি খামারিদের শুভানুধ্যায়ীরাই বলতে পারবেন।

প্রান্তিক পর্যায়ের পোল্ট্রি খামারি যারা ৯০ দশক থেকে বানিজ্যিকভাবে এ পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর করলেই দেখা যাবে আজকের সময় কারা কারা টিকে আছেন। অনেকে বিদেশ চলে গেছেন, অনেকেই বাপ-দাদার জায়গা-জমি বিক্রি করে দায়-দেনা শোধ করেছেন। এটি আসলে বাস্তব চিত্র যা সাধারণ জণগনের কাছে তেমনভাবে উপস্থাপিত হয়নি।

পোল্ট্রি শিল্পের বর্তমান সংকট মোকাবেলা ও প্রান্তিক পোল্ট্রি খামারীদের বাঁচাতে এক মুক্ত আলোচনায় দেশের প্রান্তিক খামারীরা এসব অভিযোগ করেন। বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদ এই মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে। সোমবার (২১ আগস্ট ২০২২) সকাল ১১ টায় কৃষিবিদ ইনস্টিউশনে ওই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ডাঃ মোসাদ্দেক হোসেন। আলোচনায় সারাদেশ থেকে আসা প্রান্তিক খামারী ও সাংবাদিকরা ওই আলোচনায় অংশ নেন।

আলোচকরা বলেন, প্রান্তিক পোল্ট্রি খামারীরা শেষ হয়ে গেলে তখন ডিম আমদানি করতে হবে। তারাই দেশের সিংহভাগ ডিমের যোগান নিশ্চিত করেন। তারা নি:শেষ হয়ে গেলে দেশে এখন যে দামে ডিম বা ব্রয়লার পাওয়া যাচ্ছে তা হবে স্বপ্নের মত। আমরা উৎপাদনকারী ও ভোক্তার সুরক্ষা চাই- সিন্ডিকেট নির্মুল করা সরকারের দায়িত্ব। সিন্ডিকেটের হাত থেকে পোলট্রি শিল্পকে রক্ষায় ডিমের দাম বেঁধে দেওয়ার দাবি প্রান্তিক খামারিদের। তারা বলেছেন, একটি চক্র সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম বাড়িয়েছে। অথচ প্রান্তিক খামারিরা ডিমের ন্যায্যমূল্য পান না। তারা বছরের পর বছর লোকসান দেন।



সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে বরিশালের প্রবীণ খামারী রহিম গাজী বলেন, তিনি তার জমি বিক্রি করে ব্যাংকের দায়দেনা শোধ করেছেন। ডিম উৎপাদনকারী খামারীদের ব্যবসা অন্য যেকোনো কৃষি ব্যবসার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ এটি একটি লাইভ বিজনেস। এখানে রোগ-বালাই, শীত-গরম সহ নানা প্রতিকূলতার মাঝে কাজ করতে হয়। এখানে যারা এখনো টিকে আছে তারা এই শিল্পের ভালোবাসার টানে কোনোমতে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। যখন একটি মুরগির বাচ্চা বড় হয়ে ডিম পাড়ে তখন তাদের মনে যে আনন্দ থাকে তা ভাষায় প্রকাশ করার নয় যোগ করেন রহিম গাজী। তারা মনে করেন সামনে ভালো দিন আসবে তাই লোকসান হলেও খামার চালিয়ে যান। সম্পূর্ণ নিজের ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসাটি পরিচালনা করেও বর্তমান সময়ে দারুণভাবে অপমানিত হচ্ছেন তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই ফেসবুকে ডিম খাওয়া বিরত রাখতে উদ্বুদ্ধ করছেন তাদের অধিকাংশই উচ্চশ্রেণীর উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান। তারা জানে না যে দেশের কৃষকরা কিভাবে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাদের খাদ্যের যোগান দিয়ে যাচ্ছে। যত রাগ যেন সব ডিমের উপর।



খামারিরা বলেন, ডিমের দাম বাড়ার কারণে প্রান্তিক খামারিদের জরিমানা করা হচ্ছে। এতে তারা সামাজিকভাবে চরম অপমানিত হচ্ছেন।আগের দিন বাজারে ডিমের ডজন ১২০ টাকা হলে পরের দিনই কীভাবে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা হয়? এর পেছনে কারা জড়িত, তা খুঁজে বের করতে হবে। প্রান্তিক পর্যায়ের পোল্ট্রি খামারীদের বাঁচাতে মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে খামারীরা বলেন, উৎপাদন খরচের পোল্ট্রি মুরগী ও ডিমের দাম না পাওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সে ঋণ শোধ করতে গিয়ে জর্জরিত হয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন প্রান্তিক পর্যার্য়ের খামারীরা। মধ্যস্বত্ত্বভোগী একটি সিন্ডিকেট ও বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানীর কারণে প্রান্তিক খামারীরা লাভের মুখ দেখতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন তারা। প্রান্তিক খামারীদের রক্ষার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারের সমস্ত এজেন্সির প্রতি আকুল অনুরোধ জানান তারা।

আনোয়ার হোসেন তালুকদার নামের এক খামারী বলেন, পোল্ট্রি খাদ্যের দাম কয়েকগুন বেড়ে গেছে। খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ৬০ ভাগ খামার ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি ৪০ ভাগ খামারীরাও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে জর্জরিত কারণ তারা তাদের নায্য মুল্য পাচ্ছেন না। প্রতিটি ডিম উৎপাদনে তাদের প্রায় সাড়ে ৯.৫০-৯.৭৫ টাকা খরচ হলেও তারা উৎপাদিত মূল্যেও তা বিক্রি করতে পারছেন না। এর সাথে যুক্ত হয়েছে জ্বালানীতেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং মফস্বল এলাকায় ঘনঘন লোড শেডিং। ফলে জেনারেটর চালিয়ে তাদের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হচ্ছে।



এসময় প্রান্তিক খামারীদের মধ্যে রংপুরের সমন্বয়ক মাহাবুব আলম, ইসতিয়াক আহমেদ, গাজিপুরের শহিদ, চট্রগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক ফয়েজ আহমেদ, সিলেটের প্রতিনিধি ইমরান হোসেন, তরিকুল ইসলাম, ইত্তেফাকের সাংবাদিক মুন্না রায়হান, বিটিভির সিনিয়র সাংবাদিক নাসির উদ্দিনসহ অনেকে মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তব্য রাখেন।  

মহল্লার খুচরা দোকানিরাও এই সুযোগটি নিয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করেন খামারিরা। এসময় তারা চলতি বছর ঈদুল ফিতরের আগের দিন সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকটের তথা বলে দাম বৃদ্ধির উদাহরণ তুলে ধরেন।

দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা খামারিদের মধ্যে মাহবুব আলম, মো. ইসরাফিল, সুজন চৌধুরী, মাহমুদুল হাসান, মেজর অব: আতিকুল হাফিজ, ইঞ্জিনিয়ার জোয়ারদার প্রমুখ আলোচনা করেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন পরিষদের সাধারন সম্পাদক খন্দকার মো. মোহসিন।