ছাত্রদলের প্রথম শহীদ হয়েছিলেন বাকৃবির এটিএম খালেদ (বীর-প্রতীক)

কৃষিবিদ মোঃ সোহরাব হোসেন সুজন:আজ ১১ জানুয়ারি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ১ম শহীদ "শহীদ খালেদ দিবস"। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য(আহবায়ক কমিটি) এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক এটিএম খালেদ- বীরপ্রতীক ১৯৮০ সালের এইদিনে বাকৃবিতে সন্ত্রাসীদের আক্রমনে শাহাদাত বরণ করেন। ৪৩ তম শাহাদাত বার্ষিকীতে তোমায় আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

এটিএম খালেদ মুক্তিবাহিনীর ১১ নম্বর সেক্টরের মানকারচর সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ভারতের দেরাদুনে প্রশিক্ষণ নেন। যুদ্ধ করেন কুড়িগ্রাম জেলার কোদালকাটি, চিলমারীসহ আরও কয়েক স্থানে। ১লা  অক্টোবর সুবেদার আলতাফের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দল কোদালকাটির পাকিস্তানি অবস্থানে একযোগে আক্রমণ করে। একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন খালেদ। দু-তিন দিন সেখানে যুদ্ধ হয়। ৩ অক্টোবর দুপুরের পর পাকিস্তানি অবস্থান থেকে আর কোনো গুলি আসছিল না। বিষয়টি মুক্তিযোদ্ধাদের চিন্তিত করে ফেলে। এ অবস্থায় দুঃসাহসী খালেদসহ আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কলার ভেলায় করে নদী পার হয়ে পাকিস্তানি অবস্থানে গিয়ে দেখেন, সেখানে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার কেউই নেই। পাকিস্তানিদের গোটা প্রতিরক্ষা খাঁ খাঁ করছে। চারদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাকিস্তানিদের দেখা গেল না। তখন তাঁরা বুঝতে পারলেন, পাকিস্তানিরা পালিয়ে গেছে।

১৭ অক্টোবর চিলমারীতে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে পাকিস্তানিদের বিভিন্ন অবস্থানে আক্রমণ করেন। এ টি এম খালেদ ও কাজিউল ইসলাম ছিলেন একটি দলের নেতৃত্বে। তাঁরা জোড়গাছ স্কুলের পাকিস্তানি অবস্থানে আক্রমণ করেন। তাঁদের প্রচণ্ড আক্রমণে সেখানকার পাকিস্তানিরা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। বেশির ভাগ পাকিস্তানি পালিয়ে তাদের মূল ঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়। খালেদ এক পাকিস্তানি সেনাকে জীবিত আটক করেন। এই পাকিস্তানি সেনাকে পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা এ টি এম খালেদ মুক্তিযুদ্ধ শেষে আবার পড়াশোনায় মন দিয়েছিলেন।

১৯৭১ সালে তিনি ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। স্বাধীনতার পর সেখানে পুনরায় ভর্তি হন। তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল, পড়াশোনা শেষ করে নিজ এলাকায় আধুনিক কৃষিচাষে আত্মনিয়োগ করার। কিন্তু তাঁর সে আশা আর পূরণ হয়নি। পরে তিনি জড়িয়ে পড়েন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের রাজনীতিতে। খেলাধুলায়ও ছিল তাঁর বেশ উৎসাহ। এজন্য তাঁর জীবনের কয়েকটি বছর নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৭৯-৮০ সালে অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যুদ্ধচলাকালীন সময়ে অতি ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন এবং তিনি খালেদ দুলুর অসীম সাহসের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের রাজনীতিতে যুক্ত হন। জিয়াউর রহমান তাঁকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়-এর প্রতিষ্ঠাকালীন আহবায়ক করে কমিটি ঘোষণা দিয়ে ছাত্রদল গড়বার জন্য গুরুদায়িত্ব দেন। সেই দায়িত্ব যথাযথ মর্যাদায় পালন করতে গিয়ে নিজের পরিবার পরিজনের কথা ভুলে গিয়ে ছাত্রদল গঠন করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ ছাত্ররা খালেদ দুলুর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন কারণ সে সময় তার জনপ্রিয়তা ছিলো আকাশচুম্বী। ১৯৮০ সালের জানুয়ারী মাসের ১০ তারিখ গভীর রাতে অর্থাৎ ১১ জানুয়ারী বীরপ্রতীক এটিএম খালেদ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের আক্রমনে শাহাদত বরন করেন। উনার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ময়মনসিংহের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শত শত ছাত্রদলের অসীম সাহসী বীরেদের পাল্টা আঘাতে বাকৃবি ছাত্রলীগের তিনজন ঘাতক ক্যাডার নিহত হয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

এটিএম খালেদ যেমন ৭১-এ রনাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তেমনি ছাত্রদলের ইতিহাসের প্রথম শহীদ। মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য এটিএম খালেদ বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন।

এ টি এম খালেদের পৈতৃক বাড়ি গাইবান্ধা জেলায়। কুপতলা ইউনিয়নে তাঁর বাবার বাড়ি। তাঁর ডাকনাম দুলু। এ নামেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। জন্ম ২৭শে জানুয়ারি ১৯৫২। তাঁর বাবার নাম গোলাম মওলা প্রামাণিক। মা রেজিয়া খাতুন। খালেদ অবিবাহিত ছিলেন। তিন ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। ১৯৬৮ সালে গাইবান্ধা সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ করে তিনি ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। খালেদ দুলু একজন ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন।

এটিএম খালেদের মা রেজিয়া খাতুন ও বোন মাহমুদা খাতুন বলেন, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকাকালীন সময়ে এবং আজও দলের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ অনেক নেতা আমাদের পরিবারের সবসময় খোঁজখবর রাখছেন।

এটিএম খালেদ দুলু বীরপ্রতীক স্মরণে তাঁর প্রাণের বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে স্থাপিত হয়েছে একটি স্মৃতিফলক। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল প্রতিবছর ১১ জানুয়ারি দিনটিতে খালেদ স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে আসছে।
 
এটিএম খালেদ দুলু বীরপ্রতীক-এর স্মরণে তাঁর জন্মস্থান গাইবান্ধা শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটিএম খালেদ দুলু স্মৃতিসংসদ। এই সংগঠনের উদ্যোগে গাইবান্ধা পৌর পার্কে একটি পত্রিকা ফলক স্থাপিত হয়েছে। ২০১৩ সালের ২৬ মার্চ তাঁর বাসা সংলগ্ন মোড়ে স্থাপিত হয়েছে তাঁর প্রতিকৃতি সম্বলিত একটি স্মৃতিফলক। যার ডিজাইন করেছেন শিল্পী শাওন সগীর সাগর। আর পুরাতন হাসপাতাল সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে বীর প্রতীক এটিএম খালেদ দুলু সড়ক।

এবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ৪৪ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী (১ জানুয়ারি,২০২৩) উপলক্ষে অনুষ্ঠিত ছাত্র-সমাবেশে সংগঠনটির সভাপতি সেক্রেটারির উদ্যোগে এবং যুগ্ম সম্পাদক কৃষিবিদ মোঃ সোহরাব হোসেন সুজনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বিশেষ অতিথি হিসেবে ডাকা হয় শহীদ এটিএম খালেদ দুলু-র সহোদর ছোটভাই এটিএম জাহিদ হাসান বাবুকে, যাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ১ম শহীদ এটিএম খালেদ দুলু (বীরপ্রতীক) শ্রদ্ধা-স্বারক।

উল্লেখ্য ১১ জানুয়ারি দিনটিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল "শহীদ খালেদ দিবস" হিসেবে শ্রদ্ধাভরে পালন করে আসছে। ৪৩ তম শাহাদাত বার্ষিকীতে শহীদ এটিএম খালেদ ভাইএর  বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি-মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন উনাকে জান্নাত নসীব করেন, আমিন।

লেখকঃযুগ্ম সাধারণ সম্পাদক,বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল