এগ্রিলাইফ২৪ ডটকম: নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন”শিক্ষা লাভ করা সকল নর-নারীর অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু আমাদের সমাজ সর্বদা তাহা অমান্য করিয়াছে”। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের সামাজিক ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট মোটেই শিক্ষাবান্ধব ছিলো না। তখন বাল্যবিবাহের প্রকোপ ছিলো সামাজিক ব্যধির মতো। সেই সময় কন্যা সন্তানের উচ্চ শিক্ষার পথটাও ছিলো বন্ধুর ও কণ্টকময়।
গতকাল ( ৯ ডিসেম্বর) মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দিক নির্দেশনায় ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে আর্ন্তজাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ এবং বেগম রোকেয়া দিবস উৎযাপন উপলক্ষে জয়িতা সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি মাননীয় ডিসি মহোদয়ের কাছ থেকে ড. সাজেদা সুলতানা জয়িতা ক্রেস্ট (শিক্ষা ও চাকুরী ক্যাটাগরিতে) জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে গ্রহণ করেন।
রাজধানী ঢাকা শহরের নিকটবর্তী জেলা গাজীপুর এবং এই জেলার একটি পুরাতন উপজেলা কালীগঞ্জ। ঢাকার নিকটবর্তী হলেও উন্নয়নের দিক থেকে ছিলো অনেক পিছিয়ে। এ যেনো প্রদীপের নিচে অন্ধকার। এই উপজেলারই নাগরী ইউনিয়নের গাড়ারিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: আবুল বাশার এবং জয়িতা পুরস্কারপ্রাপ্ত মা (জেলা পর্যায়ে প্রথম এবং বিভাগীয় পর্যায়ে দ্বিতীয়) মাকসুদা বেগমের তৃতীয় সন্তান হলেন ড. সাজেদা সুলতানা।
সেই গ্রামের গর্বের ধন হয়ে উঠেছেন তিনি। পিতা মাতা দুজনই ছিলেন স্কুল শিক্ষক। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন স্কুল শিক্ষকের পরিবারের গল্পটি যেমন হয়, জনাব আবুল বাশার সাহেবের গল্পটিও ঠিক তেমন। সীমিত উপার্জন কিন্তু ব্যয়ের খাতা যেনো মহাসমুদ্র। দাদা-দাদী চার সন্তানসহ মোট আট জনের পরিবার ছিলো টানা-পোড়নের সংসার। পরিবারের বড়ই আদরের মেয়ে ছিলেন সাজেদা সুলতানা, কিন্তু দিনশেষে তার পরিচয় একজন মেয়ে হিসেবেই। আর সমাজ বাস্তবতায় একজন মেয়ে যখন বড় হয়ে ওঠে সে যেন আর মানুষ থাকে না, তার পরিচয় হয় “বোঝা” হিসেবে যেখানে থাকে হাজারও প্রতিবন্ধকতা। এলাকার শিক্ষিত পরিবার বলেই হয়তো পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা কম ছিল তার, কিন্তু সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক প্রতিবন্ধতা থেকে নিস্তার মেলেনি। কিন্তু তিনি সমস্ত বাঁধাকে উপেক্ষা করে স্বপ্ন পূরণের পথে ছুটেছেন, কেবল ছুটেছেন। কারণ তার মস্তিষ্কে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন। লেখাপড়া করে সুশিক্ষিত মানুষ হতে হবে! সেই বাসনা থেকেই বিদ্যুৎবিহীন নাগরী ইউনিয়নে হ্যারিকেন কিংবা কুপির আলোয় লেখাপড়া করে নিজেকে আলোকিত করেছেন।
প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক কোন ক্লাসেই প্রথম স্থান হাতছাড়া হতে দেননি। হয়তো তার স্বপ্নই তাকে পৌঁছে দিয়েছিল সফলতার শ্রেষ্ঠতম পর্যায়ে। বাগদী স্কুল হতে ১৯৯৭ সালে কৃতিত্বের সাথে স্টারমার্কসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। যেখান থেকেই শুরু জীবনের সফলতার সূচনা। যদিও এ অর্জনের জন্য দিতে হয়েছিল অনেক শ্রম আর মেধার পরিচয়। পরবর্তী পর্যায়ে ঢাকা শহরের বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হন। ঘর ছেড়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক শহরে ঠাঁই নিয়েছিলেন। হয়তো সে শহর নিজ উপজেলার কোলঘেঁষেই কিন্তু আজব সে শহরে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাকে।
১৯৯৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিকেও তিনি কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হবেন, কিন্তু ভাগ্য বোধয় সেভাবে চায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজি বিভাগে সুযোগ পেয়েও ভর্তি হননি। কারণ বিষয়টি তার আগ্রহের তালিকায় ছিলো না। পরবর্তীতে সুযোগ মেলে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে ভেটেরিনারি সাইন্স-এ প্রথম শ্রেণিতে ডিভিএম ডিগ্রি অর্জন করেন। জ্ঞান আহরণের বাসনা তাঁকে অদম্য করে তোলে। থেমে থাকেননি, একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্যাথলজি-তে প্রথম শ্রেণিতে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। গ্রামের মেয়েদের বেড়ে ওঠা, শিক্ষাজীবন চালিয়ে যাওয়া যে কি কঠিন কেবলমাত্র তারাই জানেন। ড. সাজেদা সুলতানাও হয়তো এর বাইরে ছিলেন না। একদিকে কঠিন সংগ্রাম করে টিকে থাকা, অন্যদিকে বিয়ের চাপ, সামাজিক চাপ, আরও কত কি! না বলা যাতনাগুলো যেন সফল নারীরা চাপা দিয়েই রাখেন। এমএস ডিগ্রি অর্জনের পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
শিক্ষাজীবন শেষে শুরুতেই যোগ দিয়েছেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা (FAO)-তে। পাশাপাশি অংশগ্রহণ করেন ২৭ তম বিসিএস-এ। সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে সুপারিশপ্রাপ্ত হন বিসিএস (প্রাণিসম্পদ) ক্যাডারে। যোগ দেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ভেটেরিনারি সার্জন হিসেবে। কিন্তু তিনি বোধ হয় ভিন্ন ধাতুতে গড়া! তাঁর বাসনা যেন ভিন্ন! একদিকে জ্ঞান আহরণের সন্ধান অন্যদিকে নিজের অর্জিত জ্ঞান বিলিয়ে দেবার প্রয়াস! বিসিএসের চাকরি ছেড়ে ২০১৩ সালে তিনি ঢাকাস্থ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। জীবনের গল্পের পাতায় এরই মধ্যে যুক্ত হয়েছে সংসার, দুই সন্তান। স্বামী জনাব মো: মইনউদ্দিন খন্দকার প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। তাই সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব একাই পালন করতে হয়েছে। তবুও উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ফেলোশিপ প্রাপ্ত হয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগ থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। ধাপে ধাপে জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে বর্তমানে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন এবং ২য় বারের মতো বিভাগীয় চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
দেশে ও বিদেশের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে ১৫টিরও বেশি গবেষণাপত্র। তিনি বাংলাদেশ ভেটেরিনারি এসোসিয়েশনের একজন নির্বাচিত সদস্য। এছাড়াও ভেটেরিনারি সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রফেশনাল ফোরামে কার্যনির্বাহী কমিটিতে কার্যকরী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনিই সম্ভবত কালীগঞ্জের নাগরী ইউনিয়নের প্রথম পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনকারী নারী। গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। সংসার-সন্তান, চাকুরিজীবন, সবকিছু রেখেও পোস্ট ডক্টরেট করার স্বপ্ন দেখেন এই নারী।
আগামী দিনগুলিতে আরো ভালো কিছু কাজ করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন ড. সাজেদা সুলতানা। এজন্য তিনি বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী সহ সংশ্লিস্ট সকলের নিকট আন্তরিক দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করেছেন।