কাজী তাহমিনা আক্তার:“আদা, ঔষধের আধা”, “এক টুকরো কাঁচা আদা হাজারো রোগ ব্যাধির মুক্তিদাতা” ইত্যাদি প্রবাদের প্রচলন শুধু নয়, শিরে সংক্রান্তি এলেই বাঙ্গালির আদা জল খেয়ে লেগে পড়ার প্রয়োজন আজও দেখা যায়। আদার গুরুত্ব নিয়ে বাঙালির প্রবাদ শুধু কথার কথা নয়, এর পেছনে রয়েছে আদার বহুমাত্রিক ভেষজ গুণাবলীর ভূমিকা।
আদা (বৈজ্ঞানিক নাম: (Zingiber officinale) সুগন্ধী ও ঝাঁঝালো স্বাদ সমৃদ্ধ এক সুপরিচিত মসলাই নয় বরং এটি এমন একটি ভেষজ ঔষধ যা ছিলো প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থার এক অপিরহার্য উপাদান। প্রাচীন চীনা ও ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে আদা বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে ঐশ্বরিক এক উপহার হিসেবে গণ্য হতো। গ্রীক সভ্যতা থেকে শুরু করে এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন গবেষণালব্ধ দলিলে সাধারণ রোগ চিকিৎসায় টনিক হিসাবে আদার ঔষধীগুণ ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়।
আদা পুষ্টিগুণ বিবেচনায় এক অসাধারণ মসলা ও ভেষজ চিকিৎসা উপাদান। প্রতি ১১০ গ্রাম আদায় রয়েছে ৮০ ক্যালরী শক্তি, ১৭ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ০.৭৫ গ্রাম ফ্যাট বা চর্বি, ৪১৫ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম এবং ৩৪ মিলিগ্রাম ফসফরাস। এছাড়াও, আদায় বিদ্যমান অন্যান্য উপাদান সমূহের মধ্যে রয়েছে সোডিয়াম (১৩ মি. গ্রা.), আঁশ (২ গ্রাম), প্রোটিন (১.৮ গ্রাম), ভিটামিন বি (৬.১০ গ্রাম) ভিটামিন সি (৮ গ্রাম), আয়রন (৩ গ্রাম) এবং ম্যাগনেসিয়াম (১০ গ্রা.)। রোগ প্রতিরোধে আদার এসকল উপাদান অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করে।
আদার বহুবিধ ব্যবহার
ব্যাথানাশক হিসেবে আদাঃ আদা শরীরের যে কোন ধরনের ব্যাথা কমাতে টনিক হিসেবে কাজ করে। অসটিও আর্থ্রাইটিস এবং রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের কারণে শরীরে বিভিন্ন হাড়ের জোড়ার ব্যাথানাশক হিসেবে আদার জুড়ি নাই। এছাড়া মাইগ্রেনের ব্যাথা, মেয়েদের ঋতুস্রাবকালীন ব্যাথা কমাতেও আদা কার্যকর। তাছাড়াও, কানের ব্যাথায় তিন থেকে চার ফোঁটা হালকা গরম আদার রস দুই থেকে চারদিন ব্যবহারে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়।
হার্ট ভালো রাখতে আদাঃ রক্তের অনুচক্রিকা এবং ধমনীর চাপ দূর করে হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম ঠিক রাখা এবং শরীর শীতল রাখতে আদার রস খুব কার্যকর পানীয়। আদায় থাকা ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যামাইনো অ্যাসিড শরীরে রক্ত চলাচল বাড়ায় এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে। এটি ধমনি থেকে অতিরিক্ত চর্বি অপসারণ করে, যা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে প্রাকৃতিক উপাদান হিসেবে কাজ করে।
ক্ষত শুকাতে ও রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখতে আদাঃ আদায় বিদ্যমান বিভিন্ন উপাদান যেমনঃ ক্রোমিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক শরীরের রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক রাখে। অপরদিকে আদায় উপস্থিত অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান যেকোন কাঁটাছেড়া বা ক্ষতস্থান দ্রুত শুকাতে সাহায্য করে।
আদা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করেঃ গবেষণায় দেখা গেছে, মধুমিশ্রিত আদার রস দেহের শ্বেতরক্ত কণিকার পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং আদার রস দাঁতের মাড়িকে শক্ত করা, দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা জীবাণু ধ্বংস করাসহ দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আদা ক্যান্সার রোধ করেঃ আদায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা শরীরে উপস্থিত ক্ষতিকারক উপাদান বের করে দেয় এবং ক্যান্সার সেল তৈরী হবার আশঙ্কা কমায়। উল্লেখ্য, মধুমিশ্রিত আদার রস ক্যান্সার প্রতিরোধে অধিক সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
আদা ফুসফুসের জন্য উপকারীঃ গবেষণায় দেখা গেছে ফুসফুসের সাধারণ সংক্রমণ এবং শ্বাস- প্রশ্বাসজনিত সাধারণ সমস্যা দূর করে গলা ও স্বরতন্ত্রী পরিষ্কার রাখে আদা।
ঋতু পরিবর্তনজনিত হালকা রোগে আদার ব্যবহারঃ আদায় থাকা অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান ঋতু পরিবর্তনজনিত ঠান্ডা, কাশি, জ্বর জ্বর ভাব, গলাব্যাথা ও মাথাব্যাথা নিরাময়ে কাজ করে। মধুর সাথে আদার রস ভাইরাস জ্বর সারাতে ও কফদূর করতে টনিক হিসাবে কাজ করে। শুধু তাই নয়, আদা-পুদিনার ক্বাথ ম্যালেরিয়া জ্বর সারাতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে ।
আদা বমিভাব দূর করেঃ গাড়িতে বমি বমিভাব হওয়ার অস্বস্তিদ্বায়ক পরিস্থিতি থেকে দ্রæত মুক্তি মেলে এক টুকরো কাঁচা আদায়। এমনকি এইচআইভি/এইডস চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধের প্রভাবে বমিভাব রোগীদের ঔষধ সেবনের নির্ধারিত সময় পূর্বে আদা খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক।
পেটের পীড়া নিরাময়ে আদাঃ আদা হজমে এবং খাবারের পুষ্টি উপাদান শরীরের বিভিন্ন অংশে পৌঁছে দিতে সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করে। আদা পেটের বদহজমজনিত সমস্যা এবং ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আদাঃ আদা শরীরের কোষে গ্লুকোজের শোষণক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং সেইসাথে ইনসুলিন নিঃসরণ বাড়িয়ে দিয়ে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে। গবেষণায় দেখা যায়, উক্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডায়াবেটিস রোগীর গ্লুকোজের স্তর দীর্ঘমেয়াদি ঠিক রাখাসহ ডায়াবেটিসজনিত কিডনি জটিলতা দূরকরণে আদা কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
ওজন কমাতে আদাঃ আদা ট্রিপসিন এনজাইম ও পেনকিয়াট্রিক লাইপেস এনজাইমে গুরুত্বর্পূণ প্রভাব ফেলে, ফলে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্যের হজম প্রক্রিয়া ও মেটাবলিজম হার ত্বরান্বিত হয়। ফলশ্রুতিতে শরীরের ক্যালরী দ্রুত বার্ণ করতে এবং অতিরিক্ত মেদ বা ওজন কমাতে মোক্ষম উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয় আদা।
চুল পড়া রোধে আদাঃ আদায় উপস্থিত ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, জিঞ্জেরল, ফ্যাটি অ্যাসিড সহ অনান্য উপকারী উপাদান চুলের পুষ্টিঘাটতি পূরণ করে ও চুলের গোড়ায় রক্ত প্রবাহ বৃদ্ধি করে চুল পড়া রোধ করে। এছাড়াও, আদার অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুনাগুন চুলের আর্দ্রতা ঠিক রাখে, খুশকি সমস্যা দূর করে চুলের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধিতে অভাবনীয় কাজ করে। শুধু চুলই নয়, আদার এসকল উপাদান ত্বকে ব্রণ ওঠা বন্ধ করাসহ ত্বক পরিষ্কার ও মসৃণ রাখতে সাহায্য করে।
দাঁতের মাড়ি শক্ত করে আদাঃ গবেষণায় দেখা গেছে আদার রস দাঁতের মাড়িকে শক্ত করে, দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা জীবাণুকে ধ্বংস করে।
মনোসংযোগ ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে আদাঃ আদার অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান মস্তিষ্কের টিস্যু সুস্থ রাখতে ও মস্তিষ্কের শক্তি বৃদ্ধিতে দারুণ কার্যকরী। এর ফলে, কাজে মনোযোগ বৃদ্ধি পায়।
এছাড়াও, আদার কার্যকারিতা বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আদা চা সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে শরীর ও মনকে সতেজ করে তুলে। এমনকি, তুলসী পাতার রসের সাথে আদার রস বসন্ত চিকিৎসার ক্ষেত্রে দ্রুত গুটি বেড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে বলে দেখা গেছে। আমাশয় ও জন্ডিসসহ ইত্যাদি সমস্যায়ও আদার প্রায়োগিক উপকার প্রাচীনকাল থেকে লক্ষ্যণীয়। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখা জরুরী রান্না করা আদার তুলনায় কাঁচা আদা অধিক কার্যকরী।
আদার ভেষজ গুণাবলীর কারণে গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় আদার ফার্মাকোলজিক্যাল এবং শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া যাচাইকরণে গবেষণা বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, আদার ভেষজ গুণাগুণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
আদায় শরীর উদ্দীপক উপাদান উপস্থিত থাকায় পেশীর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়তা করে। অনেকক্ষেত্রে গর্ভকালীন অবস্থায় অতিরিক্ত আদা খেলে পেশীর সংকোচন ঘটতে পারে । ফলে মহিলাদের প্রিম্যাচিওর শিশু জন্মের সম্ভাবনা থাকে। তাই গর্ভাবস্থায় দিনে ২৫০ গ্রামের বেশি আদা খাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রেও চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া আবশ্যক। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, আদা ডায়াবেটিসের ও উচ্চরক্তচাপের মাত্রা কমাতে কার্যকর ভ‚মিকা পালন করলেও এসব রোগ নিয়ন্ত্রনের জন্য ঔষধ সেবনকারীরা আদা খেতে পারবেন না। অপরদিকে, আদা শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে অতিরিক্ত মেদ দূরীকরণ, উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস সমস্যায় উপকারি ভূমিকা রাখলেও উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ঔষধ সেবনকারীদের চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত আদা খাওয়া এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। কারণ আদা অ্যান্টিকোয়াগুলান্ট, বিটা-ব্লকারস বা ইনসুলিনের মতো ওষুধের প্রভাব কমিয়ে দিতে পারে। এছাড়াও, রক্তজনিত রোগ যেমন হিমোফেলিয়া সমস্যা থাকলে আদার এইগুণ নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। হিমোফেলিয়ার ঔষধের সাথে আদা খেলে তা ঔষধের গুণ নষ্ট করে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা আরও বলেন, গলস্টোন সমস্যা থাকলেও চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত আদা খাওয়া যাবে না। আদা চর্বি গলানোর প্রক্রিয়ায় ত্বরান্বিত করে খিদে কমিয়ে দেয়। তাই যাঁরা ওজন বাড়াতে চায় তাদের আদার ব্যবহার পরিহার বা এড়িয়ে চলা প্রয়োজন।
পরিশেষে বলা যায়, বিবিধ গুণের কারণেই আদা খাবারের স্বাদ বৃদ্ধির জন্য খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত একটি অনস্বীকার্য মসলার সাথে সাথে হাজার বছর ধরে চলে আসা ভেষজ ঔষধ। সেজন্য, আমাদের দৈনন্দিন বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরিমিত মাত্রায় আদা খাওয়া উচিৎ।
-লেখক-বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ- ২২০২।