সমীরণ বিশ্বাস:
মাটি কাকে বলে:
মাটি বা মৃত্তিকা হলো পৃথিবীর উপরিভাগের নরম আবরণ। পাথর গুঁড়ো হয়ে সৃষ্ট খনিজ পদার্থ এবং জৈব যৌগ মিশ্রিত হয়ে মাটি গঠিত হয়। জৈব পদার্থের উপস্থিতিতে ভূমিক্ষয় আবহবিকার, বিচূর্ণিভবন ইত্যাদি প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে পাথর থেকে মাটির উদ্ভব হয়েছে। সে কারণে অতি প্রাচীন কালের মাটি পৃথিবীতে পাওয়া যায় না । উদ্ভিদ জন্মানোর উপযোগী খনিজ, জীব ও জৈব সমন্বয়ে গতিশীল প্রাকৃতিক বস্তুকে মাটি বা মৃত্তিকা বলে ৷ মাটি হচ্ছে কঠিন পদার্থের ছোট ছোট টুকরা, পানি ও বায়ুর সমন্বয়ে গঠিত যৌগিক পদার্থ। উদ্ভিদ জন্মানোর উপযোগী খনিজ, জীব ও জৈব সমন্বয়ে গতিশীল প্রাকৃতিক বস্তুকে মাটি বা মৃত্তিকা বলে ৷ পৃথিবীর উপরিভাগের যে নরম স্তরে গাছপালা মূল স্থাপন করে রস শোষণ করে জন্মায় ও বৃদ্ধি পায় তাকে মাটি বলে ৷ মাটি বা মৃত্তিকা হলো পৃথিবীর উপরিভাগের নরম ও দানাদার আবরণ। পাথর গুঁড়ো হয়ে সৃষ্ট খনিজ পদার্থ এবং জৈব যৌগ মিশ্রিত হয়ে মাটি গঠিত হয়। মাটি বিশ্বের সবচেয়ে বিস্ময়কর জাদুকরি বস্তু ।
মাটি প্রধান উপাদান :
১৷ খনিজ পদার্থ - ৪৫% ২৷ জৈব পদার্থ - ৫% ৩৷ বায়ু - ২৫ % ৪৷ পানি - ২৫% ।
মাটির মধ্যে এই জৈব পদার্থের পরিমাণ ৫ % হলেও ইহাকে মাটির লাইভ বা জীবন বলে। যে মাটিতে জৈব পদার্থ থাকে না উহাকে ডেড সয়েল বা মৃত মাটি বলে। অর্থাৎ মৃত মাটিতে কোনোভাবেই ফসল ফলানো সম্ভব নয়। এজন্য মরুভূমিকে ডেড সয়েল বলা হয়। অর্থাৎ মরুভূমির মাটিতে জৈব পদার্থ না থাকায় ওই মাটিতে কোন প্রকার উদ্ভিদ বা ফসল জন্মায় না । মানুষ সৃষ্টির আগে মহান সৃষ্টিকর্তা মাটিকে সৃষ্টি করেছিলেন ১০৫টি উপাদানের সমন্বয়ে। তার ভেতর ১৬টি উপাদানকে উদ্ভিদের মূল খাদ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন মৃত্তিকা গবেষকরা। মাটির মূল ১৬টি উপাদানের মধ্যে অক্সিজেন, কার্বন ও হাইড্রোজেন পেয়ে থাকে বাতাস এবং পানির মাধ্যমে। গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নাইট্রোজেন সিংহভাগ প্রাকৃতিকভাবে পেয়ে থাকে মেঘ চমকানো বিদ্যুৎ ও কুয়াশা থেকে। অন্য উপাদানগুলোও মাটি প্রাকৃতিকভাবে পেলেও তার খাদ্য চাহিদার তুলনায় কম। মাটির অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদান যেমন- নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান মাটিতে যুক্ত থাকে।
মাটির প্রকারভেদ:
১. এঁটেল মাটি ২. বেলে মাটি ৩. দোআঁশ মাটি
মাটির বৈশিষ্ট্য:
এঁটেল মাটি: এটেল মাটিতে বালু অপেক্ষা পলি ও কাদার ভাগ বেশি থাকে। এ কাদা মাটি খুব নরম, দানা খুব ছোট ও মিহি। এ মাটি বেশি পানি ধরে রাখতে পারে। এ মাটিতে ভালভাবে বাতাস চলাচল করতে পারেনা। এ মাটি সব ফসলের জন্য তেমন উপকারী নয়, তবে ধান চাষ করা যায়।
বেলে মাটি: বেলে মাটিতে বালির ভাগ বেশি থাকে। এ মাটির পানি ধারন ক্ষমতা কম।বেলে মাটিতে ফসল তেমন ভাল হয় না তবে তরমুজ শসা, বাঙ্গী, চীনাবাদাম, মিষ্টি আলু ইত্যাদি ভাল জন্মে।
দোআঁশ মাটি: দোআঁশ মাটিতে বালি, পলি ও কাদা সম পরিমানে থাকে। এ মাটির পানি ধারন ক্ষমতা মাঝারী। চাষাবাদের জন্য দোআঁশ মাটি উপযুক্ত। এ মাটিতে ধান, পাট, গম, পিয়াজ, মরিচ, ভূট্টা, আলু, শাকসবজি ইত্যাদি ভাল জন্মে।
বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস:
বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস (World Soil Day) প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর উদযাপন করা হয়। ২০০২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সয়েল সায়েন্স (IUSS) কর্তৃক মাটি নিয়ে প্রতি বছর একটি উৎসব বা অনুষ্ঠান করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক দিবস নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়। থাইল্যান্ড এর রাজার নেতৃত্বে এবং গ্লোবাল সয়েল পার্টনারশিপ এর কাঠামোর মধ্যে, FAO বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির প্ল্যাটফর্ম হিসাবে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের আনুষ্ঠানিক যাত্রা বা সূচনাকে সমর্থন করে। ২০১৩ সালের জুনে, এফএও সম্মেলন বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের দিনটি ঠিক হয় এবং পরে ৬৮ তম জাতিসংঘ জাতীয় সাধারণ পরিষদের কাছে এই দিনটি পাঠানো হয় যাতে জাতিসংঘ ৫ ডিসেম্বরকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত্তিকা দিবস হিসাবে গ্রহণ করে।
বাংলাদেশের মাটি ও কৃষি:
বাংলাদেশে চালানো এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষি জমির জৈব উপাদান কমে গেছে, যার ফলে ফসল উৎপাদনে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হচ্ছে। এই গবেষণায় বলা হয়েছে, ফসলি জমিতে যেখানে ৫ শতাংশ জৈব উপাদান থাকা দরকার সেখানে দেশের বেশিরভাগ কৃষি জমিতে জৈব উপাদান দুই শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। বাংলাদেশের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৫৬ শতাংশ জমিতে ফসলের আবাদ হয়। দেশটির আবাদি জমি, বনভূমি, নদী, লেক, বনাঞ্চল মিলিয়ে মোট জমির পরিমাণ এক কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ জমিতেই জৈব উপাদানের ঘাটতি রয়েছে। কৃষি জমির অবক্ষয় নিয়ে ২০০০ সালে একটি গবেষণা করা হয়েছিল। এর পর চলতি বছর একই ধরণের আরেকটি গবেষণা চালালে দেখা যায় যে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন অধিদপ্তরের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাগন বলেন, সাধারণত মাটিতে ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের মতো দেশে যেখানে উষ্ণ আবহাওয়ার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া এবং তাপমাত্রার ঘন ঘন পরিবর্তন বিভিন্ন বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনিত কারণে জৈব পদার্থ বেশি বিয়োজন হয়। তাই আমাদের মাটিতে সাড়ে তিন পার্সেন্ট জৈব পদার্থ থাকলেও হয়। "আমরা দেখেছি যে, জমিতে এই পরিমাণ ২ শতাংশের নিচে এমনকি কোথাও কোথাও ১ শতাংশের নিচে রয়েছে। মাটির জৈব উপাদানকে মাটির প্রাণ বলে অভিহিত করেন কৃষিবিদ এবং বিজ্ঞানীরা।
মাটির উন্নয়নে বর্জনীয় :
কৃষি কাজে শুধু মাত্র একক মাটিকে ব্যবহার না করা ।অতিরিক্ত এবং অনুপযুক্ত চাষাবাদ পরিহার করা। অতিরিক্ত সেচ পরিহার করা। জমিতে অতিমাত্রায় গোচারণ বন্ধ করা। প্রচলিত এক ফসলি চাষাবাদ বন্ধ করা। সারের অপব্যবহার বন্ধ করা সহ অপব্যবহার এবং কম ব্যবহার করা।
মাটি উন্নয়নে করণীয়:
শস্যের বৈচিত্র মিশ্রণ, আন্তঃ ফসল, ফসলের আবর্তন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা। সার এর ব্যবহার যথাযথভাবে নিয়ম মেনে চলা। টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা মেনে চলা। টেকসই চারণ এবং চারণভূমি ব্যবস্থাপনা করা। জৈব সার ,মালচিং, উদ্ভিদের অবশিষ্টাংশ, সবুজ সার যুক্ত করা। হ্রাসকৃত ভূমিকর্ষন পদ্ধতি অবলম্বন করা ।
কৃষিকে আরো ত্বরান্বিত করতে হলে মৃত্তিকা সম্পদ ও সম্প্রসারণে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গবেষণার মাধ্যমে সার সুপারিশমালার ভিত্তিতে আবাদ করতে হবে। তাহলে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার হ্রাস পাবে। মাটিও থাকবে নিরাপদ। উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার মূলে কাজ করছে কৃষির ব্যাপক সাফল্য; আর এ সাফল্যকে ধরে রাখতে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের কৃষি ও মাটির দিকে আরও অধিকতার মনোযোগ দেওয়া অতীব জরুরী। এটি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, দেশকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে, কৃষির অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখতে হবে। দেশের ১৭ কোটি মানুষকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করছে কৃষি।
তাই কৃষির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হলে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপরই প্রভাব ফেলবে। তাই আগামী দিনে কৃষি ও কৃষকের সার্বিক কল্যাণে শুধু রাসায়নিক সারই নয়, মাটির প্রান জৈবসারে প্রয়োজনীয় ভর্তুকির ব্যবস্থা করে দেশের কৃষিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবেন সংশ্লিষ্ট মহল । আর এই প্রত্যাশাই আগামীতে তৈরি হবে টেকসই, পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তায় সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশের, স্মার্ট কৃষি ।
-লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।