প্রফেসর ড. খান মো: সাইফুল ইসলাম: কি হেডলাইন পড়ে রাগ করছেন ? দয়া করে রাগ করবেন না। এক সময় চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কোন একজন মনীষী বলেছিলেন” বেশী করে আলু খান, ভাতের উপর চাপ কমান’। কে বলেছিলেন ঠিক মনে নেই। তবে তিনি কথাটি বলেছিলেন এমন একটি সময় যখন চালের বাজার দর ছিল জাতীয় অর্থনীতির মানদন্ড। কারন ভাতই বাঙালীর প্রধান খাবার ছিল। আর আলু ছিল অনেক সস্তা। আজ আবস্থা বিবেচনায় আমি সাহস করে সেই মহান বাক্যের বিপরীতে অবস্থান নিলাম আর লেখাটি প্রচারের জন্য প্রকাশককে অনুরোধ করলাম। তার মানে আমি কিন্তু বলছি না যে, আপনি বেশী বেশী ভাত খাবেন। ভাত আপনি কিন্তু এমনিতেই বেশী বেশী খাচ্ছেন। কম খাচ্ছেন দুধ, ডিম, মাংস, সব্জি আর ফল। এখানে আপনি বলতে কিন্তু আপনাকে বোঝাইনি বরং দেশের সকল মানুষকে বুঝিয়েছি।
আরে ভাই এত আলু আলু করেন কেন ? আলু না খেলে কি হয়? আলু কিন্তু ভাতের পরিপুরক মাত্র। কোন কোন দেশে আলু প্রধান খাবার। আবার কোন কোন দেশে ভাত প্রধান খাবার । বাংলাদেশে আলু ব্যবহার করা হয় তরকারী হিসেবে। আচ্ছা তরকারী হিসেবে কি আলু অতো ভাল যত না ভাল অন্যান্য সব্জি? আপনারা আলু আলু বলে জিকির করেন বলেই ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেয়। আর তাই আপনাদের চেহারা আলুর মত হয়ে যায় । আলুময় চেহারা করে ৫০ টাকার আলু ৩০ টাকায় ক্রয় করার জন্য টি.সি.বি-র ট্রাকের পিছনে লাইন ধরে সারাটা দিন ব্যয় করেন। এসব দেখে আমার মনে পড়ে যায় গ্রাম থেকে প্রথম শহরে আসা বুদ্ধিমান লোকের কথা। লোকটি প্রথম শহরে এসে আবাক হয়ে একটি বহুতল ভবনের তলা গুনছিল। শহরের এক মস্তান এসে কি করছে জিজ্ঞেস করায় সে বলল যে, সে ভবনটি কত তলা তা গুনছে। মাস্তান বলল যে, তলা গুনলে টাকা দিতে হয়। গ্রামের লোকটি বুদ্ধি করে ৫ তলা বলল। আসলে সে ১০ তলা গুনেছে।
যদিও আলু ও ভাত দুটি আলাদা খাদ্য তবুও তো এরা পরিপুরক। ভাতের উপর চাপ কমানোর জন্য একসময় আমিও টিভিতে আলুর পক্ষে প্রচারনা করেছিলাম । আমি নিশ্চিত কোন মহান ব্যক্তিত্ব কথাটি বলেছিলেন। আর তাই আমরা সবাই তার সংগে তাল মিলিয়ে কথা বলতাম। কার এমন সাহস অন্য কথা বলে। কথাটি কিন্তু বাস্তব অর্থে সঠিক নয়। আমি যদি হিসাব কষে দেখাই তবে সহজেই আলুর দাম শুনে কেউ আর আলুর মত চেহারা করবেন না ।
আমরা বাজার থেকে যে আলু ক্রয় করি তাতে রয়েছে ৭৭% পানি। আর বাকী ২৩% অংশে রয়েছে শর্করা, আমিষ, খনিজ, চর্বি, ভিটামিন সহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদান। অন্যদিকে বাজার থেকে যে চাল কিনে থাকি তাতে রয়েছে মাত্র ১৪% পানি। আর বাকী ৮৬% অংশে রয়েছে শর্করা, আমিষ, খনিজ, চর্বি, ভিটামিন সহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদান। আমরা যদি পানি বাদ দিয়ে হিসাব করি তবে বাজার থেকে ১ কেজি আলু ক্রয় করলে ২৩০ গ্রাম পুষ্টি উপাদান ক্রয় করছি। ঠিক তেমনি ১ কেজি চাল ক্রয় করলে ৮৬০ গ্রাম পুষ্টি উপাদান ক্রয় করছি।
দুর্মুল্যের বাজারে চাল ও আলুর বাজারদর প্রায় একই। যদি আলুর মূল্য আনুমানিক ৩০ থেকে ৫০ টাকা হয় তাহলে ৩০ থেকে ৫০ টাকার বিনিময়ে আমরা ২৩০ গ্রাম আলুতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদান কিনছি । আর যদি চালের মূল্য আনুমানিক ৪০ থেকে ৫০ টাকা হয় তাহলে ৪০ থেকে ৫০ টাকায় চালে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদান কিনছি ৮৬০ গ্রাম। যদি পানি বাদ দিয়ে কেবল মাত্র অন্যান্য পুষ্টি উপাদান ১০০% ধরে হিসাব করি তবে ১ কেজি আলুর মূূল্য হবে (৩০ থেকে ৫০ টাকা/০.২৩) ১৩০ থেকে ২১৭ টাকা আর চালের মূল্য হবে (৪০ থেকে ৫০ টাকা/০.৮৬) ৪৬.০০ থেকে ৫৮.১০ টাকা । হিসাব অনুযায়ী আকাশ পাতাল পার্থক্য । এছাড়া আলুতে রয়েছে কেবল মাত্র ২.০% আমিষ যা চালে রয়েছে ৬.৫%। আলুতে স্টার্চ রয়েছে ১৭.৫% যা চালে ৭৭.০% বিদ্যমান। আলুর চেয়ে চালে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন সহ খনিজ উপাদান বেশী রয়েছে । চাল যদি পলিশকৃত না হয় তবে ভিটামিন ও খনিজের পরিমান আরও বেশী থাকে ।
সকল বিবেচনায় প্রকৃত অর্থে আলু ক্রয়ের মাধ্যমে আমরা পুষ্টি উপাদান ক্রয়ে চালের তুলনায় ৩ তেকে ৪ গুন অধিক অর্থ ব্যয় করছি। কিন্তু কেন? আলু কি আমাদের প্রধান খাবার? আলু কি সব্জি হিসেবে অন্য সব্জির তুলনায় ভাল মানের? দুটির কোনটিই নয়। কেবল মাত্র আলুর বহুবিধ ব্যাবহারই আমাদেরকে আলুময় করে তোলে। এছাড়া আলুর মূল্য বৃদ্ধির ব্যপক প্রচারনা আমাদেরকে আলুর প্রতি আবেগময় করে তোলে। আর আমাদেরকে ইমোশনাল ব্ল্যাক মেইল করে ভোক্তা প্রেমিক ব্যবসায়ীগন। আসুন আমরা আলুর প্রতি আবেগ প্রবন না হয়ে কিছুটা ধৈর্য্য ধরি। আশা করি পুষ্টি উপাদান বিবেচনা করে আবার ভাত খাওযা বাড়িয়ে দিবেন না। কেবলমাত্র আলুময়তা ত্যাগ করুন।
লেখক:পশু পুষ্টি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল:This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.