মোঃ রওশন জামাল জুয়েল,পিএইচডি ফেলো, অস্ট্রেলিয়া:চৈতন্যের গহিনে জীবনের প্রতিচ্ছবি আর কালের পদচিহ্ন খুঁজি। মাঝে মাঝে বড্ড মেঘ করে এলে খুঁজে ফিরি এক চিলতে সোনারোদ আর অস্তিত্বে গেঁথে থাকা প্রিয়মুখের ক্যালিগ্রাফি। চেতনার আষ্টেপৃষ্টে গেথে থাকা এক মহান ব্যক্তির পদচিহ্ন অনুভুত হয় অন্তরের পলল জমিনে। কালের ঢেউ ভেঙ্গে ঘাটের কোলে এক মহান স্কুল শিক্ষকের ছোট্ট তরী ডাক দিয়ে যায়, জীবনের গান গেয়ে যায়। পদ্মাচরের বিজন বালুচরে নদীর ঢেউ ভাঙ্গা শব্দের মাঝে জীবন খুঁজতে শিখানো জনপদের এক রাখাল রাজা- আমাদের সকলের প্রিয় শাহজাহান স্যার। শিক্ষা, সংস্কৃতি, জীবনবোধ, আর আত্মার ভবসাগরে এক মহান সম্রাট। অন্তরে প্রথম প্রদ্বীপ জ্বেলে দেওয়া এক মহান বাতিওয়ালা। কী এক বর্ণময় মহান জীবন পাড়ি দিয়ে কালের খেঁয়ায় লোকান্তরে।
তিনি গত বছর ৩১ শে জুলাই না ফেরার দেশে চলে গেলেন, রেখে গেলেন তাঁর অস্তিত্বের নির্যাসে গড়া ফিলিপনগর হাইস্কুল, শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত জনপদ আর শিক্ষকতার মহান নিদর্শন। স্বপ্নবাজ এই মহান বীর জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত শোভিত ছিলেন তারই আলোয় আলোকিত ফুলের বিনম্র শ্রদ্ধায়। তিনি কোন জাতীয় ব্যক্তিত্ব বা সেলিব্রিটি ছিলেন না তাই কোন খবরের কাগজের শিরোনাম হননি। কিন্তু রাখাল রাজাকে রাজকীয় বিদায় জানিয়েছিলেন তাঁর হাজারো ছাত্র-ছাত্রী। কী এক মহাকাব্যিক জীবন স্যারের, কী এক গৌরবময় মহাপ্রস্তান স্যারের। এমন জীবন আর হয় ক’জনের। আজ শাহজাহান স্যারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। দুর পরবাসে বসে স্যারের জন্য দু’লাইন শ্রদ্ধাঞ্জলী।
যে শিক্ষকের সামনে গেলে শ্রদ্ধায় ন্যুয়ে পড়ে চৈতন্য তেমন শিক্ষক এখন বিরল। হালজামানায় এমন পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু খুঁজে পাওয়া দায়। জীবনের কী সরল সহজ অথচ বর্ণময় পরিকল্পনা। এইসএসসিতে ১৩তম স্ট্যান্ডধারী মেধাবী যুবক মুহাম্মদ শাহজাহান স্কুলে শিক্ষকতাকেই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ পেশা মনে করলেন। বিএ পাস করার পর থানা শিক্ষা অফিসার হিসাবে চাকুরী শুরু করেছিলেন। তিনি সেই চাকুরী ছেড়ে নাম ফলক ব্যাগে করে বাড়ী নিয়ে চলে আসলেন। নামফলকটি স্যারের শনের ঘরের দেয়ালে সুতা দিয়ে বেধে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন যত্ন করে। গনিতের পন্ডিত স্কলার আফতাব উদ্দীন মিয়া গ্রামের স্কুলটিতে যোগ দেওয়ায় শাহাজাহান স্যার, আবু তাহের স্যাররা উৎসাহিত হলেন। শাহজাহান স্যার সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগ দিলেন ফিলিপনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। শুরু হলো স্বপ্নযাত্রা।
স্যার একজন স্বপ্নবাজ মানুষ। এঁরা পার্থিব লাভ-ক্ষতির তোয়াক্কা না করে নতুন কিছু করার জন্য ঢেলে দেয় জীবনের সবটুকু। এঁরা চারিধারের বাঁধা-সমালোচনা দুপাড়ে মাড়িয়ে স্বপ্নের নির্জাসে গড়ে তোলে নতুন পৃথিবী। স্বপ্নবাজের স্বপ্নের জোঠরেই জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র, নতুন সমাজ, নতুন দিনের কোন নতুন আয়োজন। একজন মার্টিন লুথার, একজন মেন্ডেলা, একজন বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের বীজ বুনেছিলেন স্বাধীনতাকামী, মুক্তিকামী লাখো মানুষের অন্তরে। তাঁদের রক্তের রসে সিক্ত জমিনে ফুটেছিলো স্বাধীনার ও সমৃদ্ধির ফুল। এভাবেই, এভাবেই কেউ না কেউ স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে আসে আধার চরাচরে। ফিলিপনগরের জমিনে এভাবেই স্বপ্নের বীজ বুনেছিলেন চরাঞ্চলের রাখাল রাজা মোহাম্মদ শাহজাহান। সেই স্বপ্নের ফসলে আজ জননীর আঁচল টইটুম্বুর, উঠান ভরপুর স্বপ্নের চৈতালীতে। বালুচর আজ সোনার ফসলে ভরা, ফুলে-ফলে শোভিত। ভাষার পন্ডিত শহাজাহান স্যার তাঁর ছাত্রদের ভাষার ব্যাকরণ কতটুকু শিখাতে পেরেছেন কতটুকু জানিনা তবে তিনি জীবনভর ছাত্রের অন্তরে জ্বেলে দিয়েছেন সম্ভাবনার আলো, জীবন বোধ আর স্বপ্নের পিদিম। নিরবে ঢেলে দিয়েছেন দেশপ্রেমের মন্ত্র, গেঁথে দিয়েছেন বিপ্লব-বিদ্রোহের বারুদ। তাইতো চরের জমিনে আজ স্বর্ণবৃক্ষ, সোনালী ফসল।
মহান জাতীয় সংসদ থেকে সচিবালয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণাগার, প্রযুক্তি থেকে চিকিৎসায়, সিভিল সার্ভিস থেকে জাতীয় নিরাপত্তা- সব জায়গায় মাথা উচু করে দাড়িয়ে ফিলিপনগর চরের সাহসী সন্তানরা। আমৃত্যু স্কাউট আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন শাহজাহান স্যার। কিশোর হৃদয়ে শৃঙ্খলা আর সাহসের বীজ বপন করে গেছেন জীবন ভর। জেলার প্রথম স্কাউট পতাকা ফিলিপনগর হাইস্কুল স্কাউট দলের। স্কুলের প্রথম ব্যাচ থেকেই এসএসসি পরীক্ষায় জেলায় প্রথম ও দ্বিতীয়। ফিলিপনগর হাইস্কুল এখনও জেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ। রেজাল্ট, স্কাউট, ফুটবল, ভলিবল, সংগিত, কবিতা, গান, রাজনীতি সবকিছুতেই সেরা। ৬৭ বছরের ফিলিপনগর হাইস্কুলের স্যারের হাতে গড়া ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অন্তত: ১৫ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে অন্ততঃ ৪০ জন, ডাক্তার অন্ততঃ ৫০ জন, প্রকৌশলী ১০০ জন, কৃষিবিদ ২৫ জন, কর্পোরেট লিডার শতাধিক।
পদ্মা পাড়ের স্কুলটি কুষ্টিয়া জেলার সংস্কৃতির রাজধানী। একুশের বইমেলাতে গড়ে ১০ টি বইয়ের মোড়ক উম্মোচিত হয় ফিলিপনগরের কবি, সাহিত্যিক, লেখকের। শাহজাহান স্যার গ্রামের স্কুলে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, করতে শিখিয়েছেন। বিতর্ক-আবৃতি শিখিয়েছেন। বিপন্ন মানবতার সেবায় কিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় তার দীক্ষা পেয়েছিলাম শাহাজান স্যারের কাছ থেকে। পদ্মার প্রচন্ড ভাঙ্গনে দিশেহারা মানুষের পাশে আমরা স্যারের নেতৃত্বে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম।
সেকালে শিক্ষকতা ছিলো অনেকটা বিনা বেতনে স্বেচ্ছাসেবার মত। স্যার কখনও টাকা নিয়ে প্রাইভেট পড়াতেন না কিন্তু সকাল বিকেল স্যারের বাড়ীতে ছাত্রদের ভিড় লেগেই থাকতো। ছাত্রদের সাথে শ্রদ্ধা মিশ্রিত বন্ধুত্বের চমৎকার একটা শৈল্পিক কৌশল ছিলো স্যারের। নিজের সংসার নিয়ে উদাসীন শাহজাহান স্যারের প্রথম পুত্র কুষ্টিয়া- ১ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য, দ্বিতীয় পুত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্নেল, তৃতীয় পুত্র যুক্তরাজ্য প্রবাসী পরমাণু বিজ্ঞানী। কন্যা রাষ্ট্রায়ত ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার। ধর্মীয় অনুশাসনের প্রথম পাঠ শাহজাহান স্যারের কাছ থেকে। ফিলিপনগর হাইস্কুলে মেয়েদের ইসলামী ড্রেসকোড তিনি বাস্তবায়ন করেছেন। তাঁর সততা আর সাহসের একটা গল্প শেয়ার না করে পারছিনা।
স্যারের বাড়ীর পাশে একটা হত্যাকান্ড ঘটেছিলো স্যার ছিলেন চাক্ষুস সাক্ষী। স্যার ঘোষনা দিলেন তিনি সত্য সাক্ষ্য দিবেন আদালতে। খুনিরা বললো সত্য সাক্ষ্য দিলে স্যারকে মেরে ফেলবে তারা। তিনি অনড় সততার কাছে। তিনি জীবনের তোয়াক্কা না করে আদালতে সত্য সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। খুনিদের সাজা হয়েছিলো। কিন্তু রাতের আঁধারে স্যারের বাড়ীতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো ওরা। আল্লাহ রক্ষা করেছিলেন স্যারের পরিবারকে। তারা ধ্বংশ হয়ে গেছে। কিন্তু স্যারের এই তাকওয়া, সততা ও সাহস উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত হয়ে গেলো। শাহজাহান স্যার ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। স্যারের পুত্র রাজনৈতিক নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি প্রমাণ করে গেলেন একজন শিক্ষক রাজনীতি-দলাদলীর অনেক উপরে।
ভাষার শৈল্পিক বুনন, জীবনের নান্দনিকতা, স্বপ্নের ভবসাগর, জীবন তরীর উজান বাওয়া, আর বৈষয়িক বিষয়াদী তুচ্ছ করে স্বপ্নের আলোয় জীবন দেখার মন্ত্র গেঁথে দিলেন স্বপ্নের বাতিওয়ালা-মুহাম্মদ শাহজাহান স্যার। আফতাব উদ্দীন স্যারের পাশে তাঁর যোগ্য ডেপুটি ক্যাপ্টেন। জীবন নদীর নিরব ভাষা, অন্তরের আদিঅন্ত হাহাকার, কষ্টের বাশরী আর হৃদয় দিয়ে হৃদয় ছোঁয়ার কী এক মন্ত্র শিখালেন তিনি। তাঁর ছাত্রদের অলিন্দে এখনও শিল্প-সাহিত্যের পদ্ম ফোটে, জ্বলে ওঠে জীবনের গান, গল্প-কবিতা, মুকুলিত হয় সংস্কৃতির চিরহরিৎ বৃক্ষ। কিশোরের পলল অন্তরে শৃঙ্খলাবোধ, দেশপ্রেম, চেতনা আর মানবতার বীজ বুনে দিয়েছিলেন আমাদের সর্বশ্রদ্ধেয় শাহজাহান স্যার। তিনি শিখিয়ে গেলেন জগৎ সংসারের উচ্ছাভিলাস আর লোভ ছুড়ে ফেলে কিভাবে জীবনকে সুন্দর ও নান্দনিক করতে হয় জীবনের সৌরভে। মানব জীবনতো এমনই সুন্দর ও মহান। শাহজাহান স্যার তাঁর এক জীবনে প্রগতিশীলতার সাথে ধর্মীয় চেতনার সুন্দর সমন্বয় করে কী এক আলোকিত জীবনের পথ দেখিয়ে গেলেন জীবনভর।
শাহজাহান স্যারের সাথে আমার জীবনের অনেক স্মৃতি। তিনি ছিলেন বন্ধুর মত। স্যারের মেয়ে ফারহানা জাহান তুহিন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে তিনি এসেছেন বাকৃবি ক্যাম্পাসে। স্যারকে ব্রহ্মপুত্র পাড়ে বসে কালের উজান বেয়ে জীবনের গল্প শুনেছি, আগামির স্বপ্ন দেখেছি, স্যারের প্রিয় তিলিখাজা আর পিয়াজু খেয়েছি। বয়সে ব্যবধান ভুলে মিশে গেছি নদী ও প্রকৃতির সাথে।
মেধাবী ছাত্র শিক্ষকতায় আসার অত্যাবশ্যকতা শাহজাহান স্যার, আফতাব উদ্দীন স্যার, আবু তাহের স্যাররা জাতিকে জানিয়ে গেলেন। শাহজাহান স্যার কোন জাতীয় ব্যক্তিত্ব না হতে পারেন কিন্তু তাঁর জীবন, দেশের জন্য ভালবাসা-আত্মত্যাগ কালজয়ী আদর্শ। শিক্ষকতা পেশার ক্রমবর্ধমান ‘ইমেজ ক্রাইসিস’ পুনরুদ্ধারে শাহজাহান স্যার, আফতাব উদ্দীন স্যারদের মত স্বপ্নবাজ শিক্ষকের জীবনালেখ্য জাতিকে জানতে হবে, জানাতে হবে। শাহজাহান স্যারের জীবন চেতনা, আত্মত্যাগ আর স্বপ্ন শিক্ষকতার আদর্শের মহান নিদর্শণ হয়ে থাক। স্যারের মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলী ও দোয়া।