কৃষিবিদ ড. এম. এ. আউয়াল:হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাজ্ঞালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যন্নয়নের জন্য স্বপ্ন দেখেছিলেন কৃষিকে ঘিরে। তিনি বলেছিলেন, ”কৃষিই হবে বাংলাদেশের উন্নয়নের একমাত্র হাতিয়ার”। তাই স্বাধীনতার পর কৃষির উন্নয়নের জন্য নানামুখী উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহন করেন এবং দেশের প্রতি ইঞ্চি জমির সঠিক ব্যবহারের জন্য দেশের মানুষের প্রতি আহবান জানান। শুরু হয় কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের। গড়ে উঠে কৃষির বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং আবিস্কার হতে থাকে ফসলের নুতন নুতন উন্নত জাতের। সমুদ্রের মৎস্য আহরণের জন্য উদ্যোগ গ্রহন করেন। অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা হয় গরুর উন্নত জাত। এভাবেই বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে নিয়ে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেন।
কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এক কালো অধ্যায় তৈরী হয়। পাকিস্তানের পরাজিত শক্ররা দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে দেশকে আবার পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ করে। দেশের কৃষিসহ সকল অগ্রযাত্রা বাধা পড়ে যায়। এরপর ১৯৯৫ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে সামরিক শক্তির আড়ালে স্বৈরাচারী শাসকরা দেশ শাসন করে। পশ্চিমা শাসকদের তাবেদার বিএনপি জামায়াত দেশকে পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে তৈরী করে। মতিউর রহমান নিজামী বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়।
মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা এবং ১৯৮১ সালে বাংলার মানুষের মুক্তির দুত হিসেবে বাংলার মাটিতে পাঁ রাখেন জেল, জুলুম, হুলিয়া উপেক্ষা করে। দেশে ফেরার পর তার যোগ্য নেতৃত্বে আবারো বাংলার মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠে। এরপর দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নের্তৃত্বে ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করেন।
ক্ষমতায় আসার পর জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথ ধরে এগিয়ে চলেন। তার যোগ্য নেতৃত্বে অল্প সময়ের মধ্যেই দেশ খাদ্য ঘাটতি থেকে বেরিয়ে আসে। বর্তমানে তার কৃষিবান্ধব পরিকল্পনার ফলে দেশ আজ শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্নই নয় বরং খাদ্যে উদ্বৃত্ত। দেশের মানুষের জন্য শুধু খাদ্য নিরাপত্তাই নয় সেইসাথে পুষ্টিযুক্ত খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।বাংলাদেশ আজ জননেত্রী শেখ হাসিনার সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনায় কৃষির বিভিন্ন সাব সেক্টরে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলছে। কৃষির পাশাপাশি অন্যান্য সেক্টরেও চলছে উন্নয়নের জয়যাত্রা।
জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে গড়ে উঠেছে যমুনার বুকে বঙ্গবন্ধু সেতু যার মধ্য দিয়ে দেশের উত্তর অঞ্চলের সাথে রাজধানী ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে এবং এর মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতি গতি পেয়েছে। সম্প্রতি প্রমত্তা পদ্মার বুকে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে তিনি সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। দেশের দক্ষিন পশ্চিম অঞ্চলের ২১টি জেলা সরাসরি যুক্ত হয়েছে ঢাকার সাথে যা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হবে। দেশে আরো বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে যার সফল বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশ উন্নত দেশের মহাসড়কে উঠতে যাচ্ছে।
দেশের কৃষির সফলতার সাথে জননেত্রী শেখ হাসিনা অবিচল থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি দেশের খ্যাতনামা কৃষিবিজ্ঞানী, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা আমাদের কৃষিবিদদের অভিভাবক মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক। কৃষিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করার পর তিনি কৃষিতে নিয়ে এসেছেন উদ্ভাবনী কলাকৌশল ও নতুনত্ব। কৃষিকে শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মাননীয় কৃষিমন্ত্রী। দেশে প্রচলিত ফল উৎপাদন বৃদ্ধির পাশপাশি বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছেন উচ্চমুল্যের অপ্রচলিত ফল উৎপাদনের। দেশে আজ প্রচলিত ৫২টি ফলের সাথে যুক্ত হয়েছে নুতন ২০টি অপ্রচলিত উচ্চমুল্যের ফল। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী সনাতনী কৃষিকে বানিজ্যিক কৃষিতে রুপ দিয়েছেন। বাংলাদেশের আধুনিক ও বানিজ্যিক কৃষির প্রবক্তা কৃষিমন্ত্রীর সুযোগ্য নের্তৃত্বে দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিস্কার করে চলছে। সম্প্রসারণ বিভাগ প্রযুক্তি কৃষকদের দোড়গোড়ায় পৌছে দিচ্ছেন। আর তাই দেশ আজ কৃষিতে অপ্রতিরোধ্য।
খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় উন্নয়ন ও রপ্তানী আয়ে অবদান রেখে চলেছে কৃষি। অর্জিত উন্নয়নকে সুসংহত করার জন্য স্থায়ীত্বশীল উৎপাদন ব্যবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সেইসাথে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা বর্তমানে এক বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সম্পদের নুতন উৎসের সন্ধান, মান সম্পন্ন নুতন পণ্যের উদ্ভাবন, বিকাশ এবং তা ব্যবহারের বিকল্প নেই। আজ কৃষির বর্জ্য উদ্ভাবনী প্রযুক্তির কারনে সম্পদে পরিনত হচ্ছে।
কৃষির ফেলনা ও অবহেলিত আনারস পাতা থেকে মান সম্পন্ন ও পরিবেশ বান্ধব সুতা তৈরীর নুতন প্রযুক্তি ইতিমধ্যে দেশ বিদেশে সাড়া ফেলেছে দেশের কয়েকটি এলাকা বিশেষ করে টাংগাইলের মধুপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম ও পাবর্ত্য চট্টগ্রামে বছরে ৫ লাখ টন আনারস উৎপাদিত হয়। আনারসের পাতা ও গোড়া ফেলে দেয়া হয়। একটি পরিপুর্ন আনারস গাছে ৩৬টি পাতা হয়। একটি আনারস গাছে একবারই ফল ধরে। ফল আহণের পর গাছের গোড়া থেকে নুতন গাছ গজায়। তাই আনারস কাটার পর প্রতিটি গাছ থেকে ১৫-২০টি পাতা ফেলে দেয়া হয়। এই পাতা থেকেই তৈরী হয় উন্নত মানের সুতা। আনারস পাতা থেকে যে ফাইবার পাওয়া যায় তাকে বলে পিনা ফাইবার। পাতা থেকে প্রায় ১০০ ফুট লম্বা লাচি তৈরী করতে পারলেই তা ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি করা যায়।
২০১০ সালে মালয়েশিয়ায় একটি আনারসের মেলায় প্রথম আনারস পাতা থেকে সুতা তৈরীর বিষয়টি দেখতে পাওয়া যায়। আনারস সংগ্রহ করার পর বাগানে অনেক পরিমান বর্জ্য বের হয়। আর সেই বর্জ্য থেকে ২টি উপায়ে পিনা ফাইবার প্রস্তুত করা যায়ঃ
১) হাতে বা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে
২) মেশিনে বা মেকানিক্যাল পদ্ধতিতে
ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বাগান থেকে পাতা সংগ্রহ করার পর ভালভাবে পরিস্কার করে শুকানো হয়। পাতা শুকানোর পর স্টিল বা সিরামিক প্লেট এর মাধ্যমে পাতা থেকে আচরিয়ে আঁশ বের করা হয়। সেই আঁশকে রোদে শুকিয়ে তৈরী করা হয় সুত্র গুটি। একজন শ্রমিক দৈনিক প্রায় ৫০০ পাতা থেকে ফাইবার বের করতে পারে। মেকানিক্যাল পদ্ধতিতে ৩ ধরনের রোলার থাকে। প্রথমে আনারসের পাতাকে ফিড রোলার দিয়ে চালনা করলে তা লিফ ক্র্যাচিং রোলার এ পৌছায়। তবে পাতার ওয়াক্সি লেয়ারগুলো ক্র্যাচিং রোলার এর ব্লেডের মাধ্যমে আচড়ানো হয়। ফলে বেরিয়ে আসে পিনা ফাইবার। আবার পাতাগুলো ৩/৪ দিন পানিতে ভিজিয়ে রাখলে তা থেকেও পিনা ফাইবার পাওয়া যায়।
আনারস পাতা থেকে পাওয়া পিনা ফাইবারের বৈশিষ্ট্য যেমন ইহা নরম ও মোলায়েম, নিজস্ব প্রাকৃতিক উজ্জ্বল্য আছে, ওজনে হালকা, অন্যান্য ফাইবারের সাথে মেশানো যায়, ড্রাইওয়াশের প্রয়োজন হয় না ও পরিবেশ বান্ধব। আনারস পাতার সুতা দিয়ে যে সমস্ত সামগ্রী তৈরী করা যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শাড়ি, বাহারি হাতব্যাগ, ভেনিটি ব্যাগ, গহনার বক্স, গহনা, ওয়ালম্যাট, টিস্যুর বাক্স, কলমদানি, হ্যাট, বিভিন্ন ধরনের খেলনা ইত্যাদি।
প্রতিনিয়ত বিশ্বজুড়ে আর্টিফিশিয়াল বিভিন্ন ফাইবার আবিস্কার হচ্ছে যা ক্ষতিকর এবং শরীর ও পরিবেশ দুটোর জন্যই বিপজ্জনক। সেদিক থেকে পিনা ফাইবার অনেকটাই পরিবেশ বান্ধব এবং ক্ষতিকর রাসয়নিক নেই বললেই চলে। শুধু তাই নয়, স্থায়ীত্বশীল ফাইবার হিসাবে পিনা ফাইবার বেশ জনপ্রিয়। দামে সস্তা ও টেকসই হওয়ায় অনেকেই পিনা ফাইবার এর পণ্য ব্যবহার করছে। পিনা ফাইবারের সঠিক পরিচর্যা ও গুরুত্ব দেয়া হলে এই খাত থেকে ব্যাপক কর্মসংস্থান ও আর্থিক উপার্জন করা সম্ভব।
এগ্রো ভিশন নামক বেসরকারী সংস্থার জাপানি কনসালট্যান্ট ওযাদা সুহি নিশ্চিত করেন, আনারসের পাতা দিয়ে নরমাল নয়, উন্নতমানের সুতা হয়। আনারসের সুতা খুবই নরম এবং এর দ্বারা তৈরী কাপড় আরামদায়ক। আনারস পাতা থেকে ব্যাপকভাবে সুতা উৎপাদন কার্যক্রম চালু হলে আনারস চাষীরা অধিক আয় করতে পারবে এবং এর চাষাবাদ বেড়ে যাবে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি কৃষিজ বর্জ্য হতে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক আঁশ থেকে উৎপন্ন পণ্যের মান উন্নয়নের মাধ্যমে নারীদের আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়ন নামক প্রকল্প পরিচালনা করছে। তারা ৫০০ নারীকে প্রশিক্ষন দিয়েছে। প্রশিক্ষনকালেই নারীরা বিভিন্ন আকর্ষনীয় পণ্য যেমন হাতব্যাগ, ভেনিটি ব্যাগ, গহনার বাক্স, ওয়ালম্যাট, টিস্যৃ বক্স, হ্যাট তৈরী করছে।
বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হলেও আনারসের পাতা থেকে তৈরী সুতা দিয়ে শাড়ি বুনে তাক লাগিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি সংলগ্ন ফাঁসি দেওয়া ব্লকের বিধাননগরের নারীরা। আনারস গাছ কাটার পর তারা সেই গাছের পাতা থেকে সুতা বের করেন ও সেই সুতা দিয়ে শাড়ি তৈরী করেন। আনারস থেকে উৎপাদিত সুতা দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জন্য বানানো হয়েছে একটি উত্তরীয়। আগামীতে তারা একটি কারখানা বানিয়ে আরও বেশী সংখ্যায় শাড়ি উৎপাদনের চেষ্টা করছে।
টাংগাইলের মধুপুরে একটি কারখানায় ক্যালেন্ডার প্রজাতির আনারসের পাতার হতে ফাইবার তৈরীর কাজ চলছে এবং তা বিদেশে রপ্তানী হচ্ছে। বিদেশে আনারসের সুতায় বোনা একটি শাড়ির দাম ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার অধিক। একমন আনারসের পাতা থেকে প্রায় ৪ কেজি সুতা তৈরী হয়। তা ছাড়াও পাওয়া যায় অফসেট কাগজ ও আর্ট পেপার। আনারসের অন্যান্য বর্জ্য থেকে তৈরী করা যায় ক্ষার, ডিটারজেন্ট পাউডার।
উন্নত দেশে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, আর তা হচ্ছে বর্জ্য মানে সম্পদ, বর্জ্য মানে নগদ টাকা। মাছের ফেলনা আঁশ বিদেশে রপ্তানীর মাধ্যমে প্রতিবছর দেশে আসছে কয়েকশ কোটি টাকা। ফেলনা প্লাস্টিক রপ্তানী করে দেশের আয় হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। কৃষির বর্জ্য আনারস পাতা ও গাছ তার উৎকৃষ্ট উদাহরন হয়ে দাড়িয়েছে বাংলাদেশে। বৃহৎ পরিসরে আনারসের পাতা থেকে সুতা ও কাপড় তৈরীর মাধ্যমে দেশের আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব। সরকারী পর্যায়ে আনারস পাতার মাধ্যমে মান সম্পন্ন ও পরিবেশ বান্ধব সুতা তৈরীর এবং তা ব্যবহারের উপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া হলে আগামীদিনে পাটের মত আনারস পাতার সুতাও হতে পারে পরিবেশ বান্ধব হস্ত ও বস্ত্রশিল্পের কাচাঁমাল।
লেখক:মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইন্সটিটিউট