বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ডিম সংরক্ষণ ও ব্যবহারে ডিমের পাউডার এর গুরুত্ব

ড. ফারহানা শারমিন ও ড. মোঃ সাজেদুল করিম সরকার:প্রাচীন যুগ থেকে মানুষ ডিম খেয়ে আসছে এবং গোটা বিশ্বেই ডিম সহজলভ্য। ডিমে থাকে উন্নত মানের আমিষ, ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ডিম ভিটামিন এ, ভিটামিন বি ১২, ভিটামিন ডি, ভিটামিন ই এবং সেলেনিয়াম, ফোলেট, কলিন ইত্যাদি খনিজ  উপাদান দিয়ে পূর্ণ, যা একটি স্বাস্থ্যকর ডায়েটের জন্য অপরিহার্য অঙ্গ।

ডিম মস্তিষ্কের কাক্ষিতমাত্রায় উন্নতি ঘটায় কারণ এতে রয়েছে মস্তিষ্কের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান, যার নাম কোলিন। গবেষণায় দেখা গেছে, কোলিনের অভাবে মস্তিষ্কের নানা ধরণের সমস্যা দেখা দেয়। বহু মানুষই ডিম না খাওয়ায় প্রয়োজনীয় এ উপাদানটির অভাবে শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। মানুষের দেহ ১১ ধরণের প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড তৈরী করেতে পারে। এটি জীবনধারণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখতে পারে। মানুষের দেহে ২০ ধরণের  অ্যামাইনো অ্যাসিড প্রয়োজন হয়, এগুলোর মধ্যে দেহ মোট ১১ ধরণের তৈরী করেতে পারলেও বাকি ৯ ধরণের অ্যামাইনো অ্যাসিডের সহজ উপায় হলো ডিম খাওয়া।

ডিমের কুসুম নিয়ে একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে, কুসুম খেলে শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ডিমের কুসুমে কোলেস্টেরল থাকার জন্য ধারণা করা হতো, যাদের করোনারি হার্ট ডিজিজ রয়েছে এবং রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি, তাদের জন্য ডিমের কুসুম ক্ষতিকর,তাই কুসুমছাড়া ডিম খাওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে, ডিমের কুসুম থেকে যে কোলেস্টরেল পাওয়া যায়, তা রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায় না এবং এটি করোনারি হার্ট ডিজিজের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তারপরেও অনেকে শুধু ডিমের কুসুম পছন্দ করে, আবার অনেকে শুধু ডিমের সাদা অংশ পছন্দ করে।

আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত পাউডার ডিমের প্রচলন তেমন একটা হয় নি, কিন্তু আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাঁচটি এগ পাউডার ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট রয়েছে, যেগুলোর বাৎসরিক উৎপাদন ক্ষমতা ১৫০০০ টন এবং এই এগ পাউডার গুলো বিশ্বের ৩০ টি দেশে রপ্তানি করা হয়। ডিম হলো একটি পঁচনশীল দ্রব্য এবং ডিমের বাজারমূল্য বছরের নানা সময়ে হঠাৎ করে ওঠানামা করে। দেশ যেহেতু উন্নত বিশ্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাই আমাদেরকেও আগামী দিনের কথা মাথায় রেখে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করার কথা ভাবতে হবে। সুতরাং আমাদের দেশে ডিম খাওয়ার প্রবণতা বাড়াতে ডিমের পাউডার তৈরী করার এখনি উপযুক্ত সময়। পাউডার এগের অসংখ্য সুবিধার মধ্যে এর ব্যতিক্রমী বাইন্ডিং এবং ইমালসন গুণাবলীর কারণে খাদ্য শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠেছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ডিমকে বিভিন্ন রুপে পাওয়া যায় যেমনঃ সম্পূর্ন ডিমের পাউডার, কুসুমের পাউডার, সাদা অংশের পাউডার, তরল ডিম ও ফ্রোজেন ডিম ইত্যাদি। ডিমের পাউডার পরিবহন করা তুলনামূলকভাবে সহজ এবং পরিবহনের  সময়  ভাঙ্গার কোন সম্ভাবনা থাকে না। ডিমের পাউডার পোল্ট্রি শিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূ্‌ন্য পণ্য। পাউডার ডিম সম্পূর্ণরূপে পানিশূন্য থাকে। পাউডার মিল্ক যেভাবে তৈরি করা হয় সেভাবেই একটি স্প্রে ড্রায়ারের মাধ্যমে এগ পাউডার তৈরি করা হয়। কাটিং এজ টেকনলজির (Cutting edge technology) মাধ্যমে ডিমটাকে ভেঙ্গে নেওয়া হয় তারপর ডিমের কুসুম থেকে ডিমের সাদা অংশ আলাদা করে নেওয়া হয়। ডিম ভাংগার কাজটি খুবই দ্রুত করা হয় অন্যথায় ডিমের সাদা অংশ ডিমের খোসার সাথে লেগে যেতে পারে। এগ পাউডার প্রস্তুত প্রণালীর একটি প্রবাহ চিত্র নিম্নে দেখানো হল।

ডিম, ডিমের সাদা অংশ বা ডিমের কুসুম তরল আকারে পাস্তুরাইজড এবং স্প্রে-ড্রাইড করা হয়। ডিম থেকে পানিকে বাষ্পীভূত করতে সক্ষম এমন একটি উচ্চ তাপমাত্রাযুক্ত ঘরে স্প্রে-ড্রাইড করা হয়। ডিমের তরল অংশ সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়ার পর, এটি গুড়া করে স্বাস্থ্যকর উপায়ে প্যাক করা হয়। ডিমের পাউডার একটি ব্যাগে রাখা হয় এবং সিল করা হয়। ডিম পাউডারের বিশ্বব্যাপী চাহিদার অন্যতম প্রধান কারণ হল এর দীর্ঘ সেলফ লাইফ এবং বহনযোগ্যতা। ডিমের পাউডার যখন বায়ুরোধক পাত্রে সংরক্ষণ করা হয় তখন এটি ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। টাটকা ডিমের মতো একই পরিমাণ প্রোটিন সরবরাহ করা ছাড়াও, এটি ল্যাকটোজ মুক্ত,  কার্বোহাইড্রেট, কোলেস্টেরল এবং চর্বির পরিমাণ কম থাকে এবং পাউডার ডিমের ওজন স্বাভাবিক ডিমের তুলনায় কম থাকে।

 

ডিমের সাদা পাউডারে পর্যাপ্ত অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে, যা পেশী তৈরি করতে সাহায্য করে এবং পেশী মেরামত ও পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। অনেক পুষ্টিবিজ্ঞানী বলেছেন যে, ডিমে খুব কম পরিমাণ ক্যালরি আছে। একটি বড় ডিমে মাত্র ৭১ কিলোক্যালরি শক্তি আছে। ক্যালরির দিক থেকে অন্য সব খাবার থেকে ডিম অনেক উপকারি। কারণ ডিমে কম পরিমানে ফ্যাট আছে। ডিম খেলে দেহের ওজন কমে একথা অনেকেই বিশ্বাস করতে চান না। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় বিষয়টি  প্রমাণিত হয়েছে যে পরিমিত মাত্রায় ডিম খেলে দেহের ওজন কমানো সম্ভব। মূলত ডিমে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান থাকায় তা বাড়তি খাবার খাওয়ার চাহিদা কমিয়ে দেয়। এতে ক্ষুধা কমে যায় এবং দেহের ওজনও কমে যায়। তাই গবেষকরা ডিম খাবার ব্যাপারেই মতামত দিয়েছেন।  

ডিমের পাউডারে ক্যালরির পরিমাণ কম; ২ টি ডিমে ৩৫৭ ক্যালোরি থাকে। তাই যারা কম ক্যালোরিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করতে চান তাদের জন্য এটি একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য হতে পারে। পাউডার ডিমে ২৮৬ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম এবং ৪৮১ মিলিগ্রাম সোডিয়াম থাকে। পেশী স্নায়ুর কার্যকারীতার জন্য সোডিয়াম গুরুত্বপূর্ণ, এবং স্নায়ু কোষের কার্যকারীতার জন্য পটাসিয়াম অপরিহার্য। ফুড এ্যান্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশনের মতে প্রতিদিন ২৩০০ মিলিগ্রামের বেশী সোডিয়াম এবং ৪৭০০ মিলিগ্রামের বেশি পটাশিয়াম গ্রহণ করা ঠিক নয়।

পাউডার ডিমে কোন ভিটামিন নেই, তাই পাউডার ডিম খাওয়ার সময় অন্যান্য খাবার থেকে ভিটামিনের বিকল্প উৎস খুঁজে বের করা উচিৎ। ডিমে ক্যালসিয়াম বেশি থাকে যা দৈনিক ক্যালসিয়াম গ্রহণের  ১৩ শতাংশ সরবরাহ করে। মেডলাইন প্লাস (ইউএস ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন) অনুসারে, ক্যালসিয়াম দাঁত এবং হাড়ের সঠিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয়। মানুষের রিভিন্ন রোগ আজ ক্যালসিয়ামের অভাবের কারণে হয়ে থাকে। এছাড়াও কার্ডিওভাসকুলার রোগ দেখা দেয়, হাড় এবং পেশী সিস্টেমের বিকাশ ব্যাহত হয়, স্নায়বিক ব্যাধি দেখা দেয়, এবং অ্যালার্জি দেখা দেয় ।
চীনে প্রায় ৫ লাখ লোকের ওপর এক গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিদিন একটা করে ডিম খেলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিম থেকে শারীরিক উপকার পেতে হলে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করতে হবে। তবে একসময় যে বলা হতো বেশি ডিম খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর, বিজ্ঞানীরা এখন সে মতবাদ পাল্টে ফেলেছেন। ইংল্যাণ্ডে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিটা ফরুহি বলছেন “পুষ্টি সংক্রান্ত নানা গবেষণায় একটা বিষয় পরিস্কার যে প্রতিদিন একটা ডিম খেলে হৃদযন্ত্র বা শরীরের রক্ত সঞ্চালনে কোন ঝুঁকি তৈরি হয়না, বরং প্রতিদিন একটা ডিম স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হতে পারে"।  

আমাদের দেশে ডিম খাওয়ার প্রবণতা বাড়াতে ডিমের পাউডার তৈরী করার এখনি উপযুক্ত সময়। পাউডার ডিম অত্যন্ত সুবিধাজনক কারণ পাউডার করার ফলে পণ্যটির অপচয় কম হয় এবং কোন অবশিষ্টাংশ তৈরি হয় না। ডিমের পাউডার  বিভিন্ন রুপে পাওয়া যাওয়ার কারণে এই বৈচিত্র্যময় প্রডাক্টটি বিভিন্ন পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে। ডিমের সাদা অংশের গুঁড়ায় প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে অন্যদিকে  ডিমের কুসুমের গুঁড়োতে  চর্বির পরিমাণ বেশী থাকে। সবচেয়ে বড় অংশ দখল করে আছে পুরো ডিমের পাউডার। ডিমের পাউডার সবচেয়ে বেশী ব্যবহার হয় বেকারীতে ও ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে। ডিমের পাউডার শিল্পের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে রয়েছে-সানোভগ্রুপ (ডেনমার্ক), ওয়েকো গ্রুপ (ইউএসএ), ইউরোভো এসআরএল, (ইতালি) রেমব্র্যান্ড এন্টারপ্রাইজেস ইনকর্পোরেটেড (ইউএসএ), রোজ একর ফার্মস, ইনকর্পোরেটেড (ইউএসএ), কেউপি এগ কর্পোরেশন (জাপান) ইত্যাদি।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) ঢাকায় চলমান “পোল্ট্রি গবেষণা ও উন্নয়ন জোরদারকরণ প্রকল্প”-এর মাধ্যমে যে পোল্ট্রি রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তার গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কাজের অংশ হিসাবে আগামীর উন্নত বাংলাদেশের জন্য খামারী, উৎপাদনকারী, ভোক্তা, ব্যবসায়ী সকলের কথা বিবেচনা করে এদেশে পাউডার এগ প্রস্তুত ও বাজারজাত করা এখন সময়ের দাবী।

লেখকঃ১) ড. ফারহানা শারমিন, পিএইচডি (ফুড সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, টোকিও, জাপান) পোষ্ট-ডক্টরাল গবেষণা ফেলো (প্রাক্তন), পোল্ট্রি গবেষণা ও উন্নয়ন জোরদারকরণ প্রকল্প, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, সাভার, ঢাকা
এবং
২) ড. মোঃ সাজেদুল করিম সরকার, পিএসও ও দপ্তর প্রধান (রু.দা.), পোল্ট্রি রিসার্চ সেন্টার এবং প্রকল্প পরিচালক, পোল্ট্রি গবেষণা ও উন্নয়ন জোরদারকরণ প্রকল্প, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, সাভার, ঢাকা।