বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পের স্থিতিশীলতায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার

ড. খালিদুজ্জামান এলিন:পত্রিকার পাতা খুললেই কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-এর দিকে তাকালেই ইদানীং ডিম নিয়ে, ডিমের দাম নিয়ে বাজারে যে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে তা প্রতিনিয়তই চোখে পড়ছে। কেউ বেশি দামে আবার কেউ ডিম না কেনার পক্ষপাতমূলক পরামর্শ দিচ্ছেন। দামের যে ঊর্ধ্বগতি তা আমাদের স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ যে অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ি, আমাদের দেশে একজন মানুষ গড়ে বছরে প্রায় ১০৫ টি ডিম খেয়ে থাকে, যা খুব বেশি নয়। কারণ একজন মানুষ সাধারণত দিনে ২ টি ডিম খেতে পারে এবং পুষ্টি বিবেচনায় ও মানুষকে কর্মক্ষম রাখতে তা একান্ত প্রয়োজনীয়। উন্নত বিশ্বে যেমন জাপানে একজন মানুষ গড়ে বছরে প্রায় ৩১০ টি ডিম খেয়ে থাকে।

আমাদের দেশে ডিমের প্রধান উৎস মূলত ক্ষুদ্র পোল্ট্রি খামার। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে এখনও আমাদের প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের বড় একটা অংশ যেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার নাই বললেই চলে কিংবা ব্যবহারের উপযুক্ত পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক। প্রযুক্তি ও প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতার অভাবে বেশির ভাগ খামারিরা উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা ও রোগের প্রকোপ সামাল দিতে না পারায় বেশিদিন টিকে থাকতে পারছে না। ফলে ডিমের বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। তাই পোল্ট্রি খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এ শিল্পকে টেকসই করতে পারে। উপরন্ত, খরচ কমানো, ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং গুণগতমান বৃদ্ধি ও নিশ্চিত করার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ক্রমাগত সরবরাহ নিশ্চিত করে ডিমের বাজার এর স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারে।

বর্তমান বিশ্বে, মাংস উৎপাদনের সবচেয়ে বড় উৎস হল পোল্ট্রি। এর কারণ মূলত এর সহজলভ্যতা, সহনীয় মূল্য এবং কোন ধর্মীয়গোষ্ঠীর জন্য  বিধিনিষেধ না থাকা। এছাড়াও, এ মাংসকে কম চর্বিযুক্ত মাংস হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং এতে কোন জটিল কাঠামোগত প্রোটিন না থাকায় ডায়াবেটিক রোগী এবং শিশুদের জন্য ভাল। তাছাড়া ডিম ও পোল্ট্রি পণ্যের বায়োলজিক্যাল ভ্যালু অনেক বেশি। তাই, পোল্ট্রি খাত খাদ্য নিরাপত্তার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়াও, ডিম বিশ্বব্যাপী সব শ্রেণী মানুষের জন্য প্রোটিনের একটি বড় উৎস এবং প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় এটি একটি সাধারণ আইটেম। অন্যান্য গবাদি পশুর তুলনায় এটি উৎপাদনের জন্য কম জায়গার প্রয়োজন এবং সেইসাথে কম মিথেন গ্যাস উৎপাদন করার ফলে পরিবেশের উপর প্রভাবও কম।

বাংলাদেশ মুরগি ও ডিম উৎপাদন খাতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে অনেক পিছিয়ে রয়েছে যেমন আভ্যন্তরীণ গুণনির্ণয়-ভিত্তিক ডিমের বাছাই, পোল্ট্রি ওয়েলফেয়ার, ডিম ও মুরগি উৎপাদন ব্যবস্থায় তথ্যবিজ্ঞানের অভাব ইত্যাদি। প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে, বিভিন্ন সেন্সিং সিস্টেম ব্যবহার করে ডিমের অভ্যন্তরীণ ও পুষ্টি উপাদান, উর্বরতা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে ডিমের গ্রেডিং করা যেতে পারে। প্রযুক্তির ব্যবহার পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে পারে।

প্রযুক্তির এই যুগে, আমরা আমাদের পোল্ট্রি খাতে উন্নত প্রযুক্তির (যেমন অটোমেশন, অপ্টিকাল সেন্সিং এবং ইনফরমেটিক্স) প্রবর্তন এবং গ্রহণ না করে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কিংবা দেশীয় বাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। প্রযুক্তির ব্যবহার কম খরচে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বাজারে ডিম ও পোল্ট্রি পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে। শুধু পর্যাপ্ত উৎপাদন নিশ্চিতকরণ নয় উপরন্ত আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এর গুণগতমান বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রযুক্তির অনুপস্থিতিতে আমাদের অবশ্যই দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সময়সাপেক্ষ ও কম দক্ষতা, বারবার রোগের প্রকোপ এর কারণে উৎপাদনহীনতায় ভুগতে হবে। প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে আমরা ভোক্তাভেদে পুষ্টির চাহিদা এমনকি এস্থেটিক ভ্যালুও নিশ্চিত করতে সক্ষম হব।

শুধু উৎপাদন বৃদ্ধির ধারণা মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে এখন আর আমাদের চলবে না, যা এখন অতীত। আমাদের জৈব নিরাপত্তা (বায়ো সিকিউরিটি) ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে অটোমেশন এবং স্মার্ট ফার্মিং সিস্টেম (শিল্প বিপ্লব ৩-৪ )-এর চিন্তা করতে হবে। স্মার্ট পোল্ট্রি ফার্মিং মানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ (AI) যা প্রযুক্তি এবং সিস্টেমকে বোঝায় যা বিভিন্ন ডিভাইসকে কম্পিউটারে মানুষের মতো জটিল সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করে। বর্তমান সময়টিকে তৃতীয় AI বুম হিসাবে বিবেচনা করা হয় যেখানে অন্তর্নির্মিত AI ফাংশনগুলি যানবাহন, নজরদারি ক্যামেরা, রোবট থেকে শুরু করে হোম অ্যাপ্লায়েন্স পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিকাশ ও বাজারজাত করা হচ্ছে। তাপীয় আরাম নিশ্চিত করতে প্রযুক্তি ব্যবহার হ্যাচারি ও পোল্ট্রি খামারে বিভিন্ন ঝুঁকি কমাতে পারে। এটি মোরগ-মুরগির ঘনত্বের অনুমান এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা, স্বয়ংক্রিয়ভাবে খাবার বাবস্থাপনা, রোগ সংক্রমণ রোধে মানুষের হস্তক্ষেপ হ্রাস এবং দূষণ প্রতিরোধের জন্য অভ্যন্তরীণ পরিবেশ নিয়ন্ত্রক সেন্সর ব্যবহার করা যেতে পারে।

উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, অসুস্থতা এবং মৃত্যুহার হ্রাস, রোগের সূত্রপাত এবং বিস্তারের সম্ভাবনা হ্রাস, পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাস, স্থান এবং অন্যান্য ইনপুটগুলির দক্ষ ব্যবহার এবং ব্যবস্থাপনার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করা প্রয়োজন। এছাড়া, এ শিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহার ভোক্তাভেদে ডিমের অভ্যন্তরীণ গুণগতমান নিশ্চিত করতে পারে যেমন কুসুমের রঙ, কুসুমের অনুপাত, পুষ্টি ইত্যাদি। শব্দ সেন্সর ব্যবহার করে খোসার ফাটল সনাক্তকরণ, অপটিক্যাল সেন্সর ব্যবহার করে ত্রুটি, উর্বরতা ইত্যাদি নির্ণয় করা সম্ভব।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে, আমরা এখন আর চাহিদা মেটাতে শুধু উৎপাদন বৃদ্ধির সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ নেই। আমাদের বর্তমান ও নতুন প্রজন্মের জন্য সুস্থ ও সমৃদ্ধ জীবনযাপনের জন্য পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার কথা ভাবতে হবে। আর এ জায়গাটায় আধুনিক প্রযুক্তি প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে। পোল্ট্রি শিল্পের দ্রুত উন্নতি ও বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রযুক্তিকে সাদরে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের খামারির বড় একটা অংশ গ্রাম পর্যায়ের, এ খাতে কিভাবে প্রযুক্তিগুলি প্রান্তিক পর্যায়ে পৌছনো যাবে সে বিষয়ে সবাইকে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে ভাবতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে এবং কাজ করতে হবে।

লেখকঃ ড. খালিদুজ্জামান এলিন, শিক্ষক, খাদ্য প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
গবেষক, আকিতা প্রিফেকচারাল ইউনিভার্সিটি, জাপান।