খাদ্য দিবসঃ পশুসম্পদ খাতে উৎপাদিত খাদ্যের অপচয় রোধ ও নিরাপদতা

ড. সৈয়দ মোঃ এহসানুর রহমান :গত ১৬ই অক্টোবর, ২০২২ এ বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল “কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়। ভালো উৎপাদনে উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন”। (Leave no one behind. Better production, better nutrition, a better environment and a better life.”)। অর্থাৎ বিশ্বের খাদ্য অপচয় রোধ করার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ যেন তাদের খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারে সেই লক্ষে কাজ করাই এবারের মূল উদ্দেশ্য।

প্রতিবছর উৎপাদিত খাদ্যের একটি বিরাট অংশ অপচয় হয়ে যাচ্ছে এবং মানুষের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছে। এফএও-এর একটি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, প্রতি বছর ১.৩ বিলিয়ন টন খাবার নষ্ট হয় অর্থাৎ উৎপাদিত খাদ্যের এক তৃতীয়াংশ খাবার বিভিন্নভাবে অপচয় হয়ে যাচ্ছে যাতে বছরে ৭৫০ বিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। এছাড়া, মানুষের খাদ্য তালিকায় মাছ, মাংস, দুধ, ডিম একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করে আছে এবং পশুসম্পদ খাতে উৎপাদিত এসব খাদ্যের অপচয়ও উল্লেখযোগ্য। ইউএসডিএর তথ্য মতে, ২০১০ সালে আমেরিকা একাই মাছ, মাংস এবং পোলট্রি জাত খাদ্যে ২৬% অপচয় করেছে এবং ২০১৮ সালে এই অপচয় মাত্র ১% কমেছে।

বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেয়া গিয়েছে যে, খামার থেকে এই অপচয় শুরু হয়। এছাড়া পরিবহনের সময় থেকে মানুষের টেবিল পর্যন্ত পৌঁছাতে গিয়েও বিভিন্নভাবে অপচয় হয়ে যাচ্ছে। এর প্রধান কারন হল উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা ও খাদ্য নিরাপত্তার অভাব। কেউ কেউ খামার অবস্থায় পশু খাদ্য ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক ও হরমোন ব্যবহার খাদ্য দ্রব্যের নিরাপত্তা ব্যাহত করছে। এছাড়া, পরিবহনের সময় খাদ্যদ্রব্যগুলো বিভিন্নভাবে দূষিত হচ্ছে যেমনঃ মাছ, মাংস ও দুধে ফরমালিন ব্যবহার একটি অন্যতম সমস্যা। তাই পশুজাত খাদ্যদ্রব্যগুলোর অপচয় কমাতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। পশুজাত খাদ্যদ্রব্যগুলো পচনশীল হওয়ায় এর জন্য হিমাগার বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, এই খাদ্যদ্রব্যগুলি খামার থেকে শুরু করে পরিবহনের সময় যেন বিভিন্ন বস্তু দ্বারা দূষিত না হয় সেইদিকে খেয়াল রাখা উচিত। পশু খাদ্যে এন্টিবায়োটিক ও হরমোন এর ব্যবহার রোধ করতে সরকারিভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। পশুজাত খাদ্য অতি দ্রুত নষ্ট না হয়ে যায় সেজন্য বিভিন্ন খাবার প্রক্রিয়াজতকরণ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে যাতে অনেক দিন খাবার সংরক্ষন করা যায়। মাছ, মাংস বিভিন্ন ধরনের মসলা দিয়ে মেরিনেশন করে অনেক দিন ভাল রাখা যায়। এছাড়া দুগ্ধজাত পন্য দুধের তুলনায় অনেকদিন ভাল থাকে। তাই দরিদ্র বা প্রান্তিক খামারিদেরকে মাংস প্রক্রিয়াজতকরণ (মিট বল, নাগেট, সসেজ) ও দুগ্ধজাত পন্য (পনির, দই, মাখন, ঘি) তৈরির গুরুত্ব ও প্রস্তুতকরণ সম্পর্কে জানাতে হবে।

খাদ্য সংকট বিশ্বব্যাপী। তাই প্রতিটি ক্ষেত্রে খাদ্য অপচয় কমাতে সকলকে কাজ করতে হবে। খামারি ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। অপচয়কৃত খাবার ফেলে না দিয়ে সেটাকে পুনর্ব্যবহার করতে হবে। পঁচনশীল দুধ, মাছ, মাংস, ও ডিম প্রক্রিয়াজাত করে সেটাকে পশুর খাদ্য বা মাটির সার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। খাদ্য অপচয় কমাতে সরকারি, বেসরকারি ও বিভিন্ন উদ্ভাবনী সংস্থাকে কাজ করতে হবে। দেশের প্রতিটি স্তরের মানুষকে খাদ্য অপচয় এর অপকারিতা, ও রোধ করার কৌশল সম্পর্কে অবগত করতে হবে। খাবার অপচয় না করে সেটি গরীব দুঃখী মানুষের মাঝে বিতরণ করতে হবে। কোন খাবারই যেন নষ্ট না হয় এবং পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার হয় তা নিশ্চিত করা জরুরী। সেক্ষেত্রে, ফুড ব্যাংক চালু করা যেতে পারে যাতে কোন মানুষই অভুক্ত না থাকে। এভাবে খাদ্য অপচয় কমিয়ে প্রতিটি স্তরের মানুষের মাঝে খাদ্য বণ্টন নিশ্চিত হোক এটাই আগামি দিনের প্রত্যাশা।  

লেখকঃপ্রফেসর
পশুবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২