মো. সৈকত হোসেন ভূইয়াঃ অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে। দেশের বিদ্যমান ভৌত অবকাঠামো ও মাঠের ফসলের ক্ষেত্রে এই ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক ভাবে বেশী হয়। তবে কৃষি ক্ষেত্রে এই ক্ষতির প্রভাব অন্যান্য খাতের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে।
বিগত দশকের তথ্য বিশ্লেষণে পাওয়া যায় যে, দেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়গুলোর বেশিরভাগই আঘাত হেনেছে মে থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে। সাধারনত অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসে আমন ধান পরবর্তী রবি ফসলের জন্য কৃষক জমি প্রস্তুত করে থাকে যা এই দুর্যোগের ফলে বাধাগ্রস্ত হয়। অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় গুলোর মধ্যে ২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বরের সিডর, ২০০৮ সালের অক্টোবর মাসে আঘাত হানা রেশমি, ২০১৪ সালের হুদহুদ এবং ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে আঘাত আনা বুলবুল উল্লেখযোগ্য। দেশে আবাদকৃত অন্যতম প্রধান তেল ফসল সরিষাসহ সূর্যমুখী, চিনাবাদাম, সয়াবিন ইত্যাদি রবি মৌসুমে আবাদ করা হয়। অন্যদিকে তিল রবি এবং খরিফ উভয় মৌসুমী আবাদ করা গেলেও আমাদের দেশে তিল সাধারণত খরিফ মৌসুমেই চাষাবাদ হয়ে আসছে। সয়াবিনের বীজ আর্দ্রতার প্রতি সংবেদনশীল হওয়ায় দ্রুত এর অঙ্কুরোদগমের ক্ষমতা কমে যায়। যথাযথ অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য লক্ষীপুর জেলার কিছু কিছু উপজেলায় খরিফ মৌসুমে সয়াবিনের আবাদ করা হয়, যা বীজ হিসেবে দেশের চাহিদার বড় অংশ মেটাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে। তাই অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় পরোক্ষভাবে সয়াবিন চাষের জন্যও ক্ষতির কারণ হয়ে আসছে।
বর্তমানে আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ২৪ লক্ষ মেট্রিক টন ভোজ্য তেলের প্রয়োজন। এর মাত্র ১০% অভ্যন্তরীণভাবে মেটানো হয় যার ৯৮% আসে সরিষা থেকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে বিগত ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে আমাদের দেশে সরিষা আবাদ হয়েছে ৫.৮৯০ লক্ষ হেক্টর জমিতে। আমাদের দেশে আবাদকৃত স্থানীয় জাতের সরিষা মধ্যে মাগী, ডুগি, টরি-৭ সহ অধিকাংশ সরিষা ক্যাম্পেস্টিজ প্রজাতির যাদের গড় ফলন অনেক কম। উচ্চ ফলনশীল সরিষার মধ্যে বিনাসরিষা-১০, বিনাসরিষা-১১, বারিসরিষা-১৪ এবং বারিসরিষা-১৭ ক্যাম্পেস্টিজ প্রজাতির অন্তর্ভূক্ত। বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯ এবং বিনাসরিষা-১৮ নেপোস প্রজাতির অন্তর্ভূক্ত। তাছাড়া সম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উদ্ভাবিত সরিষার পাঁচটি জাতসহ বিনাসরিষা-৭ ও বিনাসরিষা-৮ জাতগুলো জুনসিয়া প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। প্রজাতি ভিত্তিক বিভিন্নতার কারণে সরিষার উৎপাদন ক্ষমতা, জীবনকাল এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও ভিন্ন হয়ে থাকে। সাধারণত জুনসিয়া প্রজাতির সরিষার জীবনকাল তুলনামূলকভাবে অন্যন্য প্রজাতি হতে বেশী, নেপোস প্রজাতির সরিষার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী আবার ক্যাম্পেস্টিজ প্রজাতির সরিষার জীবনকাল কম এবং তাদের উৎপাদন ক্ষমতাও কম।
আমাদের দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বলতে এখনো ধানের উৎপাদনকে বুঝি, তাই ধান অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফসল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ কারণে ধান ফসল ভিত্তিক শস্যবিন্যাসের বাহিরে গিয়ে সরিষার আবাদ বৃদ্ধি করা বাস্তবসম্মত হবে না। দেশে প্রায় ৫৯ লক্ষ হেক্টর জমিতে আমন ধান আবাদ হয়ে আসছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ২০ লাখ হেক্টর জমি আমন-পতিত-বোরো শস্য বিন্যাসের আওতায় আছে। তেল ফসলের আমদানি নির্ভরতা কমানোর জন্য ইতিমধ্যে সরকার কর্তৃক ২০২-২৩ ও ২০২৪-২৫ মেয়াদে তেল ফসলের আবাদ বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে চাহিদার শতকরা ৪০ শতাংশ উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে নিশ্চিত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এটি নিশ্চিত করতে হলে অতিরিক্ত ২০ লাখ হেক্টর জমিতে তেল ফসল আবাদ বৃদ্ধি করতে হবে। প্রচলিত এই শস্যবিন্যাসের আওতায় থাকা ২০ লক্ষ হেক্টর জমির ৫% জমি ও যদি সরিষা চাষের মাধ্যমে আমন-সরিষা-বোরো শস্যাবিন্যাসের আওতায় আনার সম্ভব হয় তাহলে প্রায় এক লাখ এক হেক্টর নতুন জমি সরিষা চাষের আওতায় আনা সম্ভব হবে। যা হতে প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন অতিরিক্ত তেল পাওয়া সম্ভব হবে। এজন্য প্রয়োজন স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন আমন ধানের জাতের আবাদ নিশ্চিত করা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) বেশ কয়েকটি আমন ধানের জাত নিবন্ধিত করেছে যাদের জীবনকাল ১১০ থেকে ১১৫ দিন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চলতি আমন মৌসুমের চাষাবাদ লক্ষ্য অর্জন হলেও কিছু জায়গায় আমানের আবাদ অনেকটাই বিলম্বিত হয়েছে। সম্প্রতি সময়ে হয়ে যাওয়া সিত্রাং এর প্রভাবে আমন ধান কর্তন পরবর্তী রবি ফসলের জমি প্রস্তুত বিলম্বিত হবে।
প্রচলিত পদ্ধতিতে জমি প্রস্তুত করে সরিষা চাষ করতে হলে জমি সম্পূর্ণ জো অবস্থায় আসার পর ভালোভাবে শুকিয়ে বীজ বপন করতে হয়, কারণ জো অবস্থায় আসার আগেই জমি চাষ দিলে এবং মাটির বেশি আর্দ্রতায় বীজ বপন করলে অংকুরোদগম ঠিকভাবে হলেও পরবর্তীতে সবিষার বৃদ্ধি খুবই ধীর গতিতে হয়। অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে এ পদ্ধতিতে সরিষা চাষ করা সম্ভব হলেও নিচু এবং ভারি বুনটের মাটিতে আমন ধান সংগ্রহের পর মাটির আর্দ্রতা বেশি থাকায় জমিতে জো আসার পর চাষ দিয়ে সরিষা আবাদ করতে গেলে বিলম্ব হয় বিধায় সরিষা চাষ করা সম্ভব হয় না। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে দেরিতে বপন করে সরিষা আবাদ করা সম্ভব হলেও আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না এবং পরবর্তী বোরো ধান চাষের ক্ষেত্রেও চারা দেরিতে রোপণ করতে হয় বিধায় বোরো ধানের ফলন কমে যাওয়াসহ সংগ্রহের সময় ঝড়-বৃষ্টির প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ফলন হ্রাসের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। ফলশ্রুতিতে কৃষকগণ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া বিগত কয়েক বছরে আমন ধান সংগ্রহকালীন সময় পরিবর্তিত আবওহাওয়াজনিত কারণে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে মাটির আর্দ্রতা প্রায় শতভাগ পর্যন্ত পৌঁছে যায়, ফলে চাষ দিয়ে সরিষা আবাদ করা সম্ভব হয়ে উঠে না বিধায় জমি পতিত রাখতে হয়।
অন্য দিকে দেশের বরিশাল অঞ্চলের কিছু এলাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত রোপা আমন-পতিত-পতিত শস্যবিন্যাসে রোপা আমন সংগ্রহ পরবর্তী পতিত জমি এবং বিশেষ করে হাওর অঞ্চলের বোরো-পতিত-পতিত শস্য বিন্যাসে বোরো ধান চাষের পূর্বে পতিত জমিতে শূন্য চাষ পদ্ধতিতে সরিষা চাষের সুযোগ আছে। উল্লিখিত সমস্যা হতে উত্তরণ কল্পে রোপা আমন ধান সংগ্রহের পর এবং বোরো ধান চাষের পূর্বে বিনা চাষে সরিষা চাষের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। এ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদের ক্ষেত্রে ইউরিয়া সারের এক তৃতীয়াংশ (একর প্রতি ২০ কেজি) এবং অন্যান্য রাসায়নিক সারের পুরোটাই (একর ডিএপি ৭৫ কেজি, এমওপি ৫০ কেজি, জিপসাম ৫৫ কেজি, জিংকসালফেট ৪ কেজি এবং বোরিক এসিড ৩ কেজি) একত্রে জমিতে প্রয়োগ করে পরে বীজ বপন করতে হবে এবং ইউরিয়ার এক তৃতীয়াংশ (একর প্রতি ২০ কেজি) বীজ বপনের ১৫ দিন পর আর অবশিষ্ট এক তৃতীয়াংশ ইউরিয়া (একর প্রতি ২০ কেজি) ফুল আসা পর্যায়ে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
উল্লেখ্য, শূন্য চাষ পদ্ধতিতে টিএসপির পরিবর্তে ডিএপি ব্যবহার করতে হবে, কারণ টিএসপির তুলনায় ডিএপি দ্রুত দ্রবনশীল। এ পদ্ধতিতে সরিষা আবাদের ক্ষেত্রে ফলনে পানি সেচ বিশেষ ভূমিকা রাখে তাই হালকা বুনটজনিত কারণে মাটিতে রসের অভাব হলে অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায় ও ফুল আসার সময় সেচ প্রয়োগ করতে হবে। তবে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যেসব এলাকায় আমন ধান কাটার পর জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকে অর্থাৎ জমিতে হাটলে মাটিতে পায়ের ছাপ পড়ে এমন জমিতে শূন্য চাষে সরিষা আবাদ করতে হবে। আমন ধান সংগ্রহের পর জমিতে আগাছার উপদ্রব হয় না বা তুলনামূলকভাবে কম হয় এমন জমি নির্বাচন করতে হবে।
অন্যদিকে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে আঘাত হানা জাওয়াদ ফলে দণ্ডায়মান সরিষা সমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিন্তু বিনা উদ্ভাবিত নেপাল জাতের বিনা সরিষা-৯ হঠাৎ বৃষ্টি জনিত সাময়িক জলবদ্ধতা সহ্য করার ক্ষমতা বেশি হওয়ায় তুলনামূলকভাবে এর ক্ষতি কম হয়েছে। যদি ও সরিষা শীতকালীন ফসল, তবে বিনাসরিষা-৪ ও বিনাসরিষা-৯ জাত দু’টি পরাগায়ণ প্রক্রিয়া তুলনামূলক উচ্চ তাপমাত্রায়ও বাধাগ্রস্থ হয়না বিধায় দেরিতে আবাদ করলেও এদের ফলন হ্রাসের ঝঁকি কম, যার ফলে দক্ষিণাঞ্চলে এদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিনা উদ্ভাবিত বিনাসরিষা-৯ জাত এর জীবনকাল ৮৫-৮৭ দিন ও ফলন- ১৫-২০ মণ/একর এবং বিনাসরিষা-৪ এর জীবনকাল ৮৭-৯৫ দিন ও ফলন- ২২-২৫ মণ/একর। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সম্প্রতি আঘাত হানা সিত্রাং এবং গত বছর ডিসেম্ভরে আঘাত হানা জাওয়াদের ক্ষতি বিবেচনা বর্তমানে সরিষার আবাদের জন্য নেপোস প্রজাতির জাতমূহ (বিনাসরিষা-৪ ও বিনাসরিষা-৯) নির্বাচন করা প্রয়োজন।
অন্যদিকে বিনা উদ্ভাবিত শূন্য চাষে সরিষা আবাধ প্রযুক্তিটি ভারী বৃষ্টির ফলে আমন ধান কর্তন পরবর্তী যথাসময়ে সরিষা আবাদে কৃষকদের ফলনের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম হবে। পরিশেষে বলা যায়, সিত্রাং পরবর্তী তেল ফসলের আবাদ নির্বিঘ্ন করতে বিনা উদ্ভাবিত শূন্য চাষে সরিষা আবাদ প্রযুক্তি এবং বিনা উদ্ভাবিত জাতসমূহ বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
লেখক: মো. সৈকত হোসেন ভূইয়া, উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ময়মনসিংহ