দে লো য়া র জা হি দ:একটি দেশের অর্থনীতি তার সত্তার পণ্য, পরিষেবা, উৎপাদন ব্যবস্থা, ব্যবহার এবং বাণিজ্য সম্পর্কিত সমস্ত ক্রিয়াকলাপ দ্বারা আবর্তিত ও পরিচালিত হয়। প্রতিটি দেশই তার নিজস্ব সম্পদ, সংস্কৃতি, আইন, ইতিহাস এবং ভূ-প্রকৃতি অনুযায়ী গঠিত ও পরিচালিত হয়। নোবেল বিজয়ী রবার্ট লুকাস জুনিয়র কোনো দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুরুত্ব হ্রাস করা যে কঠিন তা যথার্থই অনুভব করেছিলেন। তিনি প্রণোদনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে তুলে ধরেছিলেন।
সঞ্চয়, বিনিয়োগ, কলেজে যোগদান, একটি ব্যবসা শুরু করা, অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ, এক টুকরো সরঞ্জাম কেনা, বা একটি নতুন ধারণা তৈরি করার মতো সিদ্ধান্ত অনেকগুলো কারণের উপর নির্ভর করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলির মধ্যে একটি হলো সুপরিকল্পিত প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকা। একটি জাতি কিভাবে তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবকাঠামো ডিজাইন ও তা পরিচালনা করবে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই ধরনের অবকাঠামো ব্যক্তি, সংস্থা এবং নীতিনির্ধারকদের এমন কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য উপযুক্ত যা সময়ের সাথে সাথে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান মানকেও তৈরি করে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কভিড-১৯ পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী যখন সঙ্কট। যখন অনেক চ্যালেঞ্জ-এর মুখোমুখি ধনী, উন্নত, স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও গরিব দেশগুলো। তখন বহির্বিশ্ব ও অভ্যন্তরীণ দুটি ক্ষেত্রেই আমাদের অর্থনীতি অস্থিরতায়। মনে পড়ে, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ১০ জুন ২০২২ বলেছেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে। এই বাজেট প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যতা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। বাজেটে দারিদ্র্য দূরীকরনে দরিদ্র শ্রেণীর ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।...আগামী বাজেট কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাবে কারণ অনেক উত্থান-পতন হবে। আমরা সব বাধা অতিক্রম করে সফল হতে পারব, ইনশাআল্লাহ। আমরা দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।'...কামাল উল্লেখ করেন যে, কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে যখন সমগ্র বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত, তখন বাংলাদেশের কোনো ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এবং সামষ্টিক অর্থনীতির সব সূচক ভালো ছিল।(সূত্র: বাসস)
বর্তমান এ পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটে আমাদের অর্থের প্রয়োজন, অর্থের প্রয়োজন মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য, অর্থের প্রয়োজন আমদানি অব্যাহত রাখার জন্য, অর্থের প্রয়োজন মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ থেকে আমরা ঋণ এর জন্য ধর্ণা দিচ্ছি অথচ নিজের সম্পদকে কাজে লাগানোতে আমাদের সক্রিয় কৌশল ও উদ্যোগ নেই। সরকার বিরোধীদের আরোপ অর্থনীতি দুর্নীতিবান্ধব, অনৈতিক, অসম্পূ্র্ণ, অপর্যাপ্ত, ব্যবসায়ী বান্ধব, গণবিরোধী ও বৈষম্যপূর্ণ।
সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারে মাধ্যমে নীল অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি বিশাল সম্ভাবনার দেশ। বিগত ২০১৪ সালে, মিয়ানমারের কাছ থেকে আমরা সমুদ্রসীমা জয় করেছি যা আমাদের সমগ্র বাংলাদেশের অন্য অংশের চেয়ে ১.৪ গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্রের আয়তন বর্তমানে ২,০৭,০০০ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেলেও সম্পদ ব্যবহারে এ পর্যন্ত যুগান্তকারী কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। যখন বাংলাদেশ সম্ভাব্য বৈশ্বিক খাদ্য সঙ্কট নিয়ে উদ্বেগ উৎকন্ঠায় তখন সামুদ্রিক সম্পদের এ সেক্টরটিকে অর্থনীতির অগ্রাধিকার ভিত্তিক এজেন্ডায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। কারণ শুধু জলাশয়ের সাথে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নৈকট্য নয় বরং এর প্রচুর সামুদ্রিক খাবার আরোহন এবং মৎস্যজাত পণ্যের ব্যবহার খাদ্য সঙ্কট নিরসনে সহায়ক হবে এ সম্পদ। বাংলাদেশে একটি দক্ষ নীল অর্থনীতি গড়ে তোলার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের সুবিধা নিয়ে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রাজস্ব তৈরি করার মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব হবে। সম্ভব হবে অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করার এবং টেকসই উন্নয়নে বিনিয়োগের মাধ্যমে ঋণ নির্ভরতা কমিয়ে আনার।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ব্লু ইকোনমির আধুনিক সংজ্ঞা টেকসই উন্নয়নের জন্য সমুদ্রের সমস্ত সম্পদ এবং তাদের তলদেশে থাকা সম্পদের ব্যবহার নির্দেশ করে। এখানে "অর্থনীতি" শব্দটি শুধুমাত্র ব্যবসাকেই বোঝায় না বরং সামুদ্রিক জীবন সম্পদের সংরক্ষণ এবং টেকসই ব্যবহারের মতো সামুদ্রিক বিষয়গুলিকেও বোঝায়। তেল এবং গ্যাস ছাড়াও, বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ১৩টি জায়গায় ইউরেনিয়াম-থোরিয়াম এবং সোনার চেয়েও মূল্যবান বালি রয়েছে। সমুদ্র বিজয়ের ফলে বাংলাদেশের ১০ টি গ্যাস ব্লকের মধ্যে টির মালিকানা পায় ভারতের কাছ থেকে এবং ১৩টির মালিকানা মিয়ানমার থেকে। এসব ব্লক থেকে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় পর্যটন শিল্প একটি বিকাশমান খাত এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে যা ক্রমাগত ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দেশের বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে নীল অর্থনীতি ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের সমুদ্র অর্থনৈতিক অঞ্চলে নিরাপত্তা বজায় রাখা, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও উন্নত দেশগুলোর মতো সামুদ্রিক খাবার গ্রহণ যা শীর্ষ মানের প্রোটিনের একটি চমৎকার উৎস, এবং মাংস ও মুরগির সাথে অনুকূলভাবে যা তুলনা যোগ্য। অনেক প্রয়োজনীয় পুষ্টি দিয়ে পরিপূর্ণ সামুদ্রিক খাবার থেকে দেশবাসী বঞ্চিত। প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সামুদ্রিক খাবারে যেমন। ওমেগা -৩, আয়রন, বি এবং ডি ভিটামিন এবং প্রোটিন সহ সমস্ত বয়সে স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্য যেগুলো উপকারী। আমেরিকান ও কানাডিয়ানরা প্রায় প্রতিদিন এসকল খাদ্য অগ্রাধিকার ভিত্তিক খেয়ে থাকে যদিও তা মোটেই সস্তা নয়।
বিশ্বের অনেকগুলো দেশ ক্রমবর্ধমানভাবে ব্লু ইকোনমির ধারণাটি নিয়ে কৌশলগত ভাবে কাজ করছে। কাজ করছে জাতীয় অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ পর্যটন নিয়েও যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম। বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ব্র্যান্ডিং সহ এ খাতটি ভবিষ্যতে উদ্ভাবনের জন্য একটি নকশা তৈরি করতে বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক "বাংলাদেশে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ, উন্নয়ণ এবং অর্থনীতিতে এর অবদান" বিষয়ে ২০শে নভেম্বর রাত ১০ টায় (বাংলাদেশ সময়) একটি ফেইসবুক/জুম্ ভিত্তিক ভার্চুয়াল ডায়লগ আয়োজন করেছে। আলোচনায় দেশের উপকূলীয় জলাভূমি এবং বাস্তুতন্ত্র - যেমন লবণ জলাভূমি, সমুদ্র ঘাসের তৃণভূমি, প্রবাল প্রাচীর এবং ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত বিষয়ও স্থান পাবে। বাংলাদেশে নীল অর্থনীতির সম্ভাবনাগুলো কেন বিবর্ণ তা নিয়ে গণমাধ্যমকে কাজ করতে উৎসাহিত ও প্রশিক্ষিত করা হবে।
[লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার, সভাপতি, বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক, কানাডা নিবাসী]