আলুর মড়ক রোগ ও তার ব্যবস্থাপনা

সমীরণ বিশ্বাস: আলুর মড়ক/নাবী ধ্বসা (Late blight of potato) Phytophthora infestens নামক রোগটি ছত্রাকের আক্রমনে হয়ে থাকে। প্রথমে পাতা, ডগা, ও কান্ডে কিছু অংশ ঘিরে ফেলে। বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি থাকলে ২-৩ দিনের মধ্যে জমির অধিকাংশ ফসল আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ভোরের দিকে আক্রান্ত পাতার নিচে সাদা পাউডারের মত ছত্রাক চোখে পড়ে। আক্রান্ত ক্ষেতে পোড়া-পোড়া গন্ধ পাওয়া যায় এবং মনে হয় যেন জমির ফসল পুড়ে গেছে ।

রোগ বিস্তারে অনুকূল আবহাওয়া:সাধারণত: নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের (মধ্য কার্তিক থেকে মধ্য ফাল্গুন) যে কোন সময় নিম্ন তাপমাত্রা (রাতে ১০-১৬ ডিগ্রি এবং দিনে ১৬-২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এবং কুয়াশাচ্ছন্ন আর্দ্র আবহাওয়া (আর্দ্রতা ৯০% এর বেশি) এ রোগ বিস্তারের জন্য অনুকূল। কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হলে এ রোগ ২-৩ দিনের মধ্যে মহামারী আকার ধারণ করে। বাতাস, বৃষ্টিপাত ও সেচের পানির সাহায্যে এ রোগের জীবাণু আক্রান্ত গাছ থেকে সুস্থ গাছে দ্রুত বিস্তার লাভ করে।

মড়ক রোগের লক্ষণ:
১. রোগের আক্রমণে প্রথমে গাছের গোড়ার দিকে পাতায় ছোপ ছোপ ভেজা হালকা সবুজ গোলাকার বা বিভিন্ন আকারের দাগ দেখা যায়, যা দ্রুত কালো রং ধারণ করে এবং পাতা পঁচে যায়।
২. সকালে মাঠে গেলে আক্রান্ত পাতার নীচে সাদা পাউডারের মত জীবাণু দেখা যায়।
৩. ঠান্ডা ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় আক্রান্ত গাছ দ্রুত পঁচে যায়। এ অবস্থায় ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যেই ক্ষেতে সমস্ত গাছ মারা যেতে পারে।
৪. এ রোগে আক্রান্ত আলুর গায়ে বাদামি থেকে কালচে দাগ পড়ে এবং খাবার অযোগ্য হয়ে যায়।

জৈবিক প্রতিকার:
১.রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে।
২.আক্রান্ত জমিতে সেচ যথা সম্ভব বন্ধ করে দিতে হবে।
৩.সুষম সার প্রয়োগ করা
৪. রোগ প্রতিরোধ জাত লাগাতে হবে।
৫. সুস্থ গাছ থেকে পরবর্তী মৌসুমের জন্য বীজ সংগ্রহ করতে হবে;
৬. ভাইরাস প্রতিরোধী ও সুস্থ বীজ থেকে চারা তৈরি করুন ও শুধুমাত্র সুস্থ গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করুন।
৭. নিয়মিত মাঠ পর্যবেক্ষণ করুন।
৮. বাগান পরিষ্কার রাখা।
৯. আগাম আলু চাষ অর্থাৎ ১৫ নভেম্বরের মধ্যে আলু রোপণ অথবা আগাম জাত চাষের মাধ্যমে এ রোগের মাত্রা অনেকটা কমানো সম্ভব।
১০. আলুর সারি হতে সারির দূরত্ব ৬০ সেন্টিমিটার এবং প্রতি সারিতে আলু হতে আলুর দূরত্ব আস্ত বীজ আলুর ক্ষেত্রে ২৫ সেন্টিমিটার আর কাটা আলুর ক্ষেত্রে ১৫ সেন্টিমিটার অনুসরণ করতে হবে।
১১. নিম্ন তাপমাত্রা, কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও বৃষ্টির পূর্বাভাস পাওয়ার সাথে সাথে রোগ প্রতিরোধের জন্য ৭-১০ দিন অন্তর ম্যানকোজেব গ্রুপের অনুমোদিত ছত্রাকনাশক মিশ্রণ স্প্রে করতে হবে।

রোগ হওয়ার পর করণীয়:
১.আক্রান্ত জমিতে রোগ নিয়ন্ত্রণ না হওয়া পর্যন্ত সেচ প্রদান বন্ধ রাখতে হবে।
২. নিজের বা পার্শ্ববর্তী ক্ষেতে রোগ দেখা মাত্রই ৭ দিন অন্তর নিম্নের যে কোন একটি গ্রুপের অনুমোদিত ছত্রাকনাশক পর্যায়ক্রমিকভাবে নিম্নবর্ণিত হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে গাছ ভালভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।

যেমন:(ম্যানকোজেব ৬০% + ডাইমেথোমর্ফ ৯%)- ২ গ্রাম অথবা (ম্যানকোজেব ৫০% + ফেনামিডন ১০%)- ২ গ্রাম অথবা ( প্রোপিনেব ৭০ % + ইপ্রোভেলিকার্ব)- ২ গ্রাম অথবা (এমেটোকট্রাডিন ৩০% + ডাইমেথোমর্ফ ২২.৫%)- ২ মিলি অথবা (ম্যানকোজেব ৬৪% + সাইমোক্সানিল ৮%)- ২ গ্রাম অথবা (ফ্লুমর্ফ ১০% + ম্যানকোজেব ৫০%)- ২ গ্রাম।

৩.যদি কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া দীর্ঘ সময় বিরাজ করে ও রোগের মাত্রা ব্যাপক হয় সেক্ষেত্রে নিম্নোক্ত ছত্রাকনাশকের যে কোন একটি মিশ্রণ পর্যায়ক্রমিকভাবে নিম্ববর্ণিত হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ দিন অন্তর স্প্রে করে গাছ ভালভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।(কার্বেনডাজিম ৫০%) ১ গ্রাম।
৪. রোগের প্রাদুর্ভাব খুব বেশি হলে ৩-৪ দিন অন্তর ছত্রাকনাশকের মিশ্রণ স্প্রে করতে হবে।
৫. ছত্রাকনাশক পাতার উপরে ও নিচে ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।
৬. সাধারণ স্প্রেয়ারের পরিবর্তে পাওয়ার স্প্রেয়ার ব্যবহার করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
 
সতর্কতা: গাছ ভেজা অবস্থায় জমিতে ছত্রাকনাশক স্প্রে না করাই ভাল। আর যদি স্প্রে করতেই হয় তাহলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে সাবানের গুড়া মিশিয়ে নিতে হবে। ছত্রাকনাশক স্প্রে করার সময় হাত মোজা, সানগ্লাস, মাস্ক ও এপ্রোন ব্যবহার করতে হবে। সবসময় বাতাসের অনুকূলে স্প্রে করতে হবে।  

লেখক:লিড-এগ্রিকালচারিস্ট, মদিনা টেক লিমিটেড, ঢাকা।