দেলোয়ার জাহিদ:বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জনের বিপুল সম্ভাবনা বাধাগ্রস্ত করছে সামুদ্রিক দূষণ। পৃথিবীতে জীবন টিকিয়ে রাখতে সাগর ও মহাসাগর গুলোর অপরিহার্যতা এখন বিতর্কাতীত। পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ বৃহত্তম বাস্তুতন্ত্র এর মধ্যে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের প্রধান। বঙ্গোপসাগর দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বিশ্বের ৬৪টি উপসাগরের একটি। সমুদ্র অর্থনীতি তিনটি মাত্রায় উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে উন্নত করে: পরিবেশগত, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক। প্রায় ২৬টি সামুদ্রিক অর্থনৈতিক কাজকে খাদ্য উৎপাদন, খনিজ উত্তোলন, মৎস্যসম্পদ, জৈবপ্রযুক্তি, সামুদ্রিক বাণিজ্য, শিপিং, পর্যটন, উপকূল সুরক্ষা, সামুদ্রিক পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ইত্যাদি সম্বলিত নীল অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ,তথা পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
সম্প্রতি ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সরকার, নীল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য পাঁচটি কৌশলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে মৎস্য আহরণ, তেল, গ্যাস ও বন্দর সম্প্রসারণ এবং পর্যটনখাত গুলো যথাযথভাবে ব্যবহার করলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে। পারে প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করতে।
সমুদ্র অর্থনীতির বিশাল এ সুযোগের বিপরীতে, অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হল সামুদ্রিক দূষণ। সামুদ্রিক পরিবেশে পদার্থ বা শক্তির প্রবর্তনকে অন্তর্ভুক্ত করে সামুদ্রিক পরিবেশ দূষণ যার ফলশ্রুতিতে সমুদ্রের জলের গুণমান হ্রাস এবং সুযোগ-সুবিধা হ্রাসের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে জীবন্ত সম্পদ, সামুদ্রিক জীবন ও মানব স্বাস্থ্যের উপর।
ভূমি ভিত্তিক এবং সমুদ্র ভিত্তিক দূষণ হল দূষণের দুটি প্রধান উৎস; মোট সামুদ্রিক দূষণের ৪০% শুধুমাত্র ভূমি ভিত্তিক উৎস দায়ী এবং যা বাংলাদেশের সামুদ্রিক পরিবেশ দূষণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবদান রাখে এমন আরো অনেকগুলো কারণও রয়েছে। দেশে উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক অঞ্চল গুলো এখন হুমকির সম্মুখীন অপরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, উপকূলীয় উন্নয়ন, উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসের অনিয়মিত বৃদ্ধি ও শিল্পের ময়লা, প্লাস্টিকের ব্যবহার, প্লাস্টিক উত্পাদন এবং বর্জ্য রোধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতা, সঠিকভাবে রিসাইকেল না করা।
সমুদ্র সৈকত বা নদীগুলো পরিচ্ছন্নতায় উদ্যোগ না নেয়া পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। স্থল এবং সমুদ্র ভিত্তিক উত্সগুলি সম্মিলিতভাবে জীবাণু দূষণ তৈরি করে, যা উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক অঞ্চলকে স্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে। জীবাণু দূষণের মধ্যে রয়েছে শিল্পের ময়লা, অপরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, উপকূলীয় উন্নয়ন, উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসের অনিয়মিত বৃদ্ধি ইত্যাদি।
সামুদ্রিকদূষণ দেশে নীল অর্থনীতির বৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এ ছাড়াও পানি দূষণ, মাটি দূষণ, বায়ু দূষণ, তেজস্ক্রিয়জনিত দূষণ, পরিবেশ দূষণ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এ পৃথিবীকে অনিরাপদ করে তুলছে যা রোধ করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সর্বোপরি পরিবেশ দুষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে একটি ভয়াবহ তথ্যচিত্র উঠে এসেছে যেখানে বলা হয়েছে- প্রতি বছর প্রায় ৮০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী সমুদ্রযানের বর্জ্য পদার্থ দিয়ে আক্রান্ত হয়, আর এসবের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই হচ্ছে প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য। বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ রোধকে জাতীয় একটি আন্দোলনে পরিণত করতে উৎসাহী কতগুলো সংগঠন।
বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক এর কোস্টাল১৯, কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স, চেম্বার অব কমার্স ভ্যালু চেইন গ্রুপ এমন একটি সমন্বিত আন্দোলনের প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে। এতে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা "স্টেপ টু হিউম্যানিটি অ্যাসোসিয়েশন" প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করতে ও সম্মত হয়েছে।
সামুদ্রিক দূষণ ও পরিবেশের উপর চাপের আর আধিক্য নয় বরং পরিবেশ দূষণ কমিয়ে আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর বাংলাদেশ তৈরি করতে পারবো। এর অংশ হিসেবে পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে শুধুমাত্র সরকার, সংস্থা বা কোনো ব্যক্তি বিশেষ নয়, বরং আমরা সকলে এ দায়িত্ব পালন করবো।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে কোস্টাল ১৯ এ অঙ্গিকার এবং স্বকণ্ঠ উচ্চারণ হবে- " যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে সরাবো জঞ্জাল এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি ... " ।
[লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার, সভাপতি, বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক, কানাডা নিবাসী]