সাইফুল ইসলাম:খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক চাহিদা। তন্মধ্যে খাদ্য হলো মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান মৌলিক চাহিদা যা স্বাস্থ্যের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। সুস্বাস্থ্য জীবন ধারণের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য প্রয়োজন। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ (ক) ও ১৮(১) অনুচ্ছেদ এবং জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২৫/১ অনুযায়ী সকল নাগরিকের খাদ্যের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা আবশ্যক।
পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের বিষয়টিকে প্রধান্য দিয়ে ১৯৭৫ সালের ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশ পুষ্টি পরিষদ গঠনের আদেশ স্বাক্ষরিত হয়। নিরাপদ খাদ্য বলতে প্রত্যাশিত ব্যবহার ও উপযোগিতা অনুযায়ী মানুষের জন্য বিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত আহার্য। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ, আমদানি, মজুদ, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয় সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের সমন্বয় ও কার্যকর আইন জরুরি। বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে খাদ্য উদ্বৃত্তের (ব্রি’র তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪২ লাখ টন) দেশে পরিণত হলেও নিরাপদ খাদ্য তথা খাদ্যের মান নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। খাদ্য নিরাপত্তাকে পাশ কাটিয়ে এখন আলোচনার মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নিরাপদ খাদ্য।
এদেশে বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য না পাওয়ার দায় উৎপাদক থেকে শুরু করে মধ্যস্বত্বভোগী তথা মুনাফালোভীদেরই। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ফসলের মাঠে কৃষকেরা মাত্রাতিরিক্ত সার, আগাছানাশক, কীটনাশক, বালাইনাশক, এন্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন ইত্যাদি অপপ্রয়োগ করে। উৎপাদকের পাশাপাশি আড়তদার, মজুদদার, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাসহ মুনাফালোভীরা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন রাসায়নিক তথা সোডিয়াম সাইক্লোমেট, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, খাবারে সুগন্ধি, রং, পোড়া ও মবিলমিশ্রিত তেল, প্রভৃতি ব্যবহার করে। এই অনিরাপদ খাদ্য রোগ ও অপুষ্টির একটি দুষ্টচক্র তৈরি করে যা গর্ভবতী, নবজাতক, শিশু, কিশোর, বৃদ্ধসহ সকল বয়সের মানুষকে প্রভাবিত করে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ বাংলাদেশের এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে আমরা বরাবরই সর্বস্তরে উদ্বিগ্ন। খাদ্যের প্রধান উৎস শস্য, শাকসবজি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ। মাছ-মাংস, ফলমূল ও শাকসবজি কিনতে গিয়ে আমাদের প্রায়ই দ্বিধায় পড়তে হয়। খাদ্যের রূপান্তর ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ইচ্ছাকৃত বা অসাবধানতা অথবা ভুলবশত অনিরাপদ হয়ে থাকে। খাদ্যে ভেজালের কারণেই মানুষের বিভিন্ন রোগ যেমন গ্যাস্ট্রিক, ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেইলিউর, হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানিসহ আরও জটিল রোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর এ ব্যবস্থা নিরসনে সর্ব প্রথমে খাদ্যকে নিরাপদ করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বর্তমান কৃষি ও খাদ্যবান্ধব সরকার ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য ২০১৫ সালে ২ ফেব্রুয়ারি গঠন করেছে ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’। এছাড়াও সময়ে সময়ে বিভিন্ন নির্দেশনা এবং প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ভোক্তা অধিদপ্তর নিরাপদ খাদ্য অভিযান পরিচালনা করছে। বিএসটিআই মান নিয়ন্ত্রণের লাইসেন্স প্রদান আর ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ মনিটরিং করে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ও তা সমন্বয়ের চেষ্টা করছে। সবাইকে ভেজালবিরোধী সচেতনতা ও আন্দোলন সৃষ্টির মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। উৎপাদক থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। এ জন্য গণমাধ্যমকেও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।
সার্বিকভাবে দেখা যায়, বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তার চেয়ে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার নিশ্চিতে অনেকটা পিছিয়ে আছে। আইসিডিডিআরবি -এর তথ্যানুসারে, পৃথিবীর প্রায় ১৫০ মিলিয়ন পাঁচ বছরের নিচের শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। এর মধ্যে প্রায় ৬ লাখ শিশু তীব্র পুষ্টিহীনতায় এবং ৪৩ শতাংশ পাঁচ থেকে ছয় বছরের শিশু অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। আর ২৮ শতাংশ শিশু বয়সের তুলনায় উচ্চতা অনেক কম অর্থাৎ খর্বাকৃতি, ১০ শতাংশ শিশু উচ্চতার তুলনায় ওজন অনেক কম অর্থাৎ ক্ষীণকায় এবং ২৩ শতাংশ শিশু অস্বাভাবিক কম ওজনের হয়ে থাকে। অন্যদিকে, প্রায় অর্ধেক নারী অ্যানিমিয়ায় ভুগে থাকেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-এর লক্ষ্য হলো অনিরাপদ খাবারের সাথে যুক্ত জনস্বাস্থ্যের হুমকি প্রতিরোধ, সনাক্তকরণ এবং প্রতিক্রিয়া জানানো। ভেজাল উৎপাদন উপকরণের জন্য কৃষকের পক্ষে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করা বড় চ্যালেঞ্জ। উদ্যোক্তা ও ভোক্তা উভয়েই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে বিপদে থাকেন। উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ এবং বিপণনের প্রতিটি পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য সহায়ক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে নিম্নোক্ত প্রস্তাবসমূহ তুলে ধরা হলো:
১. খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায়
ক) খাদ্য উৎপাদনে ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদান যেমন আগাছানাশক, কীটনাশক, এন্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন, ভারী ধাতু ইত্যাদি ব্যবহারে কৃষক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা;
খ) খাদ্য উৎপাদনে বায়ো-ফার্টিলাইজার, বায়ো-পেস্টিসাইড, জৈব বালাইনাশক, ফেরোম্যান ট্র্যাপ, পার্চিং, নিরাপদ সংরক্ষক ইত্যাদি নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা;
গ) নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনে লাগসই প্রযুক্তি গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা;
ঘ) স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য উৎপাদনে সহায়ক উপকরণ ভর্তুকির মাধ্যমে সরবরাহ করে সহজলভ্য করা; ও
ঙ) সমবায় চাষাবাদ পদ্ধতিতে ফসল সংগ্রহোত্তর কার্যক্রম ও নির্মাণ এবং পরিবহন ব্যবস্থা করা।
২. প্রক্রিয়াজাতকরণ, সরবরাহ, বিপণন ব্যবস্থায়
ক) নিরাপদ খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা;
খ) উৎপাদিত খাদ্যের বিবরণ ও ব্যবহৃত উপাদান, পুষ্টি ও বিশেষ পথ্যগুণ এবং সম্ভাব্য ঝুঁকি/পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ইত্যাদি মোড়কে নিশ্চিত করা;
গ) ব্যক্তি বা কমিউনিটি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকরণ প্লান্ট স্থাপনে সহায়তা করা;
ঙ) বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নভিত্তিক সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণের অবকাঠামো গড়ে তোলা;
চ) গুণগত মানসম্মত খাদ্যের ব্র্যান্ড সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা; ও
ছ) নিরাপদ খাবার বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাজার কমিটি বা কমিউনিটি কর্তৃক সত্যায়িত নিরাপদ খাবার বিপণন ব্যবস্থাপনা তৈরি করা।
৩. অর্থায়নে উৎসাহিতকরণ
ক) নিরাপদ খাদ্য গবেষণা ও সম্প্রসারণে আর্থিক সুবিধা প্রদান করা;
খ) বিশেষ তহবিল গঠন করার মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ;
গ) ‘ভ্যালু চেইন’ ব্যবস্থাপনায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ চালু করা; ও
ঘ) নিরাপদ খাদ্যে সহজলভ্য এবং স্বল্প সুদে ঋণ পাবার নিশ্চয়তা বৃদ্ধি করা।
৪. বাজার বা পরিবহণ ব্যবস্থায়
ক) দেশের সকল বাজারের অবকাঠামো উন্নয়ন করা;
খ) নিরাপদ খাদ্য বিক্রয়কেন্দ্র বা বাজার তৈরিতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা;
ঘ) নৌপথ, রেলপথসহ সকল ক্ষেত্রে বিশেষ পরিবহন ব্যবস্থাপনা তৈরি করা; ও
ঙ) পথখাবারের দোকান, খুচরা বিক্রেতা, হোটেল, রেস্তোরাঁসহ খাদ্য পরিবেশনে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা।
৫. আইন, বিধি ও প্রয়োগে
ক) উৎপাদনকারী, মধ্যসত্ত্বভোগী ও ভোক্তা পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য আইন সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করা;
খ) নিরাপদ খাদ্য সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা তৈরি করা;
গ) বাজার ও ভোক্তা পর্যায়ে মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা সহজলভ্য করা;
ঘ) প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ভোক্তা অধিদপ্তর ও বিএসটিআই কর্তৃক অভিযান পরিচালনা এবং হাট-বাজারভিত্তিক কমিটি গঠন করে নিরাপদ খাদ্য বিপণন তদারকি করা; ও
ঙ) নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে একটি ‘হটলাইন সেবা’ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কিত স্বাস্থ্যবিধির পাঁচটি মূলনীতি হলো:
১. মানুষ, গৃহপালিত প্রাণী ও কীটপতঙ্গ থেকে রোগজীবাণু খাদ্যে সংক্রমণ হওয়া প্রতিরোধ করা;
২. কাঁচা ও রান্না করা খাবার আলাদা করে রাখা যাতে রান্না করা খাবারে জীবাণুর সংক্রমণ না হতে পারে;
৩. পর্যাপ্ত দৈর্ঘ্যের সময় ধরে ও যথাযথ তাপমাত্রায় খাদ্য রান্না করা যাতে খাদ্যের রোগজীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়;
৪. সঠিক তাপমাত্রায় খাদ্য সংরক্ষণ করা; ও
৫. নিরাপদ পানি বা জল ও নিরাপদ কাঁচামাল ব্যবহার করা।
অনিরাপদ খাদ্য মূলত খাদ্য না। ভেজাল খাদ্যে মানুষ শারীরিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উৎপাদিত পণ্য আন্তর্জাতিক মানের না হওয়ায় রপ্তানি করতে গিয়ে বারবার সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে সময়ে সময়ে নির্দেশনা, আইন, বিধি-প্রবিধি প্রণীত হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন করতে গেলে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ দরকার। নিরাপদ খাদ্য একটি সুস্থ্য জাতি গঠন তথা ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
লেখক পরিচিতি:গবেষক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট
ময়মনসিংহ-২২০২