স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মান ও খাদ্য নিরাপত্তাবিধানে কৃষিবিদদের ভূমিকা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রাপ্তি

কৃষিবিদ মোঃ শহিদুল্লাহ্: প্রাকৃতিক সম্পদের অপর্যাপ্ততা ও জনবহুল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কাঠামো সুদীর্ঘ কাল থেকে কৃষির উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। স্বাধীনতা পঞ্চাশ বৎসর পরেও কৃষি এদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। এখনো দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠি কৃষি পেশায় নিয়োজিত। একক সেক্টরের সাফল্য বিবেচনা করলে কৃষি এদেশে পাঁচ দশক ধরে চ্যাম্পিয়ন অবস্থানে আছে, একথা নির্দিধায় বলা যায়।

কৃষির সাফল্যে সরকারের নীতি-নির্ধারক থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ ও আপামর জনতার কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়। বাংলাদেশে কৃষির সাফল্যের জয়গান মহান জাতীয় সংসদ, মন্ত্রীসভা, মিডিয়া ও জনমানুষের মুখেমুখে; ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠি ও ক্রমহ্রাসমান ফসলী জমির দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করায় দেশের সর্বস্তরের নাগরিকগন কৃষক ও কৃষির প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। সাম্প্রতিক করোনা অতিমারী চলাকালীন যখন সকল সেক্টর দীর্ঘদিন প্রায় বন্ধ হয়ে ছিল, তখন কৃষকের ফসলের মাঠে কৃষি কর্মকর্তাগণের পদচারনায় মুঠি মুঠি সোনার ফসল কৃষক ঘরে তুলে, যার প্রেক্ষিতে দেশ ছিল নির্ভার ও ক্ষুধামুক্ত। করোনাকালীন স্থবির সময়ে নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে কৃষিবিদগন দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা অব্যাহত রাখার প্রয়াসে কর্মমুখর ছিল; ফলশ্রুতিতে, সেসময়কার অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে কৃষক সাহস হারায়নি; কৃষক দেখেছিল সরকার কৃষি বিভাগের কৃষি কর্মকর্তাগন তাদের পাশে আছে।

সুধীজন একমত হবেন যে, বাংলাদেশের কৃষি আলাদিনের চেরাগ পেয়ে রাতারাতি সাফল্যের শিখরে উঠে যায় নি। কৃষিবিদদের দীর্ঘদীনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টারে ফলে বাংলার কৃষকগন আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি গ্রহনে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। দীন-হীন শীর্নকায় কৃষক আজ স্মার্ট আধুনিক কৃষকে পরিনত হয়েছে। দেশ আজ খোরপোশ কৃষি উৎপাদন থেকে বেরিয়ে বানিজ্যিক কৃষির দিকে ধাবিত হয়েছে। কৃষি অধুনা লাভজনক ব্যবসায় পরিনত হয়েছে। বাংলাদেশের কৃষির আমূল পরিবর্তনে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের নীতি সহায়তা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি কৃষকদের প্রচেষ্টা ও কৃষিবিদদের ভূমিকা অগ্রগন্য। গত দেড় দশকে কৃষি অন্তঃপ্রান সরকারের কৃষি উন্নয়ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে এদেশের কৃষিবিদ সমাজ অকুন্ঠ সমর্থন ও বাস্তবায়নের সর্বাত্তক প্রচেষ্টা গ্রহন করায় দেশ আজ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ন হয়েছে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে কৃষি পন্য রফতানির মাধ্যমে রফতানি বাস্কেট বড় করার প্রয়াস পেয়েছে।

গত এক দশকে দেশ অনেকখানি এগিয়েছে, রাস্ট্রের প্রশাসনযন্ত্রের বিভিন্ন সেক্টর সমান তালে এগিয়ে গেছে। যখন কৃষিবিদদের ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠা ও মেধার সফল প্রয়োগে কৃষি সেক্টরে অভূতপূর্ব সাফল্যে এসেছে তখন আমরা কৃষিবিদ গত এক দশকে নিজেদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির হিসেব-নিকেশে কতদূর এগিয়েছি? কতটুকু নিজেদের মানোন্নয়ণ করতে পেরেছি? সফলতার আনুপাতিক হারে সাজঘরে প্রাপ্তির পরিমান অনেক কম। পেশাগত উৎকর্ষতাসাধনে আগ্রহ চেষ্ঠার যথেষ্ঠ ঘাটতি দৃশ্যমান; যার ফলে কৃষিবিদ শব্দটি শক্তপোক্তভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি।

দেশের অগ্রগতির সাথে সকল পেশাজীবীগন যখন তাদের পেশাগত পরিবেশ কে উন্নত করেছে, নিজ নিজ পেশার উৎকর্ষ সাধনে সফল হচ্ছে, তখন আমরা কৃষিবিদগন নিজ শ্রেনীর অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনে কি পদক্ষেপ গ্রহন করছি। এটা ভাববার বিষয়; এই ভাবনা হওয়া উচিত সকল কৃষিবিদদের।

১৩ ফেফ্ব্রুয়ারী, ঋতুরাজ বসন্তের আগমনের ঠিক একদিন পূর্বে, মনদোলানো ঝিরিঝিরি বাতাসে অনুষ্ঠিত হলো দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার কারিগর, কৃষিবিদদের জাতীয় অনুষ্ঠান কৃষিবিদ দিবস। বাংলাদেশের কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার অন্যতম বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্ত্বরে ও রাজধানী ঢাকার কৃষিবিদ ইন্সটিটিউটে হাজার হাজার কৃষিবিদদের পদচারনায় মুখরিত ছিল দিনটি। বরেন্য প্রথিতযশা কৃষিবিদগণ, সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের প্রভাবশালী রাজনৈতিকবৃন্দ ও কৃষি সেক্টরে নিয়োজিত সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হাজার হাজার কৃষিবিদ এ মহামিলন মেলায় অংশগ্রহন করেন। মিলনমেলায় আগত কৃষিবিদদের ঐকান্তিক কামনা, একমাত্র চাওয়া, সামষ্ঠিক উন্নয়নে প্রয়োজন কৃষিবিদদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। বাংলাদেশের সকল কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তীর্ন গ্রাজুয়েটদের স্থান কাল পাত্র ছাপিয়ে কৃষিবিদ পরিচয়টি মুখ্য হয়ে উঠুক। কৃষি গ্রাজুয়েটগণের কৃষিবিদ পরিচয়টি সার্বজনীন হয়ে উঠুক।

কৃষি সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলির আন্তঃপ্রতিযোগীতা পরিহার করে পরস্পরের সহযোগী হয়ে নিজেদের সৃজনশীলতা ও মেধার স্বাক্ষরে স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নেয়ার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন করাই হোক কৃষিবিদ দিবসের ব্রত। দেশে বিদ্যমান অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠনের ন্যায় কৃষিবিদ ইন্সটিটিউট কৃষিবিদদের মর্যাদা বৃদ্ধি ও কৃষিবিদদের সামষ্টিক কল্যানে নিয়োজিত থাকবে-এটাই আপামর কৃষিবিদদের প্রত্যাশা।
আগামী ১৩ ফেফ্ব্রুয়ারী হোক কৃষিবিদদের একক সন্মিলন, যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে কৃষিবিদদের উজ্জীবিত করবেন, দেশ মাতৃকার সেবায় অধিকতর আত্ননিয়োগ করতে এবং কৃষিবিদ নেতৃবৃন্দ কৃষিবিদদের উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট রুপ-রেখা প্রণযন করবেন। কৃষির সাফল্যের জয়জয়কারের মতো কৃষিবিদদের মর্যাদা ও পেশাগত সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবছর সুনিদিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে অনুষ্ঠিত হোক সকল কৃষিবিদের প্রানের অনুষ্ঠান কৃষিবিদ দিবস।

লেখক: সহকারী প্রকল্প পরিচালক, রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা