-ডাঃ নন্দ দুলাল টীকাদার:বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রধানত ২ পদ্ধতিতে ছাগল পালন করা হয় - সাধারণ বা পারিবারিক পদ্ধতি (ক্ষুদ্র পারিবারিক খামার) ও বিশেষ পদ্ধতি - (মাঝারি ও বৃহৎ বানিজ্যিক খামার)।
সাধারণ বা ক্ষুদ্র পারিবারিক পদ্ধতিতে ছাগল পালন
ক্ষুদ্র পারিবারিক পদ্ধতিতে ছাগল পালনের ক্ষেত্রে সাধারণত ১ - ৫টি ছাগল পালন করা হয়। এই পদ্ধতিতে অল্প ছাগল দিনের বেলায় বাড়ির আঙিনায়, রাস্তার পাশে, নদীর পাড়ে বা মাঠে চরিয়ে রাতের বেলায় মানুষের বসত ঘরে, বসত ঘরের বারান্দায়, রান্না ঘরে, ঘর সংলগ্ন ছোট চালা ঘরে পালন করা হয়। কাঁচা ঘাসের সাথে রান্না ঘরের তরকারীর খোসা, লতাপাতা ইত্যাদিও খাওয়ানো হয়। দানাদার খাবার খুব কম পরিমানে খাওয়ানো হয়। ভাতের মাড়, চালের কুড়া, গমের ভূষি ব্যাতীত অন্য কোন দানাদার উপাদান প্রায়ই দেয়া হয় না।
পারিবারিকভাবে লালন পালন করা হয় বলে বাড়তি জনবল প্রয়োজন হয় না বা জনবল বাবদ খরচ হিসাব করা হয় না। আলাদা জমিরও প্রয়োজন হয় না বিধায় এই পদ্ধতিতে ছাগল পালন ক্ষুদ্র পরিসরে অত্যন্ত লাভজনক। গ্রামীন দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষ করে বিধবা, স্বামী পরিত্যাক্তা, দুস্থ ও বয়স মতিলাদের জন্য এই পদ্ধতিতে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন জীবন জীবিকার অন্যতম অবলম্বন।
বাচ্চা ছাগল পালন ব্যবস্থাপনা
মায়ের দুধ ছাড়ানোর পূর্বে বাচ্চা ছাগল পালন ব্যবস্থাপনা
• যেসব বাচ্চা দুর্বল উষ্ক খুষ্ক তাদেরকে মায়ের দুধের পাশাপাশি মাল্টিভিটামিন মিনারেল ও পর্যাপ্ত পরিমানে স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
• দুধ বন্ধ করানোর পূর্বেই বাচ্চাকে দানাদার ও আঁশ জাতীয় খাবারের সাথে অভ্যস্থ করতে হবে।
• যে সব বাচ্চাকে বোতলে দুধ খাওয়ানো হয় সকল পর্যায়ে পরিস্কার পরিচছন্নতা বজায় রাখতে হবে এবং ঠান্ডা দুধ খাওয়ানো যাবে না।
ক্ষুদ্র খামারে বাচ্চাকে দুধ ছাড়ানো (Weaning)
• ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের বাচ্চা ৩-৪ মাসের মধ্যে দুধ ছেড়ে দেয়।
• ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের বাচ্চা সাধারণত ৩-৪ মাস বয়সে ৩-৪ কেজি ওজন হয়। এই সময় তাদের ঘাস জাতীয় খাদ্য হজম করার শক্তি পুরোপুরি হয় না।
• পাঁঠা বাচ্চাকে মায়ের দুধ ছাড়ানোর পর থেকেই আলাদা রাখতে হয়।
ছাগল ছানার কলস্ট্রাম ও দুধ খাওয়ানো
জন্মের পরপরই ছাগল ছানাকে কলস্ট্রাম বা শাল দুধ খাওয়াতে হবে। প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ছাগল ছানাকে ১৫০-২০০ গ্রাম শাল দুধ খাওয়াতে হবে। এ পরিমান দুধ দিনে ৮-১০ বারে খাওয়াতে হবে। শাল দুধ খাওয়াতে দেরি হলে হজমে সমস্যা হয়। জন্ম হতে তিন মাস পর্যন্ত ছাগল ছানাকে নিম্নোক্ত হারে খাদ্য প্রদান করতে হবে।
ছাগলের বাচচাকে মিল্ক রিপ্লেসার বা বিকল্প দুধ খাওয়ানো
ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের একটি ছাগী এক সাথে ৩-৪টি বাচ্চা প্রসব করে। কিন্তু ছাগীর দুধের বাট ২টি হওয়ায় সবগুলি বাচ্চা একসাথে মায়ের দুধ খেতে পারে না। ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল বাচ্চা আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। আবার ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগীদ দুধ উৎপাদন ক্ষমতা কম বিধায় বাচ্চা বেশি হলে মায়ের দুধ থেকে তাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয় না। এক্ষেত্রে ছাগল ছানাকে নিম্নোক্ত মিশ্রন অনুযায়ী মিল্ক রিপ্লেসার খাওয়ানো যেতে পারে।
উক্ত মিশ্রনের একভাগ, নয় ভাগ উষ্ণ (৩৯-৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস) পানির সাথে ভালমত ফুটানোর পর ঠান্ডা করে ছাগল ছানাকে খাওয়াতে হবে।
ক্ষুদ্র বা পারিবারিক খামারে দুগ্ধবতী ছাগল পালন ব্যবস্থাপনা
দুগ্ধ দোহন
• ভালো ব্যবস্থাপনায় ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বাচ্চাকে খাওয়ানোর পরও দৈনিক ৫০০-১০০০ গ্রাম দুধ পাওয়া যেতে পারে।
• যেসব ছাগী পর্যাপ্ত দুধ দেয় তাদেরকে নিয়মিত দুধ দোহন করলে দুধের উৎপাদন বাড়ে।
• দুধ দোহনের পূর্বে ছাগলকে একটি পরিস্কার জায়গায় কিছু দানাদার খাদ্য বা আকর্ষনীয় কাঁচা ঘাস পাতা দেওয়া উচিৎ।
• দুধ দোহনের পূর্বে দুই হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার গামছা বা পরিস্কার কাপড় দিয়ে মুছে নেওয়া উচিৎ।
• ছাগলের ওলানকে পর্যায়ক্রমে পিছন থেকে সামনের দিকে মালিশ করতে হবে।
• দুধ দোহনের সময় বাঁটের গোড়ায় আটকে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও কনিষ্ঠ আঙ্গুল দিয়ে ধীরে ধীরে চাপ দিয়ে বাঁটের সম্পূর্ণ দুধ বের করতে হবে।
দুগ্ধবতী ছাগলের সাধারণ পরিচর্যাসমুহ
• ছাগলকে প্রতিদিন সকালে ঘর থেকে বের করে খোয়াড়ে কিংবা ঘরের আশেপাশে খোলা যায়গায় চরতে দিতে হবে।
• এদেরকে ব্যায়াম ও গায়ে সূর্য কিরণ লাগানোর পর্যাপ্ত সুযোগ প্রদান করতে হবে।
• ঘর থেকে ছাগল বের করার পর ঘর ভালোভাবে পরিস্কার কওরতে হবে।
• ছাগলকে সুষম খাবার সরবরাহ করতে হবে।
• প্রতিটি ছাগলকে আলাদাভাবে দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
• পাতাসহ আম কাঁঠালের ডাল ঝুলিএঈ সরবরাহ করতে হবে।
• ছাগল পানিতে ভিজতে পছন্দ করে না। তাই নিয়মিত গোসলের পরিবর্তে ব্রাশ দিয়ে ঘষে দেহ পরিস্কার করতে হয়।
• প্রতিডিন নির্দিষ্ট সময়ে দুগ্ধবতী ছাগীর দুধ দোহন করতে হবে।
• কোন ছাগলের মধ্যে অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে পৃথক করে চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করতে হবে।
• সকল বয়সের ছাগলকে নিয়মিত কৃমিনাশক ঔষধ খাওয়াতে হবে ও টিকা দিতে হবে।
বিশেষ পদ্ধতিতে ছাগল পালন
বেশি পরিমানে বা বড় আকারে খামার করে বানিজ্যিক ভিত্তিতে ছাগল পালন করতে সাধারণ পারিবারিক ক্ষুদ্র খামারে ছাগল পালন অপেক্ষা বেশি যত্ন বা উন্নত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হয়। সেমি ইনটেনসিভ ও ইনটেনসিভ বা স্টল ফিডিং পদ্ধতিতে বানিজ্যিক খামারে ছাগল পালন করা হয়। সাধারনত নবীন উদ্যোক্তা, তরুন যুবক যুবতী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্মচারীরা আজকাল বিশেষ পদ্ধতিতে ছাগল পালনে উদ্যোগী হয়েছেন।
সেমি ইন্টেনসিভ পদ্ধতিতে ছাগল পালন
সেমি ইন্টেনসিভ বা আধা নিবিড় পদ্ধতিতে খামারে ২০ বা ততোধিক সংখ্যক পালন করা যায়। এ পদ্ধতিতে ছাগলকে দিনের বেলায় প্রাকৃতিক পরিবেশে খামারের নিজস্ব জমিতে চরানো হয় এবং রাতের বেলায় ঘরে আবদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়। ছাগলের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য দানাদার খাদ্য ও কাাঁচা ঘাস সরবরাহ করা হয়।
স্টল ফিডিং পদ্ধতিতে ছাগল পালন
স্টল ফিডিং পদ্ধতিতে ছাগলের ঘর – স্টল ফিডিং পদ্ধতিতে পালনের জন্য প্রতিটি বয়স্ক ছাগলের জন্য প্রায় ১০ বর্গ ফুট ঘরের জায়গা প্রয়োজন হয়। ঘরটি বাঁশ, কাঠ বা ইটের তৈরি হতে পারে।
স্টল ফিডিং পদ্ধতিতে ছাগলের বাচ্চার পরিচর্যা– এক মাস বয়স পর্যন্ত ছাগল ছানাকে দিনে ১০-১২ বার দুধ খাওয়াতে হবে। বাচ্চার চাহিদার তুলনায় মা ছাগীতে দুধ কম পাওয়া গেলে অন্য ছাগীর দুধ বাচ্চাকে খাওয়াতে হবে। এছাড়া ছাগীর দুধ পাওয়া না গেলে বিকল্প দুধ বা মিল্ক রিপ্লেসার খাওয়াতে হবে। এক হতে দেড় কেজি ওজনের একটি ছাগল ছানার দৈনিক ২৫০-৩০০ গ্রাম দুধ প্রয়োজন। ওজন বৃদ্ধির সাথে দুধের পরিমান বৃদ্ধি করতে হবে। বাচ্চার ১ মাস বয়স হতে ধীরে ধীরে কাঁচা ঘাস ও দানাদার খাদ্যে অভ্যস্ত করতে হবে।
স্টল ফিডিং পদ্ধতিতে ছাগলকে খাওয়ানো- ছাগল সাধারণত তার দৈহিক ওজনের ৪-৫% হারে খেয়ে থাকে। একটি বাড়ন্ত খাসীকে দৈনিক ২০০-২৫০ গ্রাম দানাদার খাবার প্রদান করতে হবে। দুই থেকে তিন বাচ্চা বিশিষ্ট ২৫ কেজি ওজনের ছাগীর দৈনিক ৩৫০-৪৫০ গ্রাম দানাদার খাদ্য প্রয়োজন হয়। একটি প্রাপ্ত বয়স্ক পাঁঠার দৈনিক ২০০-৩০০ গ্রাম দানাদার খাদ্য প্রয়োজন।
স্টল ফিডিং পদ্ধতিতে একটি বাড়ন্ত খাসীকে দৈনিক ১.০-১.৫ কেজি কাঁচা ঘাস প্রদান করতে হয়। ২ থেকে ৩ বাচ্চা বিশিষ্ট ২৫ কেজি ওজনের ছাগীকে দৈনিক ১.৫-২.৫ কেজি কাঁচা ঘাস এবং একটি প্রাপ্ত বয়স্ক পাঁঠাকে দেনিক ১.৫-২.৫ কেজি কাঁচা ঘাস প্রদান করা প্রয়োজন। ঘাস পাওয়া না গেলে খড়কে ২ – ৩ ইঞ্চি পরিমাপে কেটে ইউরিয়া মোলাসেস দিয়ে মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে।