কৃষিবিদ সমীরণ বিশ্বাস: সব ফসলের জন্যই পানি প্রয়োজন, কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক স্থান রয়েছে, যেখানে দীর্ঘ সময় জলাবদ্ধতা থাকে। বাংলাদেশের কিছু কৃষক এই সমস্যার একটি সুকৌশলী সমাধান উদ্ভাবন করেছেন। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ধাপপদ্ধতি বা ভাসমান বেডে চাষ করা হচ্ছে শাক-সবজি ও মশলা। উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের বন্যাবাড়ী, মিত্রডাঙ্গা, জোয়ারিয়া, পাথরঘাটা, চাপরাইল, রুপাহাটিসহ আরো কয়েকটি গ্রামের কৃষকরা ভাসমান বেডে চাষাবাদ শুরু করেছেন।
কৃষকরা পচনশীল উদ্ভিদ দিয়ে একটি ভাসমান বাগান তৈরি করে থাকেন, যা সার হিসেবে কাজ করে। বিল, নদী বা যে কোনো মৌসুমি জলাশয়ে এ ধরনের বাগান ভেসে থাকতে পারে। এর ফলে পানির উপরে ফসল ফলানো সম্ভব হয়। এ পদ্ধতিতে ভাসমান বাগানে কৃষকরা কোনো ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার না করেই উচ্চ ফলনশীল এবং পুষ্টিমানসম্পন্ন ফসল উৎপাদন করতে পারছেন। বাংলাদেশের ভাসমান সবজি চাষ বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী চাষপদ্ধতির স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই স্বীকৃতিপত্র কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে পৌঁছেছে। ২০০৫ সালে এই স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশে ।
ভাসমান বাগান বা বেডের তৈরি :
ভাসমান বাগান তৈরি করার আগে এমন একটি স্থান নির্বাচন করতে হবে, যেখানে বর্ষা মৌসুমে প্রচুর কচুরিপানা পাওয়া যায়। যেহেতু ভাসমান বাগানটি যথেষ্ট পুরু হওয়া দরকার, সেজন্য এমন কোনো জায়গায় তা তৈরি করতে হবে, যেখানে পানির গভীরতা কমপক্ষে ১ মিটার। ভাসমান বাগানটি এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, যেখানে সাধারণত নৌকা চলাচল করে না। ভাসমান বাগান তৈরি করার জন্য প্রয়োজন হবে একটি নৌকা, একটি লম্বা বাঁশ এবং কচুরিপানা টেনে নিয়ে আসার জন্য হুকসহ একটি বাঁশের লাঠি। বাঁশের পরিবর্তে অন্য যে কোনো শক্ত এবং হালকা কাঠও ব্যবহার করা যেতে পারে। এখন ভাসমান বাগানটি যেখানে তৈরি করা হবে, সেখানে নৌকাটি নিয়ে যেতে হবে। কচুরিপানার উপর লম্বা বাঁশটি রাখতে হবে। কচুরিপানার উপর পেতে-রাখা বাঁশের দুই দিক থেকে কচুরিপানা হুকসহ বাঁশের লাঠিটি দিয়ে টেনে আনতে হবে এবং পা দিয়ে তা চেপে-চেপে দিতে হবে, যাতে কচুরিপানার মাঝে কোনো ফাঁক বা ছিদ্র না থাকে। কচুরিপানার পাতাগুলো মাঝ বরাবর এবং শিকড়গুলো বাইরের দিকে রাখতে হবে। এর ফলে পাতাগুলো দ্রুত পচে যাবে এবং শিকড় বাইরের দিকে থাকায় পুরো জিনিসটি একসঙ্গে থাকবে। যতক্ষণ পর্যন্ত এটি এর উপর দাঁড়িয়ে-থাকা মানুষটির ভার বহন করার মতো শক্ত না হয় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়ানো মানুষটি পা না ভিজিয়ে এর উপর দিয়ে হাঁটতে পারছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এর উপরে কয়েক স্তরে-স্তরে কচুরিপানা দিতে হবে। তবে লক্ষ রাখতে হবে, যেন ভেলাটি কাত হয়ে না পড়ে। এখন ভেলার নিচ থেকে বাঁশটি সরিয়ে নিতে হবে, যেন এটি পরবর্তীতে পুনরায় ব্যবহার করা যায়। এবার কচুরিপানাকে জমাট বেঁধে কিছুটা শক্ত এবং সংকুচিত হতে দিতে হবে। ৭-১০ দিন পরে ভেলার উপরে আরো এক স্তর কচুরিপানা যোগ করতে হবে। ভাসমান বাগানটি এখন প্রায় তৈরি।
ভাসমান বেডের জন্য চারা উৎপাদন :
ভাসমান বাগান তৈরি করার সাথে-সাথে ঠিক একই সময় সবজির চারা উৎপাদন করার ব্যবস্থাও নিতে হবে। ভাসমান সবজি বাগানটির অবস্থান বাড়ি থেকে দূরে হতে পারে, তাই এমন একটি স্থানে চারা উৎপাদন করতে হবে, যেখানে চারার প্রয়োজনীয় দেখাশোনা করা যাবে। কম্পোস্ট বল তৈরির জন্য পূর্ববর্তী বছরের ভাসমান বাগান থেকে পচে-যাওয়া কচুরিপানা সংগ্রহ করতে হবে। এতে জমে-থাকা পানি শুকানোর জন্য ১-২ দিন উঠানে রেখে দিতে হবে, যাতে তা রোদের আলো পায়। কম্পোস্ট থেকে আগাছা এবং বড় উদ্ভিদ সরিয়ে নিতে হবে। একমুঠো কম্পোস্ট নিয়ে গোলাকার বল তৈরি করতে হবে এবং বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে এতে একটি গর্ত তৈরি করতে হবে। এই গর্তে কয়েকটি সবজি বীজ রাখতে হবে এবং আরো কিছু কম্পোস্ট দিয়ে তা ঢেকে দিতে হবে। এই বলগুলো সারিবদ্ধ করে রাখতে হবে এবং অতি বৃষ্টি ও সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা করার জন্য পলিথিনের বস্তা দিয়ে সেগুলো ঢেকে রাখতে হবে। ২-৩ দিন পরে বীজগুলো অঙ্কুরিত হবে; তখন পলিথিন সরিয়ে নেয়া যাবে। হাঁস-মুরগি থেকে চারা গাছগুলো নিরাপদে রাখার জন্য জায়গাটি বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে। একই সাথে চারা গাছগুলোকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য উপরে ছাউনি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। ১০ দিন পরে চারা গাছগুলো ভাসমান বাগানে স্থানান্তরের জন্য উপযুক্ত হবে।
ভাসমান বেডে চারা রোপণ ;
নৌকায় করে কম্পোস্ট বলসহ চারা গাছগুলো ভাসমান বাগানে নিয়ে যেতে হবে। ভাসমান বাগানে কচুরিপানার উপরের স্তর দা দিয়ে কুপিয়ে আলগা করে দিতে হবে এবং প্রতি ২৫ সে.মি. অন্তর একটি করে গর্ত করতে হবে। এই গর্তে কিছুটা কম্পোস্ট দিতে হবে এবং চারা গাছসহ কম্পোস্ট বলগুলো রোপণ করতে হবে। এর ফলে নতুন শেকড় জন্মানো সহজ হবে। ১৫ দিন পরে যখন চারাগুলো থেকে নতুন শাখা-প্রশাখা জন্মাবে, তখন সহজেই চারা গাছটি নুয়ে পড়বে। এ কারণে ভাসমান সবজি বাগানের পচনশীল কিনারাগুলো কেটে দিতে হবে এবং প্রতিটি চারার গোড়ায় এগুলো দিতে হবে, যাতে চারা গাছগুলো সোজা থাকে। এটি গাছের জন্য পুষ্টিও যোগান দেবে। এখানে যদি সব সময় সূর্যের আলো পড়ে এবং বাগানটি যদি শুকনো মনে হয়, তাহলে এতে পানি দিতে হবে। ভাসমান বাগানে সবজি এবং মশলাও জন্মানো যেতে পারে।
ভাসমান বেডের প্রতিবন্ধকতা এবং সফলতা :
সব ফসল চাষেই কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকে। ভাসমান সবজি বাগানের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ইঁদুর। প্রকৃতপক্ষে শ্রম এবং প্রতিবন্ধকতার তুলনায় ভাসমান সবজি বাগান থেকে প্রাপ্ত লাভ তুলনামূলকভাবে বেশি। কচুরিপানা ব্যবহারের জন্য ভাসমান সবজি বাগান একটি ভালো পদ্ধতি, কিন্তু এই কচুরিপানা ও পানি অনেক কিছুর জন্য ক্ষতিকর। জলাবদ্ধ জমিতে ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি, কম্পোস্টে পরিণত কচুরিপানা শীতকালে জমিতে জৈব সার হিসেবেও ভালো কাজ করে। বর্ষার শেষে ভাসমান বাগানগুলোকে সতর্কতার সাথে উঁচু জমির দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। বন্যার পানি নেমে গেলে এই ভাসমান বাগান ভেঙে টুকরো-টুকরো করে জমির উপরে জৈব সার হিসেবে ছড়িয়ে দেয়া হয়। পরবর্তী বছরে কম্পোস্ট বল তৈরির জন্য কিছু কম্পোস্ট সংগ্রহ করে রাখতে হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন কারনে যেখানে দীর্ঘ সময় জলাবদ্ধতা থাকে। সেই এলাকায় বাংলাদেশের কিছু কৃষক এই সমস্যার একটি সুকৌশলী জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল সমাধান ”ভাসমান সবজি বাগান” উদ্ভাবন করেছেন। ভাসমান সবজি বাগানে যেমন অনেক প্রয়োজনীয় সবজি চাষ করা যায়, ঠিক তেমনি একই সময়ে পরবর্তী ফসলের জন্য প্রচুর পরিমাণ জৈব সারও পাওয়া যায়। ফলে দ্বিগুণ লাভ প্রত্যেক কৃষকের মুখেই হাসি ফোটায় !