দেলোয়ার জাহিদ: বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার জনবহুল এলাকা গুলিস্তান ও লাগোয়া পুরনো ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চল- বঙ্গবাজার মার্কেট কমপ্লেক্স, ঘিঞ্জি এলাকা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল,সহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনা এবং দপ্তর নিয়ে বিপুল জনগোষ্ঠীর আবাস। গত মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) বঙ্গবাজার মার্কেটের ভয়াল অগ্নিকাণ্ডে মধ্যবিত্তের বাজার এখন একটি বিশাল ধ্বংসস্তুপ। অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গেছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার দোকান। আগুনের লেলিহান শিখায় সর্বস্ব হারিয়েছেন ৫ হাজারের মতো ব্যবসায়ী, আহত হয়েছেন ৩৬ জন, মঙ্গলবার ৪ এপ্রিল ভোরে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে বঙ্গবাজার মার্কেট কমপ্লেক্সের ৭টি মার্কেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ১২টা ৩৬ মিনিটে এ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। প্রায় ৬ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে এ আগুনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে। দীর্ঘ সময়ব্যাপী আগুন জ্বলতে থাকার কারণে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ভয়াবহ।
বাংলাদেশ অগ্নি নিরাপত্তাহীনতার ইতিহাস বেশ দীর্ঘ ২৪ নভেম্বর ২০১২ তাজরিন ফ্যাশনস লিডস-এ আগুন লেগে ১১২ জন শ্রমিকের মৃত্যু, ২৬ জানুয়ারী ২০১৩স্মার্ট এক্সপোর্ট গার্মেন্টসে আগুন লেগে সাতজন শ্রমিকের মৃত্যু, ৪ এপ্রিল ২০১৩ রানা প্লাজা ভবন ধসে ১,১৩৫ জনের প্রাণ হানি যাদের অধিকাংশই পোশাক তৈরি কারখানার শ্রমিক। ৪ অক্টোবর ২০১৩ আসওয়াদ কম্পোজিট মিলের একটি অগ্নিকাণ্ডের ফলে সাতজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এছাড়াও ঢাকার বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা একটি নিয়মিত বিষয় এবং বস্তির বাসিন্দারা এ জীবনযাত্রায় অনেকটা অভ্যস্ত। ঢাকার অসংখ্য ছোট ছোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পাশাপাশি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা কড়াইল বস্তিতে বেশ কয়েকটি বড় অগ্নি বিপর্যয় ঘটেছে।
বাংলাদেশের বঙ্গ বাজারের অগ্নিকাণ্ড দেশে উন্নত অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বিল্ডিং কোড ও প্রবিধানের কঠোর প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তাকে আবার ও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। দেশটির শহরগুলিতে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের বেদনাদায়ক ইতিহাস রয়েছে। সরকার অগ্নি নিরাপত্তা প্রবিধান শক্তিশালীকরণ এবং ভবনগুলো নিয়মিত পরিদর্শন বৃদ্ধি সহ ভবিষ্যতে অনুরূপ ঘটনা রোধে পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ যখন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে তখন ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে বঙ্গ বাজার বাজারটির অগ্নি নিরাপত্তা বিপর্যয়ের উৎস্যমূলে আঘাত করা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান হবে না। বঙ্গ বাজারের ঘটনাটি বাংলাদেশের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীয়তাকে আবারো তুলে ধরছে। অগ্নিনির্বাপকদের ঘটনাস্থলে প্রবেশে বিলম্ব ঘটার কারণ ছিল অগ্নিকাণ্ডের দিন, মার্কেটে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের ভিড়,ছাড়াও পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা না থাকার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়ে। দোকানে ব্যবহৃত কিছু দাহ্য পদার্থের জ্বালানীতে আগুন দ্রুত বাজারের সরু গলিতে ও একাধিক তলা দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
বঙ্গবাজারে আগুন: ৭০০ কোটি টাকা চায় দোকান মালিক সমিতি, এ শিরোনামে দৈনিক প্রথম আলো (এপ্রিল ৪, ২০২৩) জানাচ্ছে যে রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ৭০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ চেয়েছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি। সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন ও মহাসচিব মো. জহিরুল হক স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিনটি দাবি জানানো হয়।
দাবিগুলো হলো, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য ৭০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ, তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা যাতে নিজ নিজ দোকান ফিরে পান, সে ব্যবস্থা গ্রহণ। বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পাঁচ-ছয় হাজার দোকান পুড়ে সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। দোকান মালিক সমিতির নেতারা ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁদের জন্য সরকারের কাছে এ তিনটি দাবি জানিয়েছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেছেন, আগুনে প্রায় পাঁচ হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর টাকাপয়সার হিসাবে ব্যবসায়িক ক্ষতির অঙ্ক এখনো জানা যায়নি। ব্যবসায়ীদের মনে এখন আরেক শঙ্কা ভর করেছে, পুড়ে যাওয়া দোকানের জায়গায় তাঁরা নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে পারবেন কি না। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলেছেন, আগে বিভিন্ন মার্কেটে আগুন লাগার পর এমন দেখা গেছে প্রকৃত দোকানিরা আর দোকান ফেরত পাননি, অন্য কেউ তা দখল করে নিয়েছেন। এবারও অনেকের বেলায় এমন হতে পারে বলে আশঙ্কা তাঁদের। এ পরিপ্রেক্ষিতে দোকান মালিক সমিতি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা যাতে নিজ নিজ দোকান ফিরে পান, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে।
দেশের উন্নয়ণ অগ্রযাত্রার সাথে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়. বরং অপরিকল্পিত নগরায়ন অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে দিন দিন আরো জটিল করে তুলেছে। "দুর্বল প্রচেষ্টা অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাকে উন্নত করবে না" শিরোনামে ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজ এ একটি মতামত গত ২৭ ফেরুয়ারি, ২০২৩ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি গুলশানের একটি ১৪ তলা আবাসিক ভবনে আগুন লেগে অন্তত দুইজন নিহত হওয়ার পর বিষয়গুলো তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একটি তদন্তে দেখা গেছে যে বিল্ডিংটিতে পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না এবং বাসিন্দারা সঠিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। তদন্ত দল আরও দেখেছে যে ভবন মালিকরা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনাপত্তি সনদ নিয়েছিলেন কিন্তু অগ্নি নিরাপত্তা লাইসেন্স পাননি। পরিসংখ্যানে আরো দেখা যায়, ঢাকার অধিকাংশ ভবনের ক্ষেত্রে অবস্থা একই রকম। ২০১৯ সালে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী বলেছিলেন যে ঢাকার প্রায় ৬৬ শতাংশ বিল্ডিং বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করেছে এবং তাদের বেশিরভাগেরই সঠিক অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালে ঢাকায় ১,১৬২ টি ভবন পরিদর্শন করে এবং ১৩৬টি ভবনকে 'খুব ঝুঁকিপূর্ণ' এবং ৪৯৯টি 'ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে চিহ্নিত করে, প্রায় ৬০ শতাংশ ভবন অগ্নি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ বা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা কে উন্নত দেশের আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে।
কানাডায় ব্যক্তি ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা একটি অপরিহার্য দিক। অগ্নিকান্ড যে কোন সময় এবং যে কোন স্থানে ঘটতে পারে এবং সঠিকভাবে তা পরিচালনা না করলে বিধ্বংসী পরিণতি ঘটাতে পারে। আগুন প্রতিরোধ করতে এবং তাদের প্রভাব প্রশমিত করতে, কানাডা বিভিন্ন অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং প্রবিধান স্থাপন করেছে যা ভবন, সরঞ্জাম এবং উপকরণের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে। অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক গুলোর মধ্যে একটি হল প্রতিরোধ। অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলো লক্ষ্য হল সম্ভাব্য আগুনের ঝুঁকিগুলি চিহ্নিত করে এবং তাদের নির্মূল বা হ্রাস করে অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাবনাকে হ্রাস করা। এর মধ্যে ব্যক্তি এবং ব্যবসায়ীদের অগ্নি নিরাপত্তা অনুশীলন সম্পর্কে শিক্ষিত ও জড়িত করা , যেমন দাহ্য পদার্থের সঠিক স্টোরেজ, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং গরম ও রান্নার যন্ত্রপাতির নিরাপদ ব্যবহার।
কানাডিয়ান সরকার বিভিন্ন প্রবিধান এবং কোড প্রতিষ্ঠা করেছে যেগুলির জন্য ভবনগুলিকে অগ্নি নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে ডিজাইন এবং নির্মাণ করা প্রয়োজন হয়। উদাহরণ স্বরূপ, কানাডার ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (NBCC) অগ্নি নিরাপত্তার মানগুলি পূরণ করে তা নিশ্চিত করার জন্য ভবনগুলির নকশা ও নির্মাণ সংক্রান্ত নির্দেশিকা প্রদান করে। এনবিসিসি ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণ থেকে শুরু করে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র এবং স্প্রিংকলার সিস্টেম স্থাপন পর্যন্ত সবকিছুই কভার করে।
NBCC ছাড়াও, কানাডার বিভিন্ন প্রাদেশিক এবং আঞ্চলিক বিধি এবং কোড রয়েছে যা অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে। উদাহরণস্বরূপ, অন্টারিও ফায়ার কোড (OFC) অন্টারিওতে অবস্থিত ভবনগুলোতে অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জাম, পদ্ধতি এবং অনুশীলনের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করে। OFC জরুরী পরিকল্পনা, ফায়ার ডিপার্টমেন্ট অ্যাক্সেস, এবং দখলের প্রয়োজনীয়তাগুলি কভার করে।
কানাডায় অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার সাথে আগুন শনাক্ত করতে এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে উন্নত প্রযুক্তি এবং সরঞ্জামের ব্যবহার করা হয়। অগ্নি নির্গমন ব্যবস্থা যেমন স্মোক ডিটেক্টর, হিট ডিটেক্টর এবং ফায়ার অ্যালার্ম বিল্ডিংগুলিতে অগ্নিকাণ্ডের বাসিন্দাদের সতর্ক করার জন্য ইনস্টল করা হয়। উপরন্তু, অগ্নি দমন ব্যবস্থা যেমন স্প্রিংকলার সিস্টেম এবং অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রগুলি দ্রুত আগুন নিভিয়ে দিতে পারে, তাদের ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে ।
প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষাও কানাডায় অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ দিক। ব্যক্তি এবং ব্যবসায়িকদের অগ্নি সুরক্ষা প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নিতে উত্সাহিত করা হয় আগুন প্রতিরোধ, উচ্ছেদ পদ্ধতি এবং অগ্নি নিরাপত্তা সরঞ্জামের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জানতে সহায়তা করা হয়। অগ্নিনির্বাপক এবং অন্যান্য জরুরী প্রতিক্রিয়াকারীরা দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে আগুন নিভাতে সাড়া দেওয়ার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ পান।
উপসংহারে, কানাডায় ব্যক্তি ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা যেমন একটি অপরিহার্য দিক। যেমন দেশটি আগুন প্রতিরোধ করতে এবং তাদের প্রভাব প্রশমিত করাতে বিভিন্ন প্রবিধান, কোড এবং অনুশীলন প্রতিষ্ঠা করেছে। অগ্নি প্রতিরোধ, নকশা এবং নির্মাণ, প্রযুক্তি এবং সরঞ্জামের ব্যবহার এবং প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার সর্বোত্তম অনুশীলন গ্রহণ করে, কানাডা অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশের চাহিদা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের আলোকে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার, সভাপতি, বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক, কানাডা নিবাসী]