সমীরণ বিশ্বাস: জলবায়ু ও মাটির গুনে প্রাচীন কাল থেকেই বাংলাদেশ সবুজের সমারোহের জন্য সুপ্রসিদ্ধ। আর এ সমারোহ শুধুমাত্র গাছের জন্য সংখ্যাধিক্যে সীমাবদ্ধ ছিলনা প্রজাতীর বৈচিত্রেও সমৃদ্ধ ছিল। পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার্থে একটি দেশের আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ এলাকায় বনভূমি থাকা একান্ত প্রয়োজন রয়েছে বলে বিশেজ্ঞগণ মনে করেন। কিন্তু বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় বনাচ্ছাদিত এলাকার পরিমান মাত্র ৭.৭ ভাগ এবং ভুমি এলাকার তুলনায় ১৪ শতাংশ বনাঞ্চল।
গাছ শুধু প্রাকৃতিক শোভাই বাড়ায় না, মাটির ক্ষয় রোধ করে, বন্যা প্রতিরোধ করে, ঝড় তুফানকে বাধা দিয়ে জীবন ও সম্পদ রক্ষা করে। আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণেও গাছের ভূমিকা অপরিসীম। গাছ ছাড়া পৃথিবী মরুভূমিতে পরিণত হতো। গাছ অক্সিজেন সরবরাহ করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। মানুষের ক্ষুধার অন্ন সে জুগিয়েছে। লজ্জা নিবারণের জন্য দিয়েছে বল্কল, বৃক্ষের পত্রে রচিত হয়েছে লিপি, মানুষের অসুখে জুগিয়েছে প্রশান্তি। গাছের অক্সিজেন আবহাওয়াকে করেছে নির্মল, মানুষের পরিত্যক্ত ক্ষতিকারক কার্বন ডাইঅক্সাইডকে সে নিজ শরীরে ধারণ করেছে। প্রাচীন ভারতের বেদ এ বৃক্ষের অপরিসীম গুরুত্বকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করা হয়েছে। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে পরিবেশের ভারসাম্য যাতে নষ্ট না হয় সে বিষয় সম্পর্কে ভাবিত হয়েছে। অত্যাধুনিককালে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে চিন্তার বিষয়রূপে বিশেষ স্বীকৃতিলাভ করেছে বৃক্ষরোপনের প্রয়োজনীয়তা।
আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরেই আজ শ্যামল সবুজ উন্মুক্ত প্রান্তরের অত্যন্ত অভাব। কিন্তু বিদেশে এমনটি হয় না। সেখানে নগর পরিকল্পনার সময়ে উদ্যান ও প্রান্তরের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখা হয়। সুতরাং মানুষকে বাঁচতে হলে তার আদিম জীবনের প্রতিবেশী গাছ-তরুলতাকেও বাঁচাতে হবে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে তাই বিজ্ঞানীরা রব তুলেছেন, পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে হলে গাছ-তরুরাজির শ্যামল ছায়ায় প্রত্যাবর্তন করতে হবে তাই বৃক্ষরোপনের প্রয়োজনীতা আছে।
ঐতিহ্যের শহর ঢাকা। চারশত বছরের পুরাতন ঢাকাকে বলা হয়ে থাকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বানিজ্যের নগরী। ১৩৪ বর্গ মাইলের এ শহরে বাস করে ১ কোটি ৪১ লক্ষ মানুষ। বর্তমানে জনসংখ্যা আরো অনেক বেশি। ধারণা করা হয় প্রায় ২ কোটির কাঁছাকাছি। প্রতি বর্গ মাইলে ১ লক্ষ ১৫ হাজার মানুষের বসবাস বলা চলে এটি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ নগরী। বিশ্ব ব্যাংক বলছে ২০৩৫ সাল নাগাদ জনসংখ্যা ৩ কোটি ৫০ লক্ষ হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাল, নদী, ডোবা, বৃক্ষ নিধন করে ঘর-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাস্তা, স্কুল কলেজ সহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে ফলে পরিবেশের উপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। কমে যাচ্ছে সবুজের পরিমাণ। জাপানের কিয়োটো ও হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন গবেষক ঢাকা শহরের সবুজ নিয়ে গবেষণা করেন, তাদের মতে ১৯৯৫ সালে ঢাকার সবুজ অঞ্চল ছিল ১২ %, ২০১৫ সালে ৮% এবং বর্তমানে ৬-৭% এর বেশি না। ঢাকাতে যত পরিমাণে গাছ কাঁটা হয় তার অল্প পরিমাণই রোপণ করা হয়। ৮০ দশকের পর থেকে বৃক্ষ নিধন শুরু হয়েছে ফলে ঢাকার চেহারাও বদলাতে শুরু হয়। গাছ কার্বনডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে যা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। এ ছাড়াও বৃষ্টিপাত ঘটাতেও সহায়ক ভূমিকা রাখে। কিন্তু বৃক্ষ নিধনের ফলে ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঢাকার শহরেই নাকি বায়ুমণ্ডলে প্রায় ১০০০ মেট্রিক টন দূষিত কণা ভেসে বেড়াচ্ছে। যার মধ্যে প্রতিদিন ঢাকা শহরের গাছগুলোতে ৪৩৬ মেট্রিক টন ধুলা জমে। এ থেকে শহরতলির শিল্পাঞ্চলের অবস্থা কল্পনা করা যায়। নগরজীবনে উখিত কার্বন ডাইঅক্সাইড, দাবদাহ মানুষকে জটিল রোগের শিকার করে তুলছে। বৃক্ষ অনায়াসে এই বিষকে কণ্ঠে ধারণ করতে পারে, কিন্তু আমরা পারি না। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রচুর অক্সিজেন প্রয়োজন, যেটা বৃক্ষই দিতে পারে। বায়ুর দূষণের পরিবেশের ভারসাম্য রচনার অরণ্যের অপ্রদায়িত্ব বহন করে বৃক্ষ। সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড, তুলতায় র ক্লোরাইড ইত্যাদি দূষণে সক্ষম না হলে নগরজীবন দুরারোগ্য ব্যধিতে বিস্তার ঘটবে। অথবা পৃথিবীতে দেখা দেবে বিপুল প্রাকৃতিক বিপর্যয়। পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাবে ৪-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কুমেরুর বরফ গলতে শুরু করবে। বৃক্ষহীনতায় বৃষ্টি কমবে, অতিরিক্ত সূর্যতাপে মাটি হয়ে উঠবে রুক্ষ। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে এখনই বৃক্ষরোপনের প্রয়োজনীতা । মানুষকে তাই পরিবেশ সচেতন হতে হচ্ছে। একমাত্র গাছই আমাদের পরিবেশ পরিসেবা করতে পারে। কলুষিত বিষাক্ত বাতাস নীলকণ্ঠের মত গ্রহণ করে অরণ্যানী নির্মল বাতাসে রূপান্তরিত করতে পারে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, রোধ করতে গাছের যথাযথ ভূমিকা আছে। বৃক্ষরোপনে বন বাঁচবে, বন্যপ্রাণী বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে। লোকালয় সুন্দর হবে, পৃথিবী হবে দূষণ মুক্ত । মনে রাখতে হবে পরিবেশ ও গাছ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে।
গ্রীষ্মে ঢাকায় গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও যা বর্তমানে বেড়ে ৩৮-৪০ সেলসিয়াসেরও বেশি থাকে। অপরিকল্পিত ভাবে বৃক্ষ নিধনের জন্য খরা ও বন্যার প্রকোপ দেখা দেয় । ফলে বৃক্ষের প্রয়োজনীতা সহজেই অনুমেয়। বৃক্ষ ঢাকাকে ছায়া শীতল রাখতে সহায়তা করবে। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরীতেও গাছ পালার অবদান রয়েছে। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। বর্তমানে দেশে ১৬ কোটি ৫৭ লক্ষ মানুষ রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী ঢাকা জনবহুর শহরের তালিকায় ১১ তম স্থানে আছে। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর গ্লোবাল সিটিস ইনস্টিটিউশনের পরিচালিত একটি সমীক্ষা দেখিয়েছে ২০৫০ সাল নাগাদ ঢাকা হবে বিশ্বর তৃতীয় জনবহুল শহর। বাংলাদেশের মোট জন গোষ্ঠীর ২১.৪% শহরে বাস করে যার সিংহভাগই ঢাকাতে। ঢাকার মানুষ সাধারণত চাকুরী, ব্যবসা, দিন মজুর, পরিবহন শ্রমিক, গার্মেন্টস সহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ফলে কৃষি পণ্য উৎপাদনে তাদের প্রত্যক্ষ অবদান নেই বললেই চলে। অন্যদিকে ৭৮.৬% মানুষ গ্রামে বাস করে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষি কাজের সাথে জড়িত। এদিকে ১% হারে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে ।
আমাদের ইচ্ছা শক্তি ও সঠিক পরিকল্পনা থাকলে ঢাকা হবে সবুজের শহর। প্রতি বছর গাছ লাগানো কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে এবং অকারণে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে হবে। রাস্তার পাশে, খোলা মাঠে, খাল-বিল, নদী, লেকপার, উদ্যান, চত্বর, রাস্তার পাশে রাস্তার, ডিভাইডার, বাসা বাড়ির আঙ্গিনায়, বাড়ীর আশে পাশে পর্যাপ্ত বৃক্ষ রোপন করতে হবে। দিন দিন শহরের আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে ২৫% বনায়ণ নিশ্চিত করেই আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। নগর কৃষি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে আগ্রহ তৈরী করতে হবে। যা এই শহরের চেহারায় বদলে দিবে। বসবাস যোগ্য ও স্বাস্থ্য সম্মত শহরের তালিকায় স্থান করে নিবে ঢাকা শহর।
লেখক: লিড-এগ্রিকালচারিস্ট, ঢাকা।