এস এম মুকুল : কথায় আছে, বৃক্ষ তোমার নাম কি- ফলে পরিচয়। প্রতিফলনই নামের প্রধান পরিচায়ক হয়ে উঠে, যখন সংগঠনের নাম হয় 'ফলদ বাংলাদেশ'। যেমন সুন্দর নাম, তেমনি সুন্দর তার শ্লোগান- 'পুষ্টি অর্থ সবুজ পথ- ফলের গাছেই ভবিষ্যত'। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবক দ্বারা পরিচালিত 'ফলদ বাংলাদেশ'-এর স্বপ্ন ফলের গাছ রোপণের মাধ্যমে দেশের পুষ্টির চাহিদা পূরণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা।
অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, দাবদাহ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন বৃক্ষরোপণ। কিন্তু অপরিকল্পিত বনায়ন ও বৃক্ষরোপণ নিজেই একটি সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এই ভূখন্ডে। বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করছে তরুণদের এই সংগঠন 'ফলদ বাংলাদেশ'।
আজ ১২ জুন ২০২৩ দশ বছর পূর্ণ হলো ফলদ বাংলাদেশের। দশ বছরে একটু একটু করে অনেকটা এগিয়েছে সংগঠনটি। অর্জনও কম নয়। তারুণ্যের এই প্রেরণাই হয়তোবা সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে যুগ থেকে যুগান্তরে।
খবর নিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সালের ১২ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় ফলদ বাংলাদেশ-এর। ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশের ৪৮টি জেলার একাধিক উপজেলা ও গ্রামে প্রায় ২,৭৫,০০০ (দুই লাখ পচাত্তুর হাজার) ফলের বৃক্ষ রোপণ করেছে সংগঠনটি। রোপণ ও পরিচর্যায় বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে রোপণকৃত বৃক্ষের ৯৫ ভাগই টিকে আছে। সংগঠনটি জানায়, প্রথম দিকের রোপিত বৃক্ষ থেকে ফল পাওয়া শুরু হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৬৪ জেলায় ৫ কোটি ফলদ বৃক্ষ রোপণের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে ফলদ বাংলাদেশ।
এক দশকের এই অভিযাত্রায় সারাদেশে যুক্ত হওয়া সকল কর্মী ও বন্ধুদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিবাদন জানিয়েছে সংগঠকগণ। কর্মীদের উদ্দেশ্যে তারা বলেন, আপনাদের হাত ধরেই ফলদ বৃক্ষরোপণের ঢেউটা উত্তাল হয়ে উঠবে। সমগ্র বাংলাদেশ একদিন ফলদ ও দেশীয় গাছের প্রাণবৈচিত্র্যে ভরে উঠবে।
আজ বাড়ীতে বাড়ীতে ফল গাছ লাগাই কর্মসুচীর মাধ্যমে ফলদ ফাউন্ডেশন এর দশম বর্ষপুর্তিতে ৫৬ জেলার গাছ রোপন নিয়ে চেইঞ্জ ইনিশিয়েটিভ এর আয়োজনে আইডিয়া শেয়ারিং সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা র নির্বাহী সদস্য এবং নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন এর চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানা।
সভায় সারা দেশের গাছ রোপনের কৌশল, প্রয়োজনীয়তা এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তন মেকাবেলায় করণীয় ও বাংলাদেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পুরণে ফলদ গাছের ভুমিকা সম্পর্কে কথা বলেন কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক দ্রাবির সৈকত।
চেইঞ্জ ইনিশিয়েটিভ এর লাকী আক্তার, মিজানুর রহমান অন্যান্যের মধ্যে উপিস্থিত ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার বিভাগের এএইচ রাজন, রাতুল মুন্সী এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনী এনকর স্কুলের শিক্ষক দিপংকর বৈরাগী।
সারাদেশে বাড়িতে বাড়িতে ফলদ গাছলাগানোর কর্মসুচীকে প্রচার করা এবং গাছ লাগানোর মাধ্যমে দেশের ফলের চাহিদা পুরণ, অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হওয়ার বিষয়টি সভার আলোচনায় গুরুত্ব দেয়া হয়।
ফলদ বাংলাদেশ-এর ফেসবুক ওয়াল তারা উল্লেখ করেছে, '১০ বছর আগে আমরা যখন ভাবছিলাম দেশের বৃক্ষপ্রজাতির এই অবস্থা কেন! যেখানেই যাই অধিকাংশ গাছ বহিরাগত কাষ্ঠল প্রকৃতির। সেসবে মানুষ ও পশুপাখির উপযোগী খাবার নাই। তারওপরে কেবল কাঠমুখী বৃক্ষের এই সামাজিক বনায়নের নামে মেহগনি ইউক্যালিপ্টাস একাশিয়ার যে নিসর্গ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে, সেই নিসর্গ আমাদের বৃক্ষবৈচিত্র্যকে খুব শিঘ্রই ওলটপালট করে দেবে। আর এসব গাছ কেবল কাঠ দেয়, আমাদের মাটি দখল করে রেখে আমাদেরই পুষ্টি ও সম্ভাব্য অধিক অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখে।
তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম দেশের মাটিকে সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে হলে এই বৃক্ষরোপণ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা দরকার। দরকার ফলদ ও দেশীয় গাছের বৃক্ষরোপণের প্রচারণা। কিন্তু হাতে গোণা কয়েকজন মিলে সারাদেশের এই বৃক্ষরোপণ অভ্যাস কীভাবে বদল করা সম্ভব!!
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম হোক কঠিন, শুরুটা তো করতে হবে। তাছাড়া দেশের উন্নয়নে বহু কাজের মধ্যে এ কাজটা বরং তুলনামূলকভাবে সহজ বলা যায়। কিন্তু শুরুটা কীভাবে হবে? গাছইবা লাগাবো কোথায়? আর কয়েকজন মিলে কত গাছইবা লাগাবো? যেখানে আগ্রাসী বৃক্ষের পরিমান ভয়াবহরকম বেশি।
একদিন নেত্রকোনা থেকে কাজটা শুরু হয়েই গেল। আমরা শুরু থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম গাছ লাগাবো মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কিংবা যেখানে চারাগুলো নিশ্চিতভাবে টিকে যেতে পারে। সেভাবেই একের পর এক জেলায় গ্রামে গ্রামে চলতে থাকলো ফলদ বাংলাদেশের ফলদ বৃক্ষরোপন অভিযান। নিজেদের সামর্থে এবং বন্ধু-স্বজনদের আতিথেয়তায় গ্রামগুলোতে চারা হাতে যাচ্ছি আমরা। বাড়ি বাড়ি রোপণ করছি এবং বাসিন্দাদের সচেতনে কথা বলছি, তাদের হাতে দিচ্ছি সচেতনতামূলক লিফলেট। একে একে এই আন্দোলনে যুক্ত হতে থাকলো নানা জায়গার উদ্যমী তরুণ-তরুণীরা। ক্রমবর্ধমান কর্মীবাহিনী আর বর্ধিষ্ণু তাগিদের ফলে ফলদ বাংলাদেশ নানাভাবে এগিয়ে যেতে থাকলো।
আমরা প্রাথমিক লক্ষ্য নির্ধারণ করলাম ৬৪ জেলায় পদার্পন করবো। প্রতি বর্ষায় তাই একের পর এক জেলায় ফলদবৃক্ষরোপণ অভিযান নিয়ে পৌঁছে যেতে থাকলো একেকটি দল। একেক জেলায় একেক রকম মাটি, একেক রকম অভিজ্ঞতা। দৈবচক্রে কিংবা বন্ধুদের সূত্রে গ্রাম নির্বাচন ও চারা সংগ্রহ করে অভিযাত্রী দল রোদে, বৃষ্টিতে সমান তালে ফলের চারা রোপণ করে যাচ্ছে। দশ বছর পেরিয়ে এ মৌসুমে আমরা ছুঁতে যাচ্ছি ৬৩টি জেলায় পদার্পণের লক্ষ্যমাত্রা। আগামী মৌসুমে পদার্পণ কর্মসূচীর শেষ জেলা সম্ভাব্য বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে সমাপ্ত হবে। এই শুভ প্রত্যাশা আমাদের।
সংগঠনটির কর্মীদের মতে, গ্রামে ফলের চারা রোপণের ফাঁকে ফাঁকে স্থানীয় মানুষদের সাথে আমাদের আলাপ হয়। দেশে অত্যধিক মেহগনি একাশিয়া ইউক্যালিপ্টাস রোপণের কুফল নিয়ে মতবিনিময় হয়। দেখা যায় ফল গাছের প্রতি সবারই প্রচুর আগ্রহ থাকার পরেও আমাদের অধিকাংশ বৃক্ষ এখনও এসব বহিরাগত আগ্রাসী কাঠনির্ভর গাছ। এই অবস্থার আশু পরিবর্তন দরকার। দরকার সারাদেশে অধিক হারে দেশী ও ফলের চারা রোপণ।
তাদের মতে- ফলের চারা নিয়ে আমরা দেশের যে গ্রামেই যাই, সব গ্রামেই দেখা যায় মেহগনি রেইনট্রি একাশিয়া ইউক্যালিপ্টাসই সেখানে অধিকাংশ গাছ। গ্রামগুলিতে তাই প্রচুর গাছ থাকলেও, পাখি নাই, জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ নষ্ট হয়ে গেছে। তাদের প্রত্যাশা, জনসংখ্যার আধিক্যের পরেও দেশীয় বৃক্ষপ্রজাতির সংরক্ষণ ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে গ্রামগুলোতে এখনও স্থানীয় জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করা সম্ভব।