আবুল বাশার মিরাজ, বাকৃবি: ঢাকা থেকে মাত্র ১২০ কিলোমিটার দূরের একটি বিভাগীয় শহর ময়মনসিংহ। ময়মনসিংহ শহর থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে রয়েছে দেশের কৃষি শিক্ষার সেরা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এ ক্যাম্পাসেই রয়েছে বোটানিক গার্ডেনস কনজারভেশন ইন্টারন্যাশনাল (বিজিসিআই) স্বীকৃত দেশের সেরা প্রথম বোটানিক্যাল গার্ডেন। বাগানটির আয়তন প্রায় ২৫ একর। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মের বছর দুয়েক পরে, ১৯৬৩ সালে এ গার্ডেনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
বোটানিক্যাল গার্ডেন মানেই গাছের সমারোহ। আর এ সমারহকেই দারুণভাবে বিভিন্ন জোনে ভাগ করা হয়েছে এই বোটিনিক্যাল গার্ডেনে। এক একটি জোনে একই ধরণের গাছের সমারোহ। বোটানিক্যাল গার্ডেন কর্তৃপক্ষও চেষ্টা করেছে বিশ্বের সব ধরনের গাছের প্রজাতি সংগ্রহ করে রাখার। আর এগুলো দেখে গাছের প্রেমে পড়ে যাবেন যে কেউ।
বাগানটির অবস্থান ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেষা উপাচার্যের বাসভবনের পাশে। বাগানের পূর্ব পাশের প্রাচীরটি নদ ঘেঁষা। এ কারণে এখানে এসে ব্রহ্মপুত্র নদের সৌন্দর্য দেখতে পারবেন যে কেউ। এছাড়াও গাছপালার সমারোহ ঘুরে দেখার সময় মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে মেলবন্ধনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় পশু-পাখির প্রতিকৃতি আছে বাগানটিতে। মূল গেটের কাছে বাঘ, সিংহ, দ্বীপ জোনে দুুটি রাজহাঁস ও দুটি সারস, আর্কেডিয়া গাছের নিচে আছে হরিণ। বাগানে বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রামের জন্য রয়েছে বেঞ্চ।
জানা গেছে, বাগানটিতে ৬৫০ এর অধিক প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। হাজারখানেক বিশাল বৃক্ষ, এক হাজার ৩০০টি মাঝারি ও চার হাজার ৫০টি ছোট আকারের গাছ আছে। ফলে বিশাল এই বাগানকে ৩০টি জোনে ভাগ করে দেখাশোনা করা হয়ে থাকে। জোনগুলোর নামও দেওয়া হয়েছে। যেমন- ঔষধি, ফুল, ফল, ক্যাকটাস, অর্কিড, পাম, মসলা, টিম্বার, বাঁশ, বেত, বিরল, বনজ উদ্ভিদ ইত্যাদি। জলজ উদ্ভিদের জন্য ওয়াটার গার্ডেন, মরুভূমি ও পাথুরে এলাকায় জন্মে এমন উদ্ভিদের জন্য রক গার্ডেন আছে। দেশের নানা এলাকা থেকে জোগাড় করা বিলুপ্ত ও বিরল ক্যাকটাস আছে নিসর্গ ভবনে। একেবারে দক্ষিণে আছে অর্কিড হাউস। সুন্দরবন জোনে আছে সুন্দরবনে জন্মে এমন গাছগুলো।
এখানে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়া, পশুর, বাইন, হোগলা ও ফার্ন জাতীয় গাছ আছে। নিসর্গ ভবনে আছে বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় ক্যাকটাসের সারি। ‘পট হাউস’ নামের বিশেষ সংরক্ষণাগারে আছে অশ্বগন্ধা, সর্পগন্ধা, গন্ধভাদুলি, পূর্ণনভা, কুর্চি, বচ, উলটচণ্ডাল, অন্তর্মূল, অঞ্জন ইত্যাদি জাতের ঔষধি উদ্ভিদ। আছে সুগন্ধি জাতের উদ্ভিদ। বাগানে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছের মধ্যে আছে স্টার আপেল, আমেরিকান পেয়ারা, থাই পেয়ারা ইত্যাদি। ফুলের মধ্যে আছে কমব্রিটাম, রনডেলসিয়া, পালাম, ক্যামেলিয়া, আফ্রিকান টিউলিপ, রাইবেলি ইত্যাদি। বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের মধ্যে আছে রাজ অশোক, নাগলিঙ্গম, কালাবাউশ, ক্যারিলিফ, ফলসা, মনগোটা, মাক্কি, বনভুবি, লোহাকাট, উদাল, পানবিলাস, টেকোমা, বহেরা, হরীতকী, কাঁটাসিংড়া, ম্যালারিউকা, প্যাপিরাস, রুপিলিয়া, স্ট্যাভিয়া, হিং, পেল্টো ফোরাম ইত্যাদি। আরো আছে পদ্ম শাপলার ঝিল, কৃত্রিম দ্বীপ, নারিকেল কর্নার, বিলুপ্ত বাঁশঝাড় ইত্যাদি।
বাগানটিতে রয়েছে চা ও কফি বাগান। সেখানে বিটি ১, বিটি ২, বিটি ৩, বিটি ৭, টিভি ১, টিভি ৫-সহ বিভিন্ন চায়ের জাতের সংরক্ষণ এখানে রয়েছে। এসব উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য যেমন পরিবেশ প্রয়োজন ঠিক তেমন করেই এখানে গড়ে তোলা হয়েছে, যা বাংলাদেশে প্রথম ও একমাত্র।
বাগান ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে যায় বাগানের কিউরেটর অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর হোসেনের সাথে। তিনি জানালেন, এই বাগানে মানুষ কেবল ঘুরেই বেড়ান না, অনেকে এখানে গবেষণাও করতে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম, স্নাতক পর্যায়ে বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষার্থীদের উদ্ভিদ জগৎ সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন এবং মাস্টার্স ও পিএইচডি শিক্ষার্থীদের গবেষণা কার্যক্রমে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়ে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে পরিচিত করানো হয় বাগানের সঙ্গে। ব্যবহারিক ক্লাসে উদ্ভিদ চেনার জন্য এখানে আসতে হয় শিক্ষার্থীদের। পরীক্ষার সময় উদ্ভিদ তথা উদ্ভিদের পাতা, ফুল, ফল, বীজ শনাক্তকরণের ওপর নম্বর থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্যে প্রবেশ ফ্রি হলেও দর্শনার্থীদের জন্যে জনপ্রতি টিকিটমূল্য ১০ টাকা। বাগানটি সপ্তাহের রবি থেকে বৃহস্পতিবার পাঁচ দিন দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা এবং শুক্র ও শনিবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে।