কৃষিবিদ ড. মোঃ তাসদিকুর রহমান সনেট: গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু পরবর্তীতে জাতির জনক। এই দীর্ঘ পথ অতিক্রান্ত করতে তাঁকে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে। অতিক্রান্ত করতে হয়েছে দীর্ঘ পথ। এই দীর্ঘ পথে জন্ম দিয়েছিলেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ছিষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান এবং ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে জন্ম দিয়েছিলেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের।
সকল অর্থে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের আরেক নাম। তিনিই বাংলাদেশ। তিনি দুর্ভাগা এই দেশে জন্মেছেন বলেই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। যতই দুঃখ থাক, বঞ্চনা থাক তবুও আমরা মুক্তিযুদ্ধের ফসল একটি অনন্য স্বাধীন দেশের মাথা উঁচু করা নাগরিক। ফিলিস্তিনি দুঃখী মানুষগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে বুঝতে পারি আমরা কতটা ভাগ্যবান। অনেকটা ভিয়েতনামবাসীদের মতো সৌভাগ্যবান আমরা। আর এই সৌভাগ্যের স্বর্ণদুয়ারের চাবিটি ছিল বঙ্গবন্ধুর হাতে । একদিনেই আসেনি ঐ চাবি তাঁর হাতে। শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা এক দীর্ঘপথ। সেখান থেকে জাতির জনক হওয়ার পথের দুরত্বও কম নয়। এই সুদীর্ঘ পথ তিনি হেঁটেছেন দারুণ এক প্রত্যয় ও সাহস নিয়ে। নিজে যেমন সাহসী ছিলেন, পুরো জাতিকেও তিনি সাহসী করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। একজন বীরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর সাহস। আর বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ বীরের ছিল সীমাহীন সাহস। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি তাঁর সর্বোচ্চ সাহস দেখিয়েছেন। তাঁর এই সাহসের ভিত্তি ছিল জনগণের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা। আর তাঁর জন্য জনগণের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। এই ভালোবাসার উৎস ছিল তাঁর নিরঙ্কুশ দেশপ্রেম। তাঁর প্রতি জনগণের অগাধ বিশ্বাস। একটি জাতি গড়ে তোলার পেছনে এই বিশ্বাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক সময়ের পূর্ব বাংলা, আজকের বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের দুঃখমোচনের জন্য তিনি কতোই না জেলজুলুম সহ্য করেছেন। নিজের সংসার, সন্তানদের কথা না ভেবে এ দেশের দুঃখী মানুষের কথা অন্তর দিয়ে ভেবেছেন। পাকিস্তানের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে যে অবিচার, অন্যায্যতা ও বৈষম্য বিরাজ করছিল তার অবসানের জন্য তিনি ছাত্রজীবন থেকেই সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে তাঁর বিশাল এক দেশপ্রেমিকের ভাবমুর্তি। ক্ষুদিরাম, সুভাষ বসুর মতোই তাঁকেও জনগণ এক ত্যাগী বীর হিসেবে শ্রদ্ধা করতেন। এবং বিশ্বাস করতেন [সূত্র: বাংলাদেশের আরেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব- আতিউর রহমান]।
তিনি জন্মেছিলেন বলেই আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। সমগ্রজাতিকে একত্রিত করে সাহসিকতার সাথে তিনি সংগ্রাম করেছেন আমৃত্যু। সরকার প্রধানের দায়িত্ব পেয়ে তিনি পেয়েছিলেন যুদ্ধবিদ্ধস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির বাংলাদেশ। মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন দেশ পুনর্গঠনের জন্য। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠন, স্বল্পতম সময়ে মাত্র নয় মাসের মধ্যেই সংবিধান প্রণয়ন, সাধারণ নির্বাচন, কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ, ওআইসি'র সদস্যপদ লাভ, চীন ও সৌদি আরব ছাড়া বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন প্রভৃতি কর্মকাণ্ড বঙ্গবন্ধু সম্পন্ন করেছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বৎসরে। বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে সেই স্বপ্নকে হত্যা করা হয়েছিল। যদি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা না হতো তাহলে আমাদের মাথাপিছু আয় মালয়েশিয়ার তুলনায় বেশি হত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যো দিয়ে দেশকে কয়েক যুগ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সৃষ্টি হয়েছিল অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন যা রাজনীতিকেও দুবৃত্তায়িত করেছিল। উন্নয়নের নামে অনুন্নয়নের দুষ্টচক্রে বাধা পড়েছিল দেশ । বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে দেশদ্রোহী রাজাকারদের পুনর্বাসন করা হয়েছিলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর আত্মীয় আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ ফজলুল হক মণিকে সপরিবারে তাঁদের বাসস্থান এবং পরবর্তীতে ৩রা নভেম্বর জেল প্রকোষ্ঠে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের প্রহসন শেষে মীরজাফরের নির্দেশে মোহাম্মদ আলী বেগ কর্তৃক বন্দী নবাব সিরাজউদ্দৌলার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বাংলার ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতা এবং নৃশংসতার এমন নজির নাই।
বাংলাদেশের জন্মলগ্নে আমরা ভাবতে পারিনি যে, আমাদের লালচিহ্ন ধারণকারী জাতীয় দিবসগুলোর পাশাপাশি থাকবে কালোচিহ্নের একটি শোক দিবস। এটাও তো ভাবতে পারিনি যে, শোক দিবসটি হবে জাতির জনকের হত্যাকে ঘিরে। আমরা আনন্দের বর্তমান চাই, সুখের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনায় উদ্বেলিত হই। জাতি হিসেবে আমাদের সর্বোত্তম অর্জন স্বাধীনতা প্রাপ্তির লগ্নে আমাদের মানসিকতা এমনিই ছিল। কিন্তু আমরা না চাইলেও স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মাথায় আমরা শোকাভিভূত হয়েছিলাম আমাদের শোক ছিল জাতির জনকের কলঙ্কজনক হত্যার। যে জাতির নির্মাণ প্রয়াসে জনকের জীবন ও কর্ম নিবেদিত ছিল, সে জাতিরই বিপথগামী কিছু মানুষ তাঁকে হত্যা করল, ৭৫-এর ১৫ আগস্ট। শত্রু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাঁর প্রাণ হরণ করতে সাহসী হয়নি, অথচ বাঙালি তাঁর প্রাণ হরণ করেছিল। স্বজনের হাতে প্রাণ যাওয়ার ব্যাপারটি তো নজিরবিহীন নয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রাণ গিয়েছিল মোহাম্মদী বেগের হাতে। ৪৪ খ্রিস্টপূর্বে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে জুলিয়াস সিজারকে বলতে হয়েছিল: ‘ক্রন্টাস তুমিও! অর্থাৎ ব্রুন্টাস যে তার হন্তারক হবে তা সিজার ভাবতে পারেনি। কাজেই জুলিয়াস সিজারের উচ্চারণটি ছিল বিপন্ন বিস্ময়ের। যেমন- বিপন্ন বিস্ময় ছিল সিরাজউদ্দৌলা ও বঙ্গবন্ধুরও। তবে জুলিয়াস সিজারের মতো তাঁদেরও বিপন্ন বিস্ময়ের কোন উক্তি ছিল কিনা তার কোনো প্রমাণ ইতিহাস ধারণ করেনি। কিন্তু তাদেরও যে বিপন্ন বিস্ময় ছিল তা সন্দেহাতীত। আর বিপন্ন হয়েছে জাতি হিসেবে বাঙালির ভাবমূর্তিও। জাতিটি চিহ্নিত হয়ে থাকল জনকের হস্তারক হিসেবে। একাত্তরের অর্জন বাঙালিকে মর্যাদার শীর্ষে তুলেছিল আর পঁচাত্তরে জাতির জনককে হত্যা করে সে বাঙালি নিজেকেই কালিমালিপ্ত করেছিল (সূত্র: ইতিহাসের কালিমালিপ্ত দিন- সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
দেশি বিদেশি শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। দেশে বাকশাল কায়েম হলে তাঁর সরকারকে উৎখাত করা যাবেনা। তাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ১৫ আগস্ট বেছে নেয়। খন্দকার মোস্তাক আহমদ ও মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সমর্থনে সেনাবাহিনীর বিপথগামী একটি অংশ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাতে মেজর ফারুক এবং মেজর রশীদ প্রথম বেঙ্গল ল্যান্সার এবং দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ঢাকা সেনানিবাস থেকে বহর নিয়ে যায়। রাতের কুচকাওয়াজের নামে বেঙ্গল ল্যান্সার এবং ফিল্ড আর্টিলারির ৬শত সৈন্যকে একত্রিত করে। মেজর ফারুক অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি সৈন্যদের তিন ভাগে বিভক্ত করেন। এক ভাগে ৭৫ থেকে ১৫০ সৈন্য ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল তিনটি বাসা। ৩২ নম্বরের ধানমন্ডি-বঙ্গবন্ধুর বাসভবন, রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি বঙ্গভবনে না থেকে ধানমন্ডিতে নিজের বাসায় থাকতেন। দ্বিতীয় শেখ মনির বাসভবন এবং ৩নং মিন্টো রোডে আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসভবন। মেজর নুর চৌধুরী, মেজর বজলুল হুদা ও মেজর মহিউদ্দিন একদল ল্যান্সার সৈন্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সকাল ৫-১৫ মিনিটে পৌঁছে। সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুর বাসভবন লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু ও বাসার সবার ঘুম ভেঙ্গে যায় । তারা ভেবেছিল দুষ্কৃতিকারীরা বাসা আক্রমণ করেছে। ৫টি ট্রাকে ১২০ জন সৈন্য বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। পাহারারত পুলিশরা কালো পোশাকধারী সৈন্য দেখে আত্মসমর্পণ করে। তারা দেহরক্ষীকে হত্যা করে। সৈন্যদের দেখে শেখ কামাল নিচে নেমে আসেন। তিনি ভেবেছিলেন সৈন্যরা তাদের সাহায্যে এসেছে। শেখ কামালকে দেখে মেজর বজলুল হুদা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। বঙ্গবন্ধু তার জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের লাশ দেখতে পান। তিনি জেনারেল সফিউল্লাহকে ফোন করে তাঁর বাসভবন আক্রমণের কথা তাকে জানান। তিনি তাঁর মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলউদ্দিনকে জানান।
বঙ্গবন্ধু দোতলায় ছিলেন। তিনি সিড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর পরনে ছিল ধূসর রঙের চেক লুঙ্গি, গায়ে ছিল পাঞ্জাবি এবং হাতে ছিল পাইপ। মেজর মহিউদ্দিন তাঁকে হত্যার জন্য এগিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু তাকে জিজ্ঞেস করেন, “তোমরা কী চাও। তোমরা কি আমাকে হত্যা করতে এসেছ? তা ভুলে যাও। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তা করতে পারেনি। তোমরা কে যে তা পারবে?” মেজর মহিউদ্দিন মুখোমুখি হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময় পাষণ্ড মেজর নুর চৌধুরী তার স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলিবর্ষণ করে। গুলি তাঁর ডান পাশে গর্ত করে বেরিয়ে যায়। গুলিতে তাঁর শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তাঁর দেহ কাত হয়ে সিঁড়িতে পড়ে যায়। মুখ ছিল নিচে। তখনও তাঁর ডান হাতে পাইপ। সময় তখন ভোর ৫টা ৪০ মিনিট। বাঙালি জাতির মহান নেতার করুণ মৃত্যু হলো। বঙ্গবন্ধুকে যখন গুলি করে তখন বেগম মুজিব তাকে অনুসরণ করে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মেজর বজলুল হুদা, মেজর মহিউদ্দিন, মেজর আজিজ পাশা ওপরে ওঠে। বেগম মুজিবকে তাঁর শয়নকক্ষে দরজায় দেখে মেজর বজলুল হুদা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। তারপর গণহত্যা চলে। লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বড় কক্ষে নিয়ে আসে। অফিসার ও সৈন্যরা স্টেনগান দিয়ে গুলি করে বন্ধ দরজা ভেঙে ফেলে। অতি নিকট থেকে মেজররা গুলি করে শেখ জামালকে হত্যা করে। শেখ কামালের নববিবাহিত বধূ সুলতানা ও শেখ জামালের বধূ রোজীকে গুলি করে হত্যা করে। ১০ বছরের শিশু শেখ রাসেল ফার্নিচারের মধ্যে পালিয়ে ছিল। তাঁকেও ধরে ফেলে। রাসেল খুনিদের অনুরোধ করে, “আমাকে মেরো না। আমাকে মায়ের নিকট যেতে দাও।” শেখ রাসেলের কান্নায় খুনিদের হৃদয় গলেনি। তারা রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শেখ নাসের পাশের বাথরুমে পালিয়ে ছিলেন। তাঁকেও তারা হত্যা করে। রক্তের স্রোত সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বে ভয়াবহ নারকীয় হত্যা।
বিশ্ব অবাক হয়ে জানতে পারে স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠাতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। খুনিদের একটি দল বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসা আক্রমণ করে। খুনিরা আবদুর রব সেরনিয়াবাত পরিবারের সদস্যদের বাইরে লাইন করে দাঁড় করায়। মেজর রাশেদ চৌধুরী প্রথম আবদুর রব সেরনিয়াবাত ক গুলি করে। তাঁর কোলে ছিল ৫ বছরের নাতি সুকান্ত বাবু। আবদুর রব সেরনিয়াবাত কোলে নাতিসহ হয়ে মারা যান। খুনিরা আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ১১ বছরের শিশুপুত্র আরিফ, ১০ বছরের কন্যা আতুষ্পুত্র শহীদ সেরনিয়াবাত ও আত্মীয় রিন্টুকে হত্যা করে। খুনিরা সেরনিয়াবাতের দুই কন্যা, স্ত্রী আমেনা বে এবং পুত্রবধু শাহানা আবদুল্লাহ, পুত্র খোকাকে গুলি করে গুরুতর আহত করে। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ ছাদে পালিয়েছিলেন। খুনিরা বাসা ত্যাগ করলে তিনি আহতদের হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা পালিয়ে যান। মুনিরা চেয়েছিল হাসনাতকে হত্যা করতে।
একই সময়ে খুনিরা রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির বাসা আক্রমন করে শেখ মণি ও তার স্ত্রী গর্ভবর্তী আরজু মণিকে হত্যা করে। তারা দুই শিশু রেখে যান। শেখ সেলিম শেখ মণি ও আরজুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। শেখ মনি তখনও জীবিত ছিলেন। তিনি হাসপাতালে মারা যান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের হত্যাকা নৌ ও বিমানবাহিনী অংশ নেয়নি। মেজর শরিফুল হক ডালিম তাড়াতাড়ি বেতার কেন্দ্রে চলে যান এবং ঘোষ সেনা স্বৈরাচার শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। জাতি এ সংবাদ শুনে হতবাক। অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
খুনিরা খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করে। মোশতাক ১৫ আগস্ট ১১টা ১৫ মিনিটে রেডিওতে ভাষণদান করে। তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার মন্ত্রীদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। একমাত্র ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজদীন আহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামারুজ্জামান খুনিদের মন্ত্রিসভায় যোগদানে অস্বীকৃতি জানান। আর তাঁদের গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়।
ঢাকা সেনানিবাসের নবম ডিভিশনের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল সাফায়াত জামিল বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদ শুনে মেজর জেনারেল সফিউল্লার সাথে কথা বলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসভবনে যান। তিনি জিয়াকে জিজ্ঞেস করেন, প্রেসিডেন্টকে হত্যা করা হয়েছে। আপনার নির্দেশ কি? জিয়া উত্তর দিলেন, যদি প্রেসিডেন্ট না থাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট আছেন। জিয়া এ সময় দাড়ি কামাচ্ছিলেন। তিনি শান্ত। তাকে শোকাভিভূত দেখা যায়নি। সেনাবাহিনীর তিন প্রধানকে রেডিও অফিসে আনা হয়। তারা মোশতাকের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। জেনারেল সফিউল্লার স্থলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হয়েছেন। তাদের সমর্থনে খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে। ১৫ আগস্ট সারাদিন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের লাশ ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসায় অযত্নে পরে ছিল। ১৫ আগস্ট গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু ব্যতীত সবার লাশ বনানী কবরস্থানে গণকবর দেয়া হয়। তাদের গোসল ও জানাজা পড়ানো হয়নি। বনানী গোরস্তানে বঙ্গবন্ধুর তিন পুত্র, দুই পূত্রবধূ, স্ত্রী, কনিষ্ঠ ভ্রাতা, ভাগিনা শেখ মণি, তার স্ত্রী, ভগ্নিপতি মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তার পরিবারের সদস্য সর্বমোট ১৮ জনকে মাটিচাপা দেয়া হয় [সূত্র: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সিরাজ উদ্দীন আহমেদ]। ১) বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদ পরিষদ
জাতির পিতাকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে হত্যা করা হয়েছে আমাদেরকে কলঙ্কিত করা হয়েছে। পিতার ঋ আমরা কোনদিন শোধ করতে পারবোনা। পৃথিবীতে অনেক দেশেই জাতির পিতা রয়েছেন- সবাই তাদের আদদ ধারণ করে দেশ গঠনে অংশগ্রহণ করে। আমরা এমন একটা জাতি এখনও অনেকেই জাতির পিতার অবদান স্বীকার করতে চান না। তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুছে ফেলার জন্য। জাতির পিতার আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদেরকে লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে দেশ গঠনে অংশগ্রহণ করতে হবে। তবে তাঁর আত্মা শান্তি লাভ করবে। পাশাপাশি ভেদাভেদ ভুলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ত্যাগী সূর্যসৈনিকদের নির্বাচিত করে। যোগ্যতা অনুযায়ী দেশ পরিচালনার সুযোগদানের মাধ্যমে সোনার বাংলা গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, কেআইবি ঢাকা মেট্রোপলিটন ও সাংগঠনিক সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদ পরিষদ, ঢাকা মহানগর।