কুষ্টিয়া জেলার ফিলিপনগর চরাঞ্চলে এক নক্ষত্রের আগমন হয়েছিলেন। আঁধার চরাঞ্চল এখনও সেই নক্ষত্রের আলোয় আলোকিত হয়। গনিতের পন্ডিত জনাব আফতাব উদ্দিন মিঞা জীবনের স্ফুলিংগ দিয়ে প্রদ্বীপ জ্বেলে দিয়েছিলেন হাজারো চৈরী অন্তরে। বিএসসি পরীক্ষায় ডিসটিংশন পেয়েছিলেন জনাব আফতাব উদ্দিন মিঞা। ১৯৪৬ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন জন স্কলার ডিসটিংশন পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যাঞ্চেলর স্বাক্ষরিত সনদপত্রটি সেই আমলে অনেক মুল্যবান।
আফতাব স্যার তাঁর লেটারহেড প্যাডে বা ভিজিটিং কার্ডে নামের সাথে কৃতিত্ব কথাটি লিখতেন বন্ধনীর মধ্যে [মোঃ আফতাব উদ্দীন মিঞা, বিএসসি (কৃতিত্ব)]। আমরা তাঁর ছাত্ররা এই ডিসটিংশনের গুরুত্ব তেমন একটা বুঝতাম না। আমাদের কাছে মনে হতো অনেকটা ফার্ষ্ট ডিভিশন, স্টার অথবা হালজামানার গোল্ডেন এ প্লাসের মত। যে যুগে তৃতীয় শ্রেণীতে পাস করলেই ধন্য ধন্য পড়ে যেতো সেই যুগে জনাব আফতাব উদ্দীন মিঞা পদার্থ, রসায়ন ও গণিতে ৮০% এর অধিক নম্বর পেয়ে ডিসটিংশন পেয়েছিলেন। জনাব আফতাব উদ্দীন স্যারের কাছ থেকে শুনেছিলাম তাঁর সাথে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আব্দুল হক নামের আরেকজন বাঙ্গালী ছাত্র ডিসটিংকশন পেয়েছিলেন। জনাব আব্দুল হক পরবর্তিতে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়ে দেশে বিদেশে বর্ণময় ক্যারিয়ার গড়েছিলেন।
ব্রিটিশ আমলে তিনি সিভিল সাপ্লাইজ ডিপার্টমেন্টে চাকুরীর আবেদন করলেও ডাক বিভ্রাটে আবেদনপত্র পৌছায়নি যথাসময়ে। তিনি কার্ড না পেয়ে হতাস হয়ে যোগাযোগ করতে গেলে তাঁর ডিসটিংশন সার্টিফিকেট দেখে পরীক্ষার অনুমতি দেন কর্তৃপক্ষ এবং প্রথম স্থান অধিকার করে চাকুরী পেয়ে যান। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরে অনেক ডিপার্টমেন্টই আত্মীকরণের সম্মুখিন হয়। তিনি স্বল্প সময়ের জন্য ১৯৫৩ সালে চলে আসেন তার নিজ গ্রাম ফিলিপনগরে। তখন ফিলিপনগর হাইস্কুলের যাত্রা শুরু হয়েছে কেবল। অত্র অঞ্চলে তখন একটাই স্কুল। এলাকার সুধী ব্যক্তিবর্গ স্কলার আফতাব উদ্দীন মিঞাকে বিনীত অনুরোধ করলেন ফিলিপনগর হাইস্কুলের ছাত্রদের গণিত ও বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য; অন্তত যতদিন গ্রামে আছেন। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। ছাত্ররাও উজ্জীবিত হয়ে গেলো এমন নক্ষত্রের সান্নিধ্য পেয়ে। কিছুদিন পর পশ্চিম পাকিস্তানে নতুন ডিপার্টমেন্টে পোস্টিং এর খবর এলো। তিনি জানিয়ে দিলেন স্কুল কর্তৃপক্ষকে। স্কুল কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রদের মিনতিপুর্ণ আবেদন ‘ স্যার, আপনি যদি থেকে যেতেন এই স্কুলে কতই না ভাল হতো’। বর্ণময় পদস্থ সরকারী চাকুরীর মায়া ছেড়ে গ্রামের স্কুলে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া নিঃসন্দেহে কঠিন। কিন্তু সৃষ্টার পরিকল্পনাতো ভিন্ন। ইতোমধ্যে তিনি ভালবেসে ফেলেছেন শিক্ষকতার মত মহান পেশা। তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফিলিপনগর হাইস্কুলে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন ।
নিয়তির দুর্বিপাকে আর সৃষ্টার ইচ্ছায় জনাব আফতাব উদ্দীন মিঞার ডিসটিংশন পাওয়া সার্টিফিকেট জমা হলো সদ্য প্রতিষ্ঠিত ফিলিপনগর হাইস্কুলের গর্বিত ফাইলে। শুরু হলো তাঁর নতুন স্বপ্নযাত্রা। বর্নিল ও স্বচ্ছল জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করে তিনি নামমাত্র বেতনের শিক্ষকতার চাকুরী নিলেন। তিনি একজন পদার্থ বিজ্ঞানী, একজন গণিতবিদ অথবা সিএসপি অফিসার হতে পারতেন। কিন্তু চৈরী জনপদে শিক্ষার আলো জ্বালানোর ব্রতকেই বেছে নিলেন মহান আফতাব স্যার। ফিলিপনগরের চৈরী জমিনে স্বপ্নের বীজ বুনে দিলেন চরাঞ্চলের রাখাল রাজা আফতাব উদ্দিন মিঞা। সেই স্বপ্নের ফসলে আজ চৈরী জননীর আঁচল টইটুম্বুর, চৈরী বালুচর আজ সোনার ফসলে ভরা, ফুলে-ফলে শোভিত। গনিতের পন্ডিত আফতার স্যার তাঁর ছাত্রদের গনিতের কৌশল কতটুকু শিখাতে পেরেছেন কতটুকু জানিনা তবে তিনি জীবনভর চৈরী ছাত্রের আন্তরে জ্বেলে দিয়েছেন সম্ভাবনার আলো, জীবন বোধ, সাহস আর স্বপ্নের প্রদ্বীপ। নিরবে ঢেলে দিয়েছেন দেশপ্রেমের মন্ত্র, গেঁথে দিয়েছেন বিপ্লব-বিদ্রোহের বারুদ। তাইতো চরের জমিনে আজ স্বর্ণবৃক্ষ, সোনালী ফসল। মহান জাতীয় সংসদ থেকে সচিবালয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণাগার, সিভিল সার্ভিস থেকে জাতীয় নিরাপত্তা- সব জায়গায় মাথা উচু করে দাড়িয়ে ফিলিপনগর চরের সাহসী সন্তান। মহান মুক্তিযুদ্ধে আফতাব স্যারের ছাত্ররা কেউ ঢেলে দিয়েছে বুকের রক্ত, কেউবা জীবন। চরাঞ্চলে স্বপ্ন ও সমৃদ্ধির এক মহান রুপকার আফতাব উদ্দিন স্যার।
তিনি প্রধান শিক্ষক হওয়ার পর ১৯৫৭ সালে ফিলিপনগর হাইস্কুলের প্রথম ব্যাচ এসএসসি পরীক্ষা দেয়। ফলাফল বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলায় প্রথম স্থান। ফিলিপনগর হাইস্কুল স্কাউট দল বৃহত্তর বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার প্রথম স্কাউট ট্রুপ এবং প্রথম স্কাউট পতাকাধারী। ৭০ বছরের পুরানো ফিলিপনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয় এখনও জেলার শ্রেষ্ট বিদ্যালয়। এখনও সবচেয়ে বেশী এ প্লাস এ স্কুল থেকে পায়, এখনও প্রায় প্রতিবছরই আন্ত:স্কুল ফুটবল, ভলিবল, হ্যান্ডবল, এ্যাথলেটিক্স এ উপজেলা চ্যাম্পিয়ন, জেলা চ্যাম্পিয়ন, বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হয় জনাব আফতাব উদ্দিন মিঞার হাতে গড়া ফিলিপনগর হাইস্কুল। এই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা এ পর্যন্ত ৩৩ জন এমবিবিএস ডাক্তার, ৬৫ জন প্রকৌশলী, ৩০ জন কৃষিবিদ, ১৫ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, আইনজীবি, আমলা, গবেষক সহ অগনিত পেশাজীবি হয়েছে। কুষ্টিয়া-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্যও এই স্কুলের ছাত্র। আফতাব স্যার নেই ৩০ বছর তবুও তাঁর ছাত্রদের অলিন্দে এখনও শিল্প-সাহিত্যের পদ্ম ফোটে, জ্বলে ওঠে জ্ঞানের আলো-গল্প-কবিতা, মুকুলিত হয় সংস্কৃতির কুড়ি। চৈরী বালকের পলল অন্তরে শৃঙ্খলাবোধ, দেশপ্রেম, চেতনা আর মানবতার বীজ বুনে দিয়েছিলেন আমাদের সর্বশ্রদ্ধেয় আফতাব স্যার। তিনি শিখিয়ে গেলেন জগৎসংসারের উচ্ছাভিলাস আর লোভ ছুড়ে ফেলে কিভাবে জীবনকে সুন্দর ও নান্দনিক করতে হয় জীবনের সৌরভে। মানব জীবনতো এমনই সুন্দর ও মহান। আফতাব স্যার তাঁর এক জীবনে প্রগতিশীলতার সাথে ধর্মীয় চেতনা আর সততার সুন্দর সমন্বয় করে কী এক আলোকিত জীবনের পথ দেখিয়ে গেলেন জীবনভর।
দারিদ্রকে তুচ্ছ করে আলোর মশাল হাতে আফতাব স্যার ফিলিপনগর হাইস্কুলে ছিলেন ৩৪ বছর। ১৯৮৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় আফতাব স্যার ছাত্রদের সমব্যথা, বন্ধুদের সহানুভুতি, সুধীজনদের সান্তনা, উপহার হিসাবে কয়েকটি ছাতা, লাঠি, কোরআন শরীফ ও কিছু উপন্যাস নিয়ে রিক্ত হস্তে (তখন অবসরকালীন কোন সুযোগ সুবিধা শিক্ষকরা পেতেন না) অবসর গ্রহণ করলেন তাঁর অস্তিত্বের নির্যাসে গড়া ফিলিপনগর হাইস্কুল থেকে। অবসরের পর তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলির কষ্ট, ক্ষুধা, দারিদ্র, চরম হতাসা, উৎকন্ঠা আর সীমাহীন অনিশ্চয়তা তাঁকে পরাজিত সেনাপতির মত, হালভাঙ্গা মাঝির মত উদভ্রান্ত করে দিলো। গণিতের পন্ডিত আফতাব উদ্দীন মিঞা তাঁর নিজের জীবনের হিসাব মিলাতে ব্যর্থ হলেন। নিষ্ঠুর নিয়তি তাঁর ব্যক্তিত্ব, চেতনা, স্বপ্নকে বিচুর্ণ করে দিলো। আফতাব স্যারের মত সিংহ পূরুষ হতাসার অন্ধকারে ডুবে গেলেন। কেউ জানলোনা তাঁর কষ্টের কথা। জীবনযাপনের জন্য নূন্যতম অর্থের অভাব একজন মানুষকে কতটা অবহেলিত, তুচ্ছ ও গুরুত্বহীন করে তোলে তা তিলে তিলে উপলব্ধি করে গেলেন স্কলার আফতাব উদ্দীন মিঞা। এই মহান শিক্ষকের কাছে ছাত্রদের লৌকিক গুরুভক্তির চেয়ে কন্যাদায়গ্রস্ততা, প্রতিদিনের চাল-তেল-নুনের যোগান, চিকিৎসার জন্য আর্থিক অনটন আর জীর্ণ বস্ত্রের বাস্তবতাই সবচেয়ে সত্য মনে হতে লাগলো। একসময় দিন ফুরালো - সন্ধা হলো; উদ্ভ্রান্ত বাতিওয়ালা বসলেন ঘাটের কিনারে-পারের আশায়। বাতিওয়ালার জন্য জ্বললো না কোন সন্ধ্যা প্রদ্বীপ। । ১৯৯৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জুমার নামাজের সময় চলে তিনি গেলেন অনন্ত যাত্রায়। রেখে গেলেন তাঁর জীবনের অর্বাচীন গনিত, অস্তিত্বের নির্জাসে গড়া ফিলিপনগর হাইস্কুল, প্রিয় ছাত্র-ছাত্রী, অনিশ্চিত পরিবার, বন্ধূ বান্ধব আর আত্মত্যাগের এক মহান দৃষ্টান্ত।
বেসরকারী হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত একজন প্রধান শিক্ষকের মৃত্যুতে দৈনিক পত্রিকায় কোন শোকবাণী বা ক্রোড়পত্র প্রচারিত হয়নি, বড় কোন শোকসভাও হয়নি কিন্তু জাতি হারিয়েছে এক মহান শিক্ষক, জ্ঞানের মশাল বাহী এক মহান বাতিওয়ালা। আফতাব স্যারের কাছে কুষ্টিয়া অঞ্চলের মানুষের ঋণ জন্ম জন্মান্তরের। তিনি ছিলেন স্রষ্টার পাঠানো এক মহান নেয়ামত। আফতাব স্যার সেদিন সরকারি পদস্থ চাকুরীতে চলে গেলে তিনি হয়তো আরও বড় পরিসরে কাজ করতেন, আলো ঝলমলে স্বচ্ছল জীবন হতো, বড় শহরে রাজপ্রাসাদ হতো, ছেলেমেয়েদের উন্নত ভবিষ্যত নিশ্চিত হতো। কিন্তু তিনি ফিলিপনগর চরে থেকে যাওয়ায় তৈরী হয়েছে হাজার তারার মেলা, বদলে গেছে একটি বড় জনপদ, আলোকিত হয়েছে হাজারো অন্তর। এখনও চৈরী জনপদের স্বপ্নবান মানুষ আফতাব স্যারের দীপ্ত চোখে জীবনের স্বপ্ন দেখে, সুন্দর আগামি দেখে, আঁকে দীপ্ত বাংলাদেশের সম্ভাবনার ছবি। তাঁর জীবনালেখ্য, আত্মত্যাগ, আর স্বপ্ন-সাহসের গৌরবগাথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জন্য অমূল্য সম্পদ; মর্যাদা সংকটে পড়া বর্তমান প্রজন্মের দ্বিধান্বিত শিক্ষক সমাজের কাছে এক রোল মডেল ও প্রেরণা।
লেখক প্রজাতন্ত্রের একজন সিভিল সার্ভেন্ট