সমীরণ বিশ্বাস: জাত এর নামঃ. লক্ষ্মী দীঘা · আঞ্চলিক নামঃ. লক্ষ্মী দীঘা · অবমূক্তকারী: স্থানীয়ভাবে প্রচলিত জাত · জীবনকালঃ. ১১০ দিন । লক্ষী দিঘা চাল,আধুনিক ধানের শরীর থেকে হারিয়ে গেছে কৃষকের কবিতার খাতা। এইসব ধানের আর নাম নেই। আছে সংখ্যা। ব্রি ২৮, ২৯, ৪২ বা ৭৬ বা ৯৬। কয়েদীদের যেমন নাম থাকে না। থাকে সংখ্যা। আধুনিক কৃষি এক কয়েদখানা। এই নাই হওয়া চাল খুঁজে বের করেছি আমরা আপনাদের জন্যে। লাল চালের উপকারিতা অপরিসীম । বিভিন্ন ধরনের রোগ সারে লাল চাল খেলে,কারণ ফাইবার অধিক মাত্রায় থাকে।
লক্ষ্মীদিঘা ধান চাষ সময় ও পদ্ধতি:
বোরো ধান কাটার পর বৈশাখ মাসের দিকে একটা চাষ দিয়ে এই ধানের বীজ ছিটিয়ে দিতে হয়। মই দেওয়ারও দরকার পড়ে না। আর জমি নরম থাকলে চাষেরও দরকার হয় না। শুধু ছিটিয়ে দিলেই হয়। এমনকি কোনো সার–কীটনাশকও লাগে না। আপনা–আপনি বেড়ে ওঠে। বিলে ছয় ফুটের মতো পানি হয়। ধানগাছ তার চেয়েও বড় হয়। কার্তিক মাসের দিকে কাটা হয় ধান। ফলন বিঘা প্রতি ১২-১৫ মন। ছরের আট মাস একরের পর একর জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। তলিয়ে থাকে এক মানুষ সমান পানির নিচে। যুগ যুগ ধরে লোকে তা–ই দেখে এসেছে। দু–তিন বছর ধরে চেনা সেই দৃশ্য খানিকটা পাল্টেছে। পানির ওপর এখন সবুজ ধানের শিষ দোল খায়। দোলে কৃষকের স্বপ্নও।
বরিশাল, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, নওগাঁ ও গাইবান্ধার কৃষকরা স্বপ্ন দেখাচ্ছে প্রায় হারিয়ে যাওয়া দেশি জাতের ধান—লক্ষ্মীদিঘা। পানিতে ডোবে না; বরং পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে। গোপালগঞ্জ থেকে এই জাতের ধানের বীজ দেশের বিভিন্ন বিলের জমিতে বপনের ভাবনাটা ছড়িয়ে পরেছে। নিজের জমিতে কৃষকরা নেমে ধানের গোছা টেনে তুললেন। দেখা গেল ধানের গাছ তাঁর মাথা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বোঝা গেল বিলে এক মানুষসমান পানি হলেও ধান ডুববে না। বিলে লক্ষ্মীদিঘা ধান দেখিয়ে এখন কৃষানীরাও বললেন, ‘এই বিলে এক জ্যৈষ্ঠে আবাদ হয়। আবার পরের জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত ডুইবি থাকে। মাইষসের কী কষ্ট! এই লক্ষী দিঘা ধান হলে বিলের মানুষরা বাঁচপি।’ তাই এখন এই চালের ভাতের চাহিদা বহু গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি কেজি লক্ষ্মীদিঘা চাল তিনি অনলাইনে ৭৫ টাকায় বিক্রি করেছেন কৃষকরা।
লক্ষ্মীদিঘা ধানের সন্ধান:
হাসান জামান পড়াশোনা করেছেন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। কিন্তু ধ্যানজ্ঞান তাঁর কৃষি। ছোটবেলা থেকেই কৃষির প্রতি আগ্রহ ছিল। চাকরি বাকরির দিকে মন দেননি। শুরুতে ঠিকাদারি করেছেন। তারপর কৃষিতেই জড়িয়ে পড়েন। কাজ করতে গিয়েই তাঁর মাথায় বিলের পতিত জমিতে আবাদের চিন্তা আসে। এরপর তিনি পানিতে হয়, এমন ধানবীজ খুঁজতে থাকেন। নীলফামারীর এক চাষির কাছ থেকে পেয়েও যান সেই ধানের সন্ধান। পরে কাঙ্ক্ষিত ধানটি পান গোপালগঞ্জের আরেক কৃষক আরিফুজ্জামানের কাছে।
এরপর তাঁর কাছ থেকে ১২০ কেজি লক্ষ্মীদিঘা ধান নিয়ে আসেন হাসান জামান। ধানটি যে লক্ষ্মীদিঘাই, তা নিশ্চিত করেন লুপ্ত ধানবীজের সংগ্রাহক ও রাষ্ট্রপতি পদকপ্রাপ্ত রাজশাহীর তানোরের ইউসুফ মোল্লা। হাসান জামান এবার চাষিদের বোঝালেন তাঁদের জমি বছরের আট মাস পড়েই থাকে। তিনি তাতে নতুন ধান চাষের পরীক্ষা করবেন। সফল হলে তাঁদের বীজ দেবেন। তাঁরা নিজেরাও তখন চাষ করতে পারবেন। কৃষকেরা রাজি হলেন। আমরা কৃতজ্ঞ হাসান জামান ভাইয়ের প্রতি। আপনার এই মাঠ ট্রায়েল এবং সফল সম্প্রসারন জাতি মনে রাখবেন। ২০১৪ সালে কৃষি বিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু লক্ষ্মীদিঘা চালের ভাত পছন্দ করতেন বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর নতুন করে শুরু হয় গবেষণা। নিচু জমির পরিবর্তে আবাদ করা হয় উচু জমিতে। এতে প্রায় দ্বিগুণ ফলনের আশা করছেন চাষিরা।
লাল চাল/ লক্ষ্মীদিঘা চালের উপকারিতা:
লাল চালের উপকারিতা অপরিসীম । বিভিন্ন ধরনের রোগ সারে লাল চাল খেলে,কারণ ফাইবার অধিক মাত্রায় থাকে। লক্ষ্মীদিঘা ধানের পুষ্টিগুণ বেশি বলে জানালেন পুষ্টি বিজ্ঞানিরা। তারা বলেন, ‘এই ধানের চাল লাল হয়। জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা হয় বলে বাজারে এর দামও বেশি। প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে। ফাইবার বেশি থাকলে অন্ত্রে খাবার হজমের প্রক্রিয়া আস্তে আস্তে হয়, ফলে শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট জাতীয় সুগারে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া কমে যায়, ফলে রক্তের সুগারের মাত্রা কমে, গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ার কারণে। এ চালের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ার কারণে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগীদের খাওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়। রক্তনালীতে ব্লক হওয়ার ঝুঁকি কমায়, হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি কমায়, রক্তের চর্বির মাত্রা ও সুগারের মাত্রা কমায়। প্রতিদিন ১ কাপ লাল চালের ভাত খেলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ৬০ ভাগ পর্যন্ত কমে। লাল চালের ভাতে ক্ষুধা কম লাগে। লাল চালের ভাত খেলে আমাদের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ফাইবারের ১০ ভাগ পূরণ হয়। লাল চাল ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে ও স্থূলতা প্রতিরোধ করে।
লক্ষ্মীদিঘা চালের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান:
ফাইবার ছাড়াও লাল চালে প্রচুর পরিমাণে জিংক, আয়রন, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ভিটামিন বি১, বি২ ও বি৬, ম্যাংগানিজ, সেলেনিয়াম, আমিষ ও পটাশিয়াম থাকে। আয়রন লোহিত রক্ত কণিকার হিমোগ্লোবিন তৈরিতে লাগে যা রক্তে অক্সিজেন পরিবহন করে। জিংক ও ম্যাংগানিজ রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে ও ক্ষত শুকাতে সাহায্য করে। ম্যাংগানিজ শরীরে বিপাক প্রক্রিয়াও অংশগ্রহণ করে। ক্যালশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম শরীরের হাড় সুস্থ ও সবল করে। ভিটামিন বি৬ ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে, সেরোটোনিন ও নরইপিনেফরিন হরমোন তৈরিতে সহায়তা করে যা আমাদের মুড নিয়ন্ত্রণ করে। পটাশিয়াম আমাদের শরীরের রাসায়নিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে ও রক্তচাপ কমায়, হৃদযন্ত্র ভালো রাখে। ভিটামিন বি২ খাবার ভেঙে শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে। সেলেনিয়াম ক্ষতিকর ফ্রি রেডিকেল থেকে শরীর রক্ষা করে ও ডিএনএ তৈরিতে সাহায্য করে। এনথোসায়ানিন লাল চাল ছাড়াও কালো চালে ও সব ধরনের লাল ও নীল রঙের খাবারে যেমন ব্লুবেরি, রাস্পবেরিতে পাওয়া যায়।
লাল চালের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স মাত্র ৫৫ আর সাদা চালের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৭০। তাই লাল চাল ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে ও নিয়ন্ত্রণে রাখে, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে। ত্বকের সৌন্দর্য বাড়ায় । লাল চালের এনথোসায়ানিন ত্বকের ভাঁজ কমায়, বয়স ধরে রাখে। এন্টি অক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে সূর্যালোকের ক্ষতিকর আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে ত্বক রক্ষা করে। এটা ত্বকের ক্যান্সার থেকে রক্ষা করে ও অন্যান্য ত্বকের রোগ যেমন সোরিয়াসিস প্রতিরোধ করে। গর্ভবতী ও স্তনদায়ী মায়ের জন্য লাল চাল স্বাস্থ্যকর। অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট কমায় ও প্রতিরোধ করে। হাড় ভালো রাখে।
লাল চালে কি ক্ষতিকর কোন দিক আছে। কিছু কিছু গবেষণাতে এটা প্রমাণিত যে, লাল চালে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ফাইটিক এসিড আছে যা অন্ত্রে লোহা বা আয়রন ও ক্যালশিয়াম শোষণে বাধা দেয়, ফলে লাল চালের ভাতের সঙ্গে যদি এমন খাবার খাওয়া হয় যেগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালশিয়াম ও আয়রন থাকে তবে এ সমস্যা হতে পারে, তাই লাল চালের ভাত খাওয়ার সময় অধিক আয়রন ও ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার না খাওয়াই ভালো।
লেখক: লিড-এগ্রিকালচারিস্ট, ঢাকা।