কৃষিবিদ ড. এম আব্দুল মোমিন: আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকই জমিতে বা মাটিতে বিভিন্ন ফসল আবাদ করে কিন্তু মাটির স্বাস্থ্য সম্পর্কে খুব বেশি সচেতন নয়। কৃষকদের মাটির স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ ৫ ডিসেম্বর দেশে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২৩’। এ বছরের বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের প্রতিপাদ্য “Soil and Water: a source of life” যার বাংলা ভাবার্থ-মাটি ও পানি:জীবনের উৎস। মাটি এবং পানির গুরুত্ব সর্বমহলে অনুধাবনের জন্য এবারের প্রতিপাদ্যটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস উপলক্ষে মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সুষম সার ব্যবহারের গুরুত্ব তুলে ধরাই আমার এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
সাম্প্রতিক জনশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৯৮ লক্ষ। এই বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার খাদ্য যোগান দিতে চলছে নিরবচ্ছিন্ন কৃষিচর্চা। ফলে অপরিমিত সারের ব্যবহারসহ নানা কারণে মাটি হারাচ্ছে উর্বরতা। মাটির ভৌত গঠনে অবনতি, মাটির জৈব উপাদান এবং উর্বরাশক্তি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। মাটিতে অন্ততপক্ষে ২ শতাংশ জৈবপদার্থের উপস্থিত থাকলে সেটা মোটামুটি মানের মাটি বলে ধরা হয়। তবে ন্যূনতম ৫ শতাংশ হলে সেটাকে আদর্শ মাটি বলা হয়ে থাকে। যেখানে আদর্শ মাটিতে শতকরা ৫ভাগ জৈব পদার্থ থাকার কথা সেখানে আমাদের জমিতে এ হার কমবেশি ১.৫ ভাগেরও কম।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট এর তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট ১ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে জৈবপদার্থের ঘাটতি রয়েছে। ফলে জমি ও ফসলের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য জৈব ও অজৈব বা রাসায়নিক সারের ব্যবহার প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি ফসল সুরক্ষায় ব্যবহৃত কীটনাশক, বালাইনাশক এবং আগাছানাশকের যথেচ্ছা ব্যবহারের কারণেও মাটি হারাচ্ছে তার স্বকীয়তা।
মাটি পরীক্ষার সুযোগের অপর্যাপ্ততা, সহজলভ্য ও দ্রুত সময়ে রিপোর্ট প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা এবং মাটি পরীক্ষা করে ফসলে সার ব্যবহারের সুফলের ব্যাপারে কৃষকরা অসচেতন হওয়ার কারণে আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকরা নিজের অভিজ্ঞতার আলোকেই জমিতে সার ব্যবহার করে থাকেন। অনেকে এটাও জানেন না মৌসুম, ফসল ও জমিভেদে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, বালাইনাশক এবং আগাছা নাশকের ব্যবহার ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। তারা প্রায়শই প্রয়োজনের অতিরিক্ত রাসায়নিক সার, কীটনাশক, বালাইনাশক এবং আগাছানাশকের ব্যবহার করে থাকেন।
অথচ ছয় দশক আগে দেশে যখন প্রথম যখন রাসায়নিক সারের ব্যবহার শুরু হয় তখন হেক্টরপ্রতি এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৮ কেজি। বর্তমানে তা ৭৫ গুণ বেড়ে হেক্টরপ্রতি প্রায় ৬৬০ কেজি রাসায়নিক সার ব্যবহার হচ্ছে। এই হিসেবে পৃথিবীর মধ্যে এত অল্প আবাদি এলাকায় মোট ৫.৮ থেকে ৬.০ মিলিয়ন টন রাসায়নিক সার ব্যবহার এমন নজির আর কোথাও নাই। রাসায়নিক সারের এ বিপুল ব্যবহার কখনও কখনও স্থানীয় সার বিক্রেতার পরামর্শে কিংবা নিজ উদ্যোগেই বাড়ানো হয়েছে। এতে সাময়িকভাবে বিপুল পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন বেড়ে গেলেও অপপ্রয়োগের ফলে জমির স্বাস্থ্য ও উর্বরতা শক্তি হ্রাস পেয়েছে বহুগুণ।
মাটি পরীক্ষা করে অথবা গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের আলোকে সরকার নির্ধারিত মাত্রায় ফসলের চাহিদা অনুযায়ী জমিতে সুষম সার ব্যবহার করলে একদিকে যেমন জমির মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে অন্যদিকে খরচ সাশ্রয় হয় এবং ফসলের ফলন বেড়ে যায়। জমিতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সার ব্যবহার করলে ফসল আবাদের খরচ বেড়ে যায়, আবার বেশি পরিমাণ সার আমদানি ও কৃষদের নিকট সস্তায় বিক্রয়ের জন্য ভর্তুকি বাবদ প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা সরকারের খরচ করতে হয়। এছাড়াও অব্যবহৃত সার বৃষ্টি অথবা সেচের পানির সাথে মিশে গিয়ে পানি, মাটি, বায়ু তথা পরিবেশ দূষিত করে থাকে।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারে ব্যাপক হারে ভর্তুকী প্রদান করে কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে সার প্রাপ্তি নিশ্চিত করে আসছে। বিগত বছর সমূহে প্রতি বছর সার আমদানী বাবদ সরকার প্রায় ৮,০০০ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করেছে। সারের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য এবং চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে গত বছর বাংলাদেশ সরকারের এই খাতে ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশের ব্যবহৃত সার অধিকাংশই বিদেশ হতে আমদানি করতে হয়। সুষম সার পরিমিত মাত্রায় ব্যবহার না করার ফলে একদিকে যেমন কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অন্য দিকে সরকারের ব্যাপক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অপচয় যাচ্ছে। সারের অপচয় রোধ করে ফসলের কাঙ্খিত ফলন প্রাপ্তিতে সুষম সার পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয় করা গেলে সারের অপচয় তথা এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করা যাবে।
সরকার পরিমিত মাত্রায় সুষম সার ব্যবহারে গবেষণা ও ব্যবস্থাপনার উপর ‘নিউট্রিয়েন্ট ম্যানেজমেন্ট ফর ডাইভারসিফাইড ক্রপিং ইন বাংলাদেশ’শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। অস্ট্রেলিয়ান দাতা সংস্থা ACIAR এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন এর যৌথ অর্থায়নে সুষম সার ব্যবহারে গবেষণা ও ব্যবস্থাপনার উপর ‘নিউট্রিয়েন্ট ম্যানেজমেন্ট ফর ডাইভারসিফাইড ক্রপিং ইন বাংলাদেশ (নিউমান) শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল চলতি বছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে অনুষ্ঠিত এই প্রকল্পের গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন ও সার নীতিমালা সংলাপ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের। প্রকল্পটির অধীনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা ২০১৮ সাল থেকে আমন ধান, বোরো ধান, আউশ ধান, গম, ভুট্টা, মসুর, মুগ, সরিষা, ছোলা, বাদাম, সূর্যমুখী, আলুসহ বিভিন্ন ফসলে পরিমিত মাত্রায় সুষম সার ব্যবহারের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। অনুষ্ঠানে গবেষকরা জানান, সুষম সার ব্যবহারে শতকরা ৮ থেকে ১৪ ভাগ ফসল উৎপাদন বাড়ে এবং এতে বছরে বিশ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।
অনুষ্ঠানে কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএপি সারের ব্যবহার বাড়িয়ে ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমিয়ে আনা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ইউরিয়ার ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। আবার ডিএপির ব্যবহারও বাড়ছে। এতে করে সারের অপচয় হচ্ছে এবং সার আমাদনির খরচও বাড়ছে। তিনি বলেন, জমিতে এক কেজি ডিএপি সার ব্যবহার বাড়ালে ৪০০ গ্রাম ইউরিয়া সার কম ব্যবহার করলে হয়। এক্ষেত্রে টিএসপি সার ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। এ বার্তাটি মাঠ পর্যায়ে না পৌঁছানোর কারণে হাজার হাজার কোটি টাকা সরকারের অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে। এজন্য মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে অঞ্চল ভিত্তিক সার সুপারিশমালা ব্যবহার করে ফসল আবাদে সুষম সার ব্যবহারে কৃষকদের আগ্রহী করে তুলতে হবে।
অস্ট্রেলিয়ার মারডক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রিচার্ড ডব্লিউ বেল জানান, কৃষকরা সুষম সার ব্যবহার করলে বছরে ধান উৎপাদন বেশি হবে ৭৫ লাখ টন। সার্বিকভাবে বছরে লাভ হবে ২০ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। পরিমিত মাত্রায় সুষম সার ব্যবহারের সুফল জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে সার সুপারিশমালা গাইড ২০১৮ ব্যবহার করলে কৃষকের ব্যবহৃত সারের মাত্রা ও প্রকার হতে প্রতি ১ (এক) হেক্টরে প্রতি মৌসুমে ৩,০০০- ৯,৩০০ টাকা সার বাবদ খরচ সাশ্রয়করা যায় এবং ফলনও হেক্টর প্রতি প্রায় ৪৮০-৬২০ (আমন ধান) কেজি বেশি পাওয়া সম্ভব।
পরিশেষে বলতে চাই, ফসল আবাদে পরিমিত ও লাভজনক মাত্রায় সুষম সার প্রয়োগ ও ব্যবহার নিশ্চিতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা এখন সময়ের দাবী। মাটি পরীক্ষা অথবা বাংলাদেশ সরকারের অঞ্চল ভিত্তিক সার সুপারিশ মালা (এফআরজি) ব্যবহার করে ফসল আবাদে কৃষকদের আগ্রহী ও অভ্যস্ত করতে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ও মাঠ কর্মীদের প্রশিক্ষিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি অঞ্চল ভিত্তিক সার সুপারিশমালা (এফআরজি) কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া, স্থানীয় কৃষকদের সংগঠিত করে মৌসুম ভিত্তিক ফসল/জাত নির্বাচন করে গ্রুপ ভিত্তিক ফসল আবাদ ও পরিচর্যা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা প্রয়োজন। সর্বোপরি, ফসল আবাদে আবাদে সুষম সার ব্যবহার করে শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি এবং উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকদের আর্থ-সমাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা সম্ভব।
লেখক: উর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, প্রশিক্ষণ বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।