অ্যান্টিবায়োটিক মুক্ত ব্রয়লার উৎপাদনের প্রেক্ষাপট, প্রয়োজনীয়তা এবং করণীয় (১ম পর্ব)

ড. মোঃ শরিফুল ইসলাম:
ভূমিকাঃ অ্যান্টিবায়োটিক-মুক্ত পোল্ট্রি উৎপাদন সাম্প্রতিক বছরগুলিতে একটি আলোচিত বিষয়। অনেক দেশ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্ট-এর বৃদ্ধির প্রবর্তক হিসাবে প্রাণী খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে মানুষের জন্য চিকিত্সায় গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিকগুলিকে নিয়ন্ত্রিত বা অপসারণ করা হয়েছে, এমনকি পোল্ট্রি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী “বিশ্ব এ্যান্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহ” (১৬-২২ নভেম্বর) পালন করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো, মানুষকে এটা মনে করিয়ে দেয়া যে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে, তাই এটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া দরকার। সুতরাং সময় থাকতে আমাদের সকলেরই সচেতন হতে হবে।

অ্যান্টিবায়োটিক কী?
অ্যান্টিবায়োটিক হল এক ধরনের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল পদার্থ, যা ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে বা বৃদ্ধিতে বাঁধা দেয়, মানব ও প্রাণীচিকিত্সা উভয় ক্ষেত্রেই সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং/বা প্রতিরোধের জন্য অপরিহার্য। অ্যান্টিবায়োটিক (ইংরেজি: antibiotic) কয়েক ধরনের জৈব-রাসায়নিক ঔষধ যা অণুজীবদের (বিশেষ করে ব্যাক্টেরিয়া) নাশ করে বা বৃদ্ধিরোধ করে। সাধারানতঃ এক এক অ্যান্টিবায়োটিক এক এক ধরনের প্রক্রিয়ায় অন্যান্য অণুজীবের বিরুদ্ধে কাজ করে। বিভিন্ন ব্যাক্টেরিয়া (Bacteria) ও ছত্রাক (Fungi) থেকে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা হয়। "অ্যান্টিবায়োটিক" সাধারণভাবে ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার হয়, ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে না।

অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিত্র
দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধির জন্য ব্রয়লার মুরগির খাদ্যে বিশ্বব্যাপি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। তাই এন্টিবায়োটিকের ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তন্মধ্যে সুইডেন ১৯৮৬, ডেনমার্ক ১৯৯৫, নেদারল্যান্ড ১৯৯৯, তাইওয়ান ২০০৫, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ২০০৬, জার্মানি ২০০৮ এবং দক্ষিণ কোরিয়া ২০১০ সাল থেকে গ্রোথ প্রোমোটার হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। অন্যদিকে, আমেরিকা ২০১২ সালে খাদ্য ও ঔষধ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার তদারকি করে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কানাডা, মেক্সিকো, জাপান ও হংকং ভেটেরিনারী চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুসরন করে। চীনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রনের জন্য ২০০৭ সালে ন্যাশনাল এন্টিব্যাকটেরিয়াল রেজিস্টেন্স ইনভেস্টিগেশন নেট গঠন করে। ভারত পোল্ট্রি পালনে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের Withdrawal period অনুসরণ করে থাকে।

খামারীরা কেন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন?
১। ব্রয়লার মুরগির বৃদ্ধির হার পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ১৯৫৭ সালে একটি ব্রয়লার ৫৬ দিন পালন করলে গড় ওজন পাওয়া যেত ৯০০ গ্রাম। অন্যদিকে জেনেটিক উন্নয়নের ফলে ২০১৮-১৯ সালে মাত্র ১ মাস বয়সে একটি ব্রয়লার মুরগি প্রায় ২ কেজি ওজনের হয়ে থাকে। সুতরাং বর্তমানে খামারীদের ধারণা তাদের মুরগীগুলোকে অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়ালে কাঙ্ক্ষিত ওজন পাবেন না।

২। দেশে বাচ্চা উৎপাদনের জন্য হ্যাচারী এক জায়গায় স্থাপিত হলেও সারাদেশে খামারীদের কাছে বাচ্চা বিক্রয় ও সরবরাহ করতে প্রায় ২ দিন লেগে যায়। এতে বাচ্চা দূর্বল হয়ে পড়ে। এই ধকল কাটানোর জন্যও অনেকে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন।

৩। বাচ্চা ব্রুডিংকালীন সময়ে যে তাপমাত্রায় পালন করা প্রয়োজন বেশীরভাগ খামারী তা রক্ষা করতে পারে না। ফলে  কাঙ্ক্ষিত ওজন আসেনা এবং খামারীরা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন।

৪। অনেক খামারের জৈব নিরাপত্তা, খামার পরিকল্পনা, খাদ্য ব্যবস্থাপনা, লিটার ব্যবস্থাপনাসহ মুরগি পালনের জন্য আদর্শ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারে না। খামারী এর বিকল্প সহজ সমাধান হিসেবে এন্টিবায়োটিক ও গ্রোথের জন্য বিভিন্ন ধরনের মেডিসিন ব্যবহার করে থাকে।

৫। মুরগি বিক্রয়ের পর পরিবহনের সময় কোন নিয়ম (গাড়ীতে মুরগির ঘনত্ব, বায়ূ চলাচলের জন্য ফ্যান, অধিক গরম/শীতের কোন ব্যবস্থা না রাখা) অনুসরন করে না। ফলে, পরিবহনের ধকল নিরাময়ে অনেক খুচরা বিক্রেতা খাদ্য ও পানিতে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন।

৬। স্থানীয় খামারীদের অজ্ঞতা, গ্রামীণ/প্রত্যন্ত অঞ্চলে যথাযথ প্রাণী চিকিৎসা পরিষেবার অভাব এবং উচ্চ মুনাফার আকাঙ্ক্ষা কৃষকদের নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে প্ররোচিত করে।  

৭। বাংলাদেশে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই স্থানীয় ওষুধের দোকানে অ্যান্টিবায়োটিকগুলি সহজে পাওয়া যায় বিধায় খামারীরা তা নির্বিচারে ব্যবহার করেন।

৮। সাধারণত আধিকাংশ খামারী বাচ্চা এবং খাদ্যের জন্য ডিলারের উপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে ডিলারদের প্ররোচনায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন।

অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কুফলঃ
দেশের অধিকাংশ পোল্ট্রি খামারি মনে করেন অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া খামার করা সম্ভব নয়। খামারিগণ নিজেদের অজ্ঞতা কিংবা অন্ধ অনুসরণে বিনা প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে থাকেন। অধিকাংশ খামারি রুটিন অনুসরণ না করে এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে থাকেন। এভাবে অহেতুক অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পোল্ট্রি খামারীরা। নিয়মিত প্রত্যাহারের সময়কাল অনুসরণ না করে অ্যান্টিবায়োটিকগুলি ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এই যথেচ্ছা ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকগুলি টিস্যু এবং বিভিন্ন অঙ্গে জমা হয়ে বিভিন্ন ঘনত্বে অবশিষ্টাংশ তৈরি করে। বাংলাদেশে, সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে টেট্রাসাইক্লিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, এনরোফ্লক্সাসিন এবং অ্যামোক্সিসিলিনের মতো প্রধান অ্যান্টিবায়োটিকের উচ্চ মাত্রার অবশিষ্টাংশ বেশিরভাগ ব্রয়লারের লিভার, কিডনি, রানের মাংস এবং বুকের মাংসে পাওয়া যায়।

অ্যান্টিবায়োটিকের প্রত্যাহারকাল না মানার ফলে উক্ত মাংসে অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে গবেষণার তথ্য মতে, রান্না করলে (সিদ্ধ বা ফ্রাই করলে) ৯৬.২৫% সিপ্রোফ্লক্সাসিন, ৯৯.৫৫ % অক্সিটেট্রাসাইক্লিনের রেজিস্টেন্স ক্ষমতা নষ্ট হলেও কিছু বিদ্যমান থাকে ফলে ভোক্তার শরীরে এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স ক্ষমতা তৈরী হয়।

অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স যা আমাদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই ক্ষেত্রে ঔষধ খেয়েও ভালো ফল পাওয়া যায় না, কারন জীবাণুর বিপক্ষে অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করতে পারেনা।

অ্যান্টিবায়োটিক মুক্ত ব্রয়লার উৎপাদনের প্রয়োজনীতাঃ
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বলছে যে বাণিজ্যিক পোল্ট্রি খামারীরা প্রাণী চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র বা পরামর্শ ছাড়াই নির্বিচারে যে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন। বাংলাদেশে প্রেসক্রিপশন ছাড়া স্থানীয় ওষুধের দোকানে অ্যান্টিবায়োটিকগুলি সহজে পাওয়া যায়। এই ধরনের অনুশীলন প্রাণী এবং খাদ্য উত্স থেকে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের হার বৃদ্ধির সাথে সাথে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ও বাড়াচ্ছে।

অনেক দেশে, স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিকের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিক্রয় এবং বিতরণ অনুমোদিত, যা প্রায়ই অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার, সংক্ষিপ্ত/অসম্পূর্ণ চিকিত্সা কোর্স, অ্যান্টিবায়োটিকের ভুল নির্বাচন, অনুপযুক্ত ডোজ এর সাথে যুক্ত। অ্যান্টিবায়োটিকের নির্বিচারে ব্যবহার মাংসল প্রাণীদের দেহে অবশিষ্টাংশ জমা করে এবং ফলস্বরূপ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্টের বিকাশ ঘটায়।

এই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্টের কারণে প্রতি বছর প্রায় আমেরিকা এবং ইউরোপে যথাক্রমে ২৩,০০০ এবং ২৫,০০০ লোকের মৃত্যু ঘটে। ভারতে, একই কারণে প্রতি বছর প্রায় ৫৭,০০০ নবজাতক সেপসিসে মৃত্যু ঘটে। উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্ট ক্ষমতা বাংলাদেশকে একটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক হুমকির মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশে, ডায়রিয়ায় বছরে প্রায় ২৩০,০০০ শিশু মারা যায়, তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্টের কারণে। একটি সমীক্ষায় অনুমান করা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ১৫০,০০০ পোল্ট্রি ফার্ম বার্ষিক ৫৭০ মিলিয়ন টন মাংস এবং ৭.৩৩৪ বিলিয়ন ডিম উত্পাদন করছে এবং আমাদের সরবরাহকৃত পোল্ট্রির মাংস থেকে আমরা প্রায় ৬৮.১৭% প্রাণীজ প্রোটিন গ্রহণ করি।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এটা জানা গেছে যে ৮৮% কৃষক তাদের ফ্লোক থেকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রত্যাহার করেনি এবং তারা বিপণন পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে মাত্র ১০% কৃষক বাজারজাতকরণের আগে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন এবং মাত্র ২% কৃষক বাজারজাতকরণের কমপক্ষে ৭ দিন আগে অ্যান্টিবায়োটিক প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন কিন্তু তারা এটি নিয়মিত অনুসরণ করেননি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর গত ৭ মার্চ ২০১৯ সালে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিশট্রেশন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন।

অ্যান্টিবায়োটিক প্রোপার ডোজ হিসেবে নিতে হয়, কিন্তু মুরগীর মাধ্যমে আসা অ্যান্টিবায়োটিক ডোজ হিসেবে থাকছে না। এর ফলে অ্যান্টিবায়োটিক আন্ডার ডোজ হিসেবে গ্রহণে দুটি ঘটনা ঘটে। হয় এটি কোনো কাজ করবে না অন্যথায় আমাদের শরীরে থাকা রোগ সৃষ্টিকারী জীবানুগুলো স্বল্প পরিমান এ অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে রেসিসটেন্স তৈরি করে। যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে হ্রাস করে দেয়। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকযুক্ত ব্রয়লার আহারের কারণে গর্ভবতী মহিলা ও শিশুদের নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়।
আমাদের দেশের ব্রয়লার মুরগীর মাংস অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য হওয়ায় সকল শ্রেণির মানুষের খাদ্য তালিকায় এটি পাওয়া যায়। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক যুক্ত ব্রয়লার মুরগী আহারের ফলে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। সামান্য অসুস্থতার জন্য অনেকটা টাকার ঔষধ খেতে হয়।

বাংলাদেশে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি ও আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রাণিজ আমিষের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাণীজ আমিষের চাহিদা পূরণে আশির দশক থেকে এদেশে ব্রয়লার মুরগি পালন শুরু হয়। বিগত কয়েক বছরে রেড মিটের বাজার মুল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্রুতবর্ধনশীল ব্রয়লার মুরগি প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে দেশে মোট মাংসের চাহিদার শতকরা ৪০-৪৫ শতাংশ আসে পোল্ট্রি থেকে।

উচ্চমাত্রার কোলস্টেরলের কারণে অনেকেই গো-মাংস কম গ্রহণ করেন। তাই ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছেই পোলট্রি মাংস গ্রহণযোগ্য। এছাড়া ব্রয়লার সহজলভ্য ও সর্বত্রই পাওয়া যায়, মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণও সহজ। সুতরাং এ সকল বিবেচনায় অ্যান্টিবায়োটিক মুক্ত ব্রয়লার উৎপাদনের প্রয়োজনীতা অনস্বীকার্য।

অ্যান্টিবায়োটিক মুক্ত ব্রয়লার উৎপাদনের করণীয়ঃ
অ্যান্টিবায়োটিক মুক্ত ব্রয়লার উৎপাদনে জৈব নিরাপত্তা ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ মূল উপাদান হল সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা। অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াই ব্রয়লার পালনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন এখানে বর্ণনা করা হলো।   

১। কঠোর ডাউন-টাইম (দুই ব্যাচের মধ্যবর্তী সময়): অ্যান্টিবায়োটিক মুক্ত ব্রয়লারে উৎপাদন বাড়াতে এটি একটি উত্তম ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। এই ক্ষেত্রে নতুন ফ্লক এন্ট্রি ন্যূনতম ১৪ দিনের ব্যবধান (ডাউন-টাইম) হওয়া ভাল। এ সময়ে সব ব্রয়লার আউট করতে হবে এবং লিটার কেক অপসারণ করতে হবে। এটি সাধারনত খামারীর উত্পাদন অনুশীলনের উপর নির্ভর করে; তবে ডাউন-টাইম শুরু করা উচিত যখন ব্রয়লার শেডের বাইরে থাকে।

২। ব্রয়লারের সর্বোত্তম মজুদ ঘনত্ব: লাভজনক ব্রয়লার চাষে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা হলো  ব্রয়লারের ঘনত্ব। কম ঘনত্ব অ্যান্টিবায়োটিক মুক্ত ব্রয়লার উৎপাদনের জন্য একটি চমৎকার বিকল্প হতে পারে। বর্তমান প্রচলিত প্রোগ্রামের তুলনায় স্টকিং ঘনত্ব হ্রাস করে, লিটারের আর্দ্রতা ন্যূনতম রাখা যায়। যার ফলস্বরূপ কক্সিডিওসিস এবং প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া হ্রাস পায়। এই অনুশীলনটি সঠিক বায়ুচলাচল এবং বায়ুচলাচলের ক্ষেত্রেও সাহায্য করে, এইভাবে রোগজীবানুর চাপ কমায়।

৩। ভাল লিটার ম্যানেজমেন্ট: লিটারের শুষ্কতা এবং কম অ্যামোনিয়া লেভেল মুরগি পালনে সফল হওয়ার বড় চাবিকাঠি। লিটার স্যানিটেশন এবং পরিষ্কার নিয়মিত বিরতিতে করা উচিত। উপরন্তু বিল্ড আপ লিটার বিভিন্ন ধরনের রোগজীবানুর আশ্রয় স্থল হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সুতরাং বছরে অন্তত একবা্র সমস্ত লিটার পরিষ্কার করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

৪। কন্ট্রোল এনভায়রনমেন্ট হাউজিং: পর্যাপ্ত বায়ুচলাচল হল ঘরের পরিবেশের গুণমান নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি। বাচ্চা সরবরাহকারী সংস্থাগুলি ব্রয়লার পালনের জন্য তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং বায়ুর গুণমানের উপর একটি আদর্শ তালিকা প্রদান করে, তা অনুসরন করা উচিত। মনে রাখতে হবে ধুলো ব্যাকটেরিয়ার একটি চমৎকার বাহক এবং মোল্ড হল সংক্রমণের সম্ভাব্য উৎস।

৫। প্রি-স্টার্টার ফিড: জিআই ট্র্যাক্টের পুষ্টি বৃদ্ধি, এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রোবায়োটিক, প্রিবায়োটিক, জৈব অ্যাসিড করে পুষ্টির শোষণকে সহজ করার যায়। এছাড়া সংক্ষিপ্ত এবং মাঝারি চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড, এবং ফাইটোজেনিকের ব্যবহার অন্ত্রের মাইক্রোবিয়াল সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে অন্ত্রের মাইক্রোবায়োটাতে ভারসাম্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে খাদ্য কণার আকার, প্রোটিন-চর্বি গুণগতমান এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদানের দিকেও বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত।  

৬। পানির গুণগতমান এবং স্যানিটেশন: একটি সঠিক পানি স্যানিটেশন প্রোগ্রাম পোল্ট্রি উৎপাদনের চাবিকাঠি। পানি পাখির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি। ব্যাকটেরিয়া, পিএইচ, কঠোরতা, খনিজ এবং মোট দ্রবীভূত কঠিনের জন্য নিয়মিত পানির গুণমান বিশ্লেষণ বার্ষিকভাবে করা উচিত।

৭। ফিড অ্যাডিটিভ বিকল্প: সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নেক্রোটিক এন্টারাইটিস প্রতিরোধে প্রোবায়োটিকস, প্রিবায়োটিকস, জৈব অ্যাসিড এবং এনজাইমের মতো ফিড অ্যাডিটিভের অনেকগুলি বিকল্প গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা পালন করছে।

৮। অপরিহার্য তেল: অপরিহার্য তেল হল একটি উদ্ভিদের গন্ধযুক্ত এবং উদ্বায়ী সুগন্ধযুক্ত যৌগের হাইড্রোফোবিক তরল। অপরিহার্য তেল প্রাকৃতিক (উদ্ভিদ উৎপত্তি) বা সিন্থেটিক হতে পারে। শুধুমাত্র কয়েকটি অপরিহার্য তেলের উপকারী অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। থাইমল, ট্রান্সসিনামালডাইড, কারভাক্রোল এবং ইউজেনল বেশির ভাগই প্রতিশ্রুতিশীল বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই তেলগুলি ব্রয়লার এর নেক্রোটিক এন্টারাইটিসে প্রতিরোধমূলক এবং নিরাময়মূলক ভূমিকাও পালন করে মাংসের গুণমানের পাশাপাশি মুরগির স্বাস্থ্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

৯। প্রোবায়োটিকস: প্রোবায়োটিকগুলিকে "জীবন্ত অণুজীব হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যখন পর্যাপ্ত পরিমাণে পরিচালনা করা হয়, তখন হোস্টের জন্য একটি স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান করে"। প্রোবায়োটিক ফিডের পরিপূরক বৃদ্ধি, ফিডের কার্যকারিতা এবং অন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে।  

১০। প্রিবায়োটিকস: প্রিবায়োটিকগুলি হজমযোগ্য খাদ্য উপাদান যা স্বাস্থ্যের জন্য সম্ভাব্য উপকারী কারণ তাদের গাঁজনযোগ্য বৈশিষ্ট্য যা ইলিয়াম এবং সিকামে ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি এবং/অথবা কার্যকলাপকে উদ্দীপিত করে। এই প্রিবায়োটিক উপাদানগুলো পোল্ট্রি উৎপাদনশীলতার উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং একটি সুস্থ অন্ত্রের ট্র্যাক্টে অবদান রাখে এবং অ্যান্টিবায়োটিকের একটি ভাল বিকল্প হতে পারে।  

১১। জৈব অ্যাসিড: জৈব অ্যাসিড হল সংরক্ষণ এজেন্ট যা খাদ্যকে জীবাণু এবং ছত্রাকের বিস্তার থেকে রক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়। এগুলি মূলত কার্বক্সিলিক অ্যাসিড যা আলফা কার্বনে হাইড্রক্সিল গ্রুপ বহন করে যেমন ম্যালিক, ল্যাকটিক এবং টারটারিক অ্যাসিড। জৈব অ্যাসিডগুলো সাধারণ মনোকারবক্সিলিক অ্যাসিড যেমন অ্যাসিটিক, ফর্মিক, বিউটরিক এবং প্রোপিওনিক অ্যাসিড হতে পারে।

১২। অ্যামিনো অ্যাসিড এবং এনজাইম: ফিড অ্যাডিটিভ এনজাইমগুলো ছত্রাক এবং ব্যাকটেরিয়া গাঁজন দ্বারা উত্পাদিত হয়। এগুলো ফিড রূপান্তর সর্বাধিক ব্যবহার করা হয়।

১৩। ফাইটোজেনিক ফিড অ্যাডিটিভস: ফাইটোজেনিক ফিড অ্যাডিটিভগুলি উদ্ভিদ, ভেষজ, মশলা থেকে প্রাপ্ত এবং প্রাণীর কর্মক্ষমতা উন্নত করতে ব্যবহৃত হয়। ব্রয়লারের বৃদ্ধি, ইমিউন সিস্টেমের উন্নতি এবং স্ট্রেস হ্রাসের উপর ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায় যে ফাইটোজেনিক ফিড অ্যাডিটিভসগুলো অ্যান্টিবায়োটিকের ভাল বিকল্প ।  ......................................(চলবে)
লেখকঃ প্রফেসর, গবেষক, কনসালট্যান্ট
ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী-৬২০৫।