মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন:চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এটি মূলত ডিজিটাল বিপ্লব। এই ধারণাটি ১ এপ্রিল,২০১৩ সালে জার্মানিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপিত। এর ফলে কল-কারখানাগুলোর ব্যাপক হারে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসে আমূল পরিবর্তন। আগের শিল্পবিপ্লবগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, মানুষ যন্ত্রকে পরিচালনা করছে; কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে যন্ত্রকে উন্নত করা হয়েছে,ফলে যন্ত্র নিজেই নিজেকে পরিচালনা করছে।
২০১৬ সালে ‘দ্য ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন’ নামে একটি বই লিখেছিলেন বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী চেয়ারম্যান ক্লাউস শোইয়াব। তার মতে ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব’-এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো সেলফ-অপটিমাইজেশন, সেলফ-কনফিগারেশন, সেলফ-ডায়গনজ, কগনিশনের প্রবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান জটিল কাজে কর্মরত কর্মীদের বুদ্ধিদীপ্ত সহায়তায় প্রয়োজনীয় স্বয়ংক্রিয়করণ প্রযুক্তির নবতর বিকাশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন সম্প্রতি বইটির বাংলা অনুবাদ করেছেন।
প্রযুক্তির কল্যাণে বর্তমান পৃথিবী পরিণত হয়েছে বৈশ্বিক গ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজে। তথ্য আদানপ্রদানের ক্ষেত্রেও কল্পনাতীত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণামতে,আগামী দশ বছরের মধ্যেই বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি খাতে ডিজিটাল এই বিপ্লবের মাধ্যমে ব্যাপক রূপান্তর পরিলক্ষিত হবে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক দৃশ্যমানতা বিশ্বব্যাপী নবতর রূপ পরিগ্রহ করেছে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাবে পাল্টে যেতে পারে উৎপাদন প্রক্রিয়া-ব্যবস্থাপনাসহ রাষ্ট্র পরিচালন প্রক্রিয়াও। অতি আশাবাদী অনেকের ধারণা,মানুষের জীবন হবে আরও মসৃণ-আরামদায়ক-নীরোগ ও সুখময়।
মানুষের মেধা ও অভিজ্ঞতার বিরতিহীন প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমে অর্জিত হয়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ‘Industry 4.0’ নামে পরিচিতি লাভ করছে। আঠার শতকের শেষার্ধে শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডে যে বৈল্পবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়,তা-ই শিল্পবিপ্লব। শিল্পবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ড বিশ্বের প্রথম শিল্পোন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং দেশটি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের দিক থেকে এগিয়ে যায়। তাই ইংল্যান্ডকে পৃথিবীর কারখানা বলা হয়। সৃষ্টিলগ্ন থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে মোট তিনটি শিল্পবিপ্লব ঘটেছে যা বদলে দিয়েছে সারা বিশ্বের গতিপথ, বিশ্ব অর্থনীতির গতিধারা। প্রথম শিল্পবিপ্লব ১৭৮৪ সালে পানি ও বাষ্পীয় ইঞ্জিনের নানামুখী ব্যবহারের কৌশল আবিষ্কারের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছিল। এতে অনেকদূর এগিয়ে যায় বিশ্ব। প্রথম শিল্পবিপ্লবের ৮৬ বছর পরে ঘটে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ফলে একেবারেই পাল্টে যায় মানুষের জীবনের চিত্র। কায়িক পরিশ্রমের জায়গা দখল করে নেয় বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতি। প্রথম শিল্পবিপ্লব থেকে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের প্রভাব আরও বিস্তৃত। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের ঠিক ১০০ বছরের মাথায় ১৯৬৯ সালে তৃতীয় শিল্পবিপ্লব ফলে আবিষ্কৃত হয় ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের আবির্ভাবে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সময় তথ্যপ্রযুক্তির সহজ ও দ্রুত বিনিময় শুরু হলে সারা বিশ্বের গতি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ম্যানুয়াল জগৎ ছেড়ে যাত্রা শুরু হয় ভার্চুয়াল জগতের। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আসছে এ ভার্চুয়াল জগতেরই আরও বিস্তৃত পরিসর নিয়ে।
চলমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রযুক্তির সংমিশ্রণে শারীরিক,সংখ্যা এবং জীববিজ্ঞানসংক্রান্ত ক্ষেত্রের পার্থক্য রেখা অস্পষ্ট করে । এ শিল্পবিপ্লব সব শিল্পকে তছনছ করে দিচ্ছে এবং পরিবর্তনের ব্যাপ্তি ও গভীরতা পুরো উৎপাদন,ব্যবস্থাপনার রূপান্তরের নিয়ে হাজির হয়েছে। এমন অভূতপূর্ব রূপান্তর মানবজাতি এর আগে আর কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। অর্থনীতিই নয় জগৎ ও জীবনের সবকিছু মানুষের চিন্তাভাবনা, দর্শন, রাজনীতি, শিল্প ও সংস্কৃতি সবকিছুর ওপরই এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে তৈরি হয়ে গেছে ন্যানোপদার্থ যা লোহা থেকে ২০০ গুণ শক্ত অথচ মাপে মানুষের চুলের ১০ লাখ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তিগত আলোড়ন সর্বত্র বিরাজমান। এ বিপ্লব চিন্তার জগতে, উৎপাদনে ও সেবা প্রদানে বিশাল পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। মানুষের জীবনধারা ও পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি ব্যাপকভাবে বদলে দিচ্ছে। জৈবিক, পার্থিব ও ডিজিটাল জগতের মধ্যেকার পার্থক্যের দেয়ালে চিড় ধরিয়েছে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স,রোবটিক্স,ইন্টারনেট অব থিংস,ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, থ্রিডি প্রিন্টিং, ক্লাউড কম্পিউটিং, ব্লক চেইন প্রযুক্তি, উন্নতমানের জিন প্রযুক্তি, বিগ ডেটা অ্যানালাইটিক, হরিজন্টাল ও ভার্টিক্যাল সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, সাইবার সিকিউরিটি, রোবোটিক্স, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও অন্যান্য প্রযুক্তি মিলেই এ বিপ্লব।
যান্ত্রিকতার আগ্রাসন থেকে সরে এসে যন্ত্রের সহাবস্থান তৈরি করার উদ্দেশ্যেই ৫ম শিল্পবিপ্লবের কথা ভাবা হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতি ফোরাম ৫ম শিল্পবিপ্লবকে মানবিক বলছে। ৫ম শিল্পবিপ্লব প্রযুক্তি দিয়ে মানুষের স্থলাভিষিক্ত না করে মানুষের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার আশাবাদ ব্যক্ত করছে। ৪র্থ বা ৫ম শিল্পবিপ্লব মূলত প্রযুক্তির নব নব আবিষ্কারের একেকটি ধাপ। প্রযুক্তির প্রসারে ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন সবসময়েই কিছুটা কর্মসংস্থান লুপ্ত করে দেয় এবং পরবর্তী সময়ে আবার নতুন স্থানে নতুন ধরনের কাজের মাধ্যমে সেগুলো প্রতিস্থাপন করে যেমন কৃষি। কৃষিক্ষেত্রে স্মার্ট সেন্সর জমিতে প্রাপ্ত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে যোগাযোগ করে। এর উদ্দেশ্য হলো বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলোর ওপর ভিত্তি করে স্মার্টফোন দিয়ে সঠিক সময়ে পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করে ফলাফল, সময় এবং অর্থের দিক দিয়ে জমি পরিচালনাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে কার্যকর করা। খামারে এ সেন্সরগুলো ব্যবহার করে শস্যের অবস্থা বোঝা যাবে এবং সঠিক সময়ে ইনপুট এবং চিকিৎসা পরামর্শ পাওয়া যাবে। এমনকি সেচের পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব অভিযোজনের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলা যেমন বিশ্বব্যাপী টেকনোলজির দক্ষ মানবসম্পদ গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি ৫ম শিল্পবিপ্লব ধারণের জন্য মানুষ ও যন্ত্রের সমন্বয় সাধনে মানবসম্পদই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন হলো জনসক্ষমতার এমন এক গুণগত পরিবর্তন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে তারা উৎপাদনক্ষম ও দক্ষ জনশক্তি হিসেবে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ক্রমবর্ধিষ্ণুভাবে প্রয়োগে অবদান রাখতে পারে এবং মানবীয় শক্তি-সামর্থের সর্বোত্তম ব্যবহারে সক্ষম হয়ে উঠতে পারে। মানবসম্পদের এ ধারণাগত ভাবনা থেকে বলা যায় জনশক্তির গুণগত পরিবর্তনের সূচনা শিশুমন থেকে গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। যার ভিত্তি হতে হবে প্রাথমিক এবং পর্যায়ক্রমে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
উন্নত বিশ্বেও উন্নত হওয়ার ঐতিহাসিক বাস্তবতার আলোকে বহুবছর ধরেই উন্নয়ন শাস্ত্রবিদ একমত যে-কৃষির ওপর নির্ভরশীল অর্ধ-বেকারদের শিল্প খাতে নিয়োগের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় ও শিল্প খাতের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে রূপান্তর প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। কৃষি খাতে নিযুক্ত বেকারেরা উৎপাদন খাতে যোগ দান করে। এতে করে নতুন কাজ পাওয়া শ্রমিকের আয় বৃদ্ধি হওয়ায় ও ব্যয় করার সামর্থ্য অর্জন করায় ভোগ ব্যয় ও চাহিদা বাড়ায় উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। আর এ পুণ্যচক্রই দুষ্টচক্রের ক্ষতকে হ্রাসকরণের মাধ্যমে জাতীয় আয় তথা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে থাকে। কৃষি খাতে নিযুক্ত বেকারদের গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের মাধ্যমেই এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের গল্পটিও এমনই;কোনো কল্পিত ‘উন্নয়ন আশ্চর্য’ চিত্রায়ণের অবকাশ নেই।
ই-প্রস্তুতি একটি ডিজিটাল সমাজের জন্য মৌলিক শর্ত। ই-প্রস্তুতি একজন নাগরিককে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সম্পূর্ণরূপে অংশ নেয়ার ক্ষমতা বাড়ানোর আশা জাগায়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাংলাদেশের বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি থেকে বাঁচার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি জনমিতিক ফলাফল বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগানোর সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের বয়স ২৪ বছরের নিচে। এ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুবিধা কাজে লাগাতে প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। মোট জনসংখ্যার ৫৮.৫% অর্থনীতিতে ক্রিয়াশীল এবং তাদের মধ্যে মাত্র ৫.৩% বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষিত। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের মাত্র ০.৩% কর্মসংস্থান হয়েছে। নতুন করে আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বিপুলসংখ্যক দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ও জোগানের বিষয়টি আলোচিত হয়। এ দেশে মেধাবী, দক্ষ ও সম্ভাবনাময় তরুণ রয়েছে। কিন্তু এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন অনুযায়ী গুণগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। ব্যক্তি নিজে চাইলেই দক্ষতা বাড়াতে পারে না।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে‘এশিয়ান টাইগার’ বলে পরিচিতি পেয়ে গেছে। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের প্রতিবেদনে দেখা যায়,আগামী বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আমাদের হাই-টেক পার্কগুলো হবে আগামী দিনের সিলিকন ভ্যালি। বর্তমানে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা ও ৪ হাজার ৫০১টি ইউনিয়ন পরিষদকে ডিজিটাল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে,সারা দেশে ৮ হাজার ২৮০টি ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে তিনশতের অধিক সরকারি-বেসরকারি সেবা দেশের জনগণ নিয়মিত গ্রহণ করছেন। প্রতিটি উপজেলায় এবং পর্যায়ক্রমে গ্রাম পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগের অংশ হিসেবে দেশের অধিকাংশ উপজেলায় ব্রডব্যান্ড ব্যবস্থা পৌঁছে দিয়েছে। দুর্গম ৬১৭ ইউনিয়নেও যেন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি অতিক্রম করেছে। কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ তৈরি ও অ্যাসেম্বলিং, সফটওয়্যার তৈরি এবং ডাটা প্রসেসিং কাজে দেশের লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। অদূর ভবিষ্যতে আইসিটি ও সফটওয়্যার শিল্প রপ্তানি খাতকে আরও সমৃদ্ধ করবে। আন্তর্জাতিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশে গবেষণা-উন্নয়ন ও উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপনে বিশেষ সুবিধা দেওয়ায় হাই-টেক পার্কগুলোতে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৫২ হাজারের বেশি ওয়েবসাইটে ভরপুর জাতীয় তথ্য বাতায়নে যুক্ত রয়েছে ৯৫ লাখেরও অধিক বিষয়ভিত্তিক কনটেন্ট এবং ৬৮৫টির বেশি ই-সেবা, যা খুব সহজেই মানুষ অনলাইনে পাচ্ছেন। জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩-এর মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৭ কোটির বেশি সেবা দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল সেন্টার,জাতীয় তথ্য বাতায়ন ও মাইগভঃ থেকে প্রতি মাসে সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা প্রায় ৭৫ লাখের বেশি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগি ভবিষৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (মাদরাসাসহ মাধ্যমিক স্তরে) ও ১০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব’ স্থাপন করা হয়েছে। ২০০৯-১৯ অর্থ বছরে ১২৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় ২ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব এবং ১০০ টি ডিজিটাল ক্লাশরুম স্থাপন করা হয়েছে। সবগুলো ইন্টারনেট সেবা ২০২৩ সালে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলে সংযোগ হবে। ২০২৫ সাল নাগাদ শতভাগ সরকারি সেবা অনলাইনে পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে আইসিটি মন্ত্রণালয়।
ইতোমধ্যে ৫-জি নেটওয়ার্ক সেবা চালু করা হয়েছে; যেটি ব্যবসার মডেল, শিক্ষা পদ্ধতি, জীবনযাত্রার মান, প্রচলিত ডিজিটাল এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দেবে। সরকারের প্রধান সেবাগুলো, বিশেষ করে ভূমি নামজারি, জন্মনিবন্ধন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন, ভোটার আইডি কার্ড, ই-টিন সার্টিফিকেট ইত্যাদি ডিজিটাল পদ্ধতিতে নাগরিকদের সেবা দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় প্রতি উপজেলায় একটি করে কারিগরি কলেজ স্থাপনের কাজ পুরোদমে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিটি জেলায় প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সারা দেশের সব বিভাগ-জেলায় হাই-টেক ও আইটি পার্ক স্থাপনেরও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এপর্যন্ত নির্মিত ৩৯টি হাই-টেক পার্কের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ দক্ষ জনবল তৈরি করে যাচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মতে,৯টি হাই-টেক পার্কে দেশি-বিদেশি ১৬৬টি প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে,যাতে বিনিয়োগ হয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের আইসিটি রফতানি ১ বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে বর্তমানে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বিদ্যমান প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সারের আউটসোর্সিং খাত থেকে আয় হচ্ছে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কর্মসংস্থান ও মানবসম্পদ উন্নয়ন হয়েছে যথাক্রমে ২১ হাজার ও ৩২ হাজার।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহান মুক্তিযুদ্ধের পরপরই রাঙ্গামাটি পাবর্ত্য জেলার কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়াতে একটি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র চালু করেছিলেন। বাংলাদেশ এখন দুটি সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে, তৃতীয় সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে কানেকটিভিটির কাজ চলছে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় সরকার আকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করার মাধ্যমে আগামী দিনের বিশ্বকে জানান দিচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে বাংলাদেশও প্রস্তুত।
যে প্রযুক্তিগত বিকাশ ভৌগোলিক দূরত্বকে অপ্রাসঙ্গিক করে পুঁজির বৈশ্বিক বিস্তারকে বেগবান করেছে, তা একই সঙ্গে বৈশ্বিক প্রতিরোধ ও মুক্ত সমাজ নিয়ে মানুষের চিন্তার আদান-প্রদানকেও সহজ করেছে। বর্তমান প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উৎকর্ষতায় এই ধরিত্রীর গতি-প্রকৃতি ও মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সাগর-মহাসাগরের ব্যবধান সংকোচনে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-অঞ্চল নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্বের মানুষকে করেছে একে অপরের নিকটতর প্রতিবেশী। এর ফলে এই পৃথিবী পরিণত হয়েছে বৈশ্বিক গ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজে। বাংলাদেশ দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে।
লেখক:সিনিয়র তথ্য অফিসার জনসংযোগ কর্মকর্তা পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়