আবুল বাশার মিরাজ, বাকৃবি: যেদিকে তাকাবেন শুধু ফল আর ফল। বাহারী স্বাদের, নানা রঙের ফল। ফলের গন্ধে, রঙে মাতোয়ারা হতে পড়বেন যে কেউ। গাছের নিচেও পড়ে থাকতে দেখবেন নানা ফল, তবে সেগুলো উঠানো নিষেধ। কারণ গবেষণা কার্যক্রম চলছে ফলগুলো নিয়ে। আর এ ফল জাদুঘরের দেখা পেতে আপনাকে যেতে হবে ময়মসসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) জার্মপ্লাজম সেন্টারে। আমেরিকার ইউএস-ডিএআরএসের গবেষণায় বাংলাদেশ তথা এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ফলদ বৃক্ষের সংগ্রহশালা এটি ৷
ফল জাদুঘর তথা জার্মপ্লাজম সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. মোক্তার হেসেন বলেন, 'ফলের জিন সংরক্ষণ, শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের কেন্দ্র, ফলের হিডেন নিউট্রেশন সংরক্ষণ এবং কৃষকদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে এটি স্থাপিত হয়। বাকৃবির উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের সহযোগিতায় সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড কো-অপারেশনের অর্থায়নে ১৯৯১ সালে ১ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত হয় এই ফল জাদুঘর, তখন এর নাম ছিল ফ্রুট ট্রি স্টাডিজ। পরবর্তীকালে এ প্রকল্পের নাম দেয়া হয় ফল গাছ উন্নয়ন প্রকল্প। যার বর্তমান নাম ফলদ বৃক্ষের জার্মপ্লাজম সেন্টার এবং এর বর্তমান আয়তন ৩২ একর।'
জানা গেছে, প্রতি বছর বিভিন্ন সময়ে দেশী-বিদেশী অনেক গবেষক ও দর্শনার্থী আসেন এ ফল জাদুঘর দেখতে। শুধু দেখতেই নয় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চারা সংগ্রহ করতে আসে হাজার হাজার মানুষ। দেশের বাইরেও এর প্রসার বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন।
১৯৯১ সাল থেকে বাকৃবির গবেষকদের নিরলস গবেষণার ফলে শতাধিকের উপর বিভিন্ন প্রজাতির ফলের জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। এ জাতগুলোর মধ্যে রয়ছে বাউ আম, বাউ পেয়ারা, বাউকুল, বাউ লেবু, বাউ জাম্বুরা, বাউ কামরাঙ্গা ৩টি, বাউ লিচু, বাউ জলপাই, বাউ আমলকী, বাউ ডুমুর, বাউ মালটা, বাউ অরবরই ও বাউ কাজুবাদাম, বাউ জামরুল, বাউ সফেদা, বাউ মাল্টা, বাউ স্ট্রবেরি, বাউ ডুমুর প্রভৃতি। এছাড়া বাউ ড্রাগন (সাদা), বাউ ড্রাগন ফল (লাল) প্রভৃতি ফল।
ফল জাদুঘরসূত্রে জানা যায়, এ জাদুঘরে রয়েছে প্রায় ২০০ প্রজাতির প্রায় ১০ হাজারের অধিক জাতের মাতৃগাছ যার মধ্যে হাজারের অধিক দেশী-বিদেশী বিরল জাতের। এসব দেশী বিদেশী বিরল গাছের মধ্যে রয়েছে ২২০ রকমের আম, ৫৭ রকমের পেয়ারা, ২৩ রকমের লিচু, ৪৭ রকমের লেবু , ৯৪ রকমের কাঁঠাল, ৬৭ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় অপ্রধান ফল, ৬৮ প্রজাতির ফলদ ঔষধি গাছ, ২৭ প্রজাতির ভেষজ গাছ ও ৫৮ প্রজাতির বিদেশী ফল। আর এ সবই সেন্টারটিকে পরিণত করেছে ফলের স্বর্গরাজ্যে।
বাকৃবির ফল গবেষকরা জানান, 'নানা কারণে এবং অসচেতনতায় দেশ থেকে বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে নানা ফল। বিলুপ্তপ্রায় এসব ফলগুলো এ জার্মপ্লাজম সেন্টার বন, জঙ্গল, পাহাড়, বসত-ভিটাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সন্ধানের মাধ্যমে সংগ্রহ ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে এবং এর উপর নিবিড় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে পাওয়া যেত ১০০ এর অধিক বিলুপ্ত ও অপ্রচলিত ফলগুলো সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে এ জাদুঘরটিতে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে টাকিটুকি, পানকি, চুনকি, লুকলুকি, উড়িআম, বৈঁচি, চামফল, নোয়াল, রক্তগোটা, মাখনা, আমঝুম, মুড়মুড়ি, তিনকরা, সাতকরা, তৈকর, আদা জামির, ডেফল, কাউফল, বনলেবু, চালতা ইত্যাদি ফল। এছাড়া বিভিন্ন বিদেশী ফল বা ফলের গাছ যেমন- প্যাসন ফল, জাবাটিকাবা, শানতোল, রাম্বুটান, লংগান, ম্যাঙ্গোষ্টিন, সীডলেস লিচু, ডুরিয়ান, এভোকেডো ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করছেন ভবিষ্যতে এ দেশে নতুন জাত হিসেবে মুক্তি দিতে।'
উল্লেখ্য, এ সেন্টারে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয় মূলত পিএইচডি ও এমএস পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রী দ্বারা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ করে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রী এ সেন্টারে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।